পদ্মার চরে খড়ের টাকা ভাগাভাগি করে নেয় ১১ বাহিনী
আমানুল হক আমান, বাঘা (রাজশাহী)
প্রকাশ: ১৩ নভেম্বর ২০২৫, ০৭:৪২ পিএম
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
পদ্মার চরে ১১টি বাহিনী খড়ের টাকা ভাগাভাগি করে নেয়। জমির মালিক পায় না কিছুই। এ নিয়ে দ্বন্দ্বে খুন হন তিনজন। এক বিঘা জমিতে ২-৩ হাজার খড়ের আঁটি হয়। প্রতি আঁটি বিক্রি হয় ৭-৮ টাকা দর হিসাবে। প্রতি বছর খড় দখলকে কেন্দ্র করে ঝরে রক্ত।
জানা গেছে, রাজশাহীর বাঘা, পাবনার ঈশ্বরদী, কুষ্টিয়ার দৌলতপুর এবং নাটোরের লালপুর উপজেলার পদ্মা নদীর চরে জেগে ওঠে। এই চরে প্রাকৃতিকভাবে প্রচুর পরিমাণে খড় হয়। প্রতি বছর এই চরে সাড়ে ৩শ কোটি টাকার খড় কেনাবেচা হয়। খড়ের মূল্য জমির মালিক পান না। এই খড় কাটতে গেলে শুরু হয় বন্দুকযুদ্ধ।
পদ্মার চরে বালুর উপর জন্মানো খড়ের বেশিরভাগ পানের বরজে ছাউনি তৈরিতে কাজে লাগে। এই খড় নিয়ে বাঘা উপজেলার পদ্মা নদীর আলাইপুর ঘাটে ৪০ জন ব্যবসা করেন। তারা চর থেকে খড় কিনে ঘাটে এনে বিক্রি করেন। পদ্মার চর থেকে প্রতি আঁটি কেনা হয় ৭-৮ টাকা দরে। এরপর নৌকায় করে ঘাটে নিয়ে এসে বিক্রি করা হয়। খড় কেটে নৌকা বোঝাই করার পর তারা এসে ৫-৬ হাজার টাকা নিয়ে চলে যায়।
খড় ব্যবসায়ী আরিফুল ইসলাম বলেন, চরে অনেক মানুষের জমি রয়েছে। সেগুলো থেকে খড় কেনা হয়। খড় কেনা বাবদ কাঁকন বাহিনীকে ৪-৫ হাজার টাকা দিতে হয়। এই চরে খড়কে কেন্দ্র করে প্রতি বছর কোটি টাকার লেনদেন হয়। মারাও যান অনেকে।
পদ্মার চরে কাঁকন বাহিনীসহ ১১টি সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর আধিপত্য দীর্ঘদিনের। তারা চরের বাসিন্দাদের ওপর অত্যাচার করে।
সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর মধ্যে রয়েছে- মণ্ডল বাহিনী, টুকু বাহিনী, সাঈদ বাহিনী, লালচাঁদ বাহিনী, রাখি বাহিনী, শরীফ কাইগি বাহিনী, রাজ্জাক বাহিনী, চল্লিশ বাহিনী, বাহান্ন বাহিনী, সুখচাঁদ বাহিনী ও নাহারুল বাহিনী।
এই খড় ব্যবসাকে কেন্দ্র করে দখল ও আধিপত্য বিস্তারের জেরে ২৭ অক্টোবর হবিরচরে কাঁকন বাহিনীর গুলিতে বাঘা উপজেলার নিচখানপুর গ্রামের আমান মণ্ডল ও নাজমুল মণ্ডল নিহত হন। পর দিন ২৮ অক্টোবর হবিরচর থেকে লিটন নামের এক ব্যক্তির মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ।
পুলিশের ধারণা, নিহত লিটন কাঁকন বাহিনীর সদস্য। এ হত্যাকাণ্ডের পরে আলোচনায় আসে চরের বিভিন্ন বাহিনীর সক্রিয়তার কথা। এ নিয়ে ভয় ও আতঙ্কে মুখ খুলেতে চায় না চরের মানুষ।
খানপুর গ্রামের শফিক হোসেন বলেন, বিভিন্ন সময় স্পিডবোট ও বড় নৌকায় করে পদ্মার বুকে চলে সশস্ত্র মহড়া। ভারি অস্ত্র নিয়ে গুলি ছোড়া হয়। চরের কাঁশবন, ভূমি দখল, বালু মহল নিয়ন্ত্রণ ও আধিপত্য বিস্তারে বাহিনীর দৌরাত্ম্য পাবনার সাড়া ইউনিয়নের বালুর ঘাট থেকে কুষ্টিয়ার ভেড়ামারা, দৌলতপুর, নাটোরের লালপুর হয়ে রাজশাহী বাঘা উপজেলার আলাইপুর ঘাট পর্যন্ত।
প্রতি বছর ভরা মৌসুমে পানি নেমে যাওয়ার পর পদ্মার বুকে জেগে ওঠে বিস্তীর্ণ চর। এই চরের বিনা খরচের ফসল হয় খড়। বাঘা উপজেলার চরে বছরে খড়ের ব্যবসা হয় ৫০ কোটি টাকার। পাবনা থেকে রাজশাহী পর্যন্ত হয় ৩০০ কোটি টাকার বাণিজ্য। বিশাল অংকের এই কারবারে জমির মালিক থাকে উপেক্ষিত। পুরোটা নিয়ন্ত্রণ করে কাকঁনসহ বিভিন্ন বাহিনী ও প্রভাবশালী সিন্ডিকেট।
বাঘা উপজেলার চকরাজাপুর চরের রজব মণ্ডলের সাড়ে ১২ বিঘা জমি রয়েছে। চরে অন্য ফসল পাওয়া গেলেও বর্ষার পর খড় পাওয়া যায় না। এই খড়গুলো দখল করে বিক্রি করে ১১ বাহিনীর লোকজন। খড় বিক্রি করতে নিষেধ বা টাকা দাবি করলে বাহিনীর লোকজন মারধর করে। তাদের ভয়ে কেউ মুখ খোলে না।
আরেক জমির মালিক বাচ্চু বলেন, কোনো কোনো জমির মালিককে বাহিনী টাকা দেয় না। জমির মালিক জানের ভয়ে জমিতে যায় না। খড় কেনাবেচাকে কেন্দ্র করে চরে কোটি টাকা লেনদেন হয়। তাই প্রতি বছরই রক্ত ঝরে পদ্মার চরে।
খানপুর গ্রামের মিঠু সরদার বলেন, ২৭ অক্টোবর গোলাগুলির ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী তিনি। সেখানে খড় কাটা হচ্ছিল। একসঙ্গে কয়েকজন ছিলাম। হঠাৎ করে কাঁকন বাহিনী স্পিডবোট থেকেই অতর্কিত গুলি করতে শুরু করে। ওরা গুলি করছে, আমরা গুলির ভয়ে শুয়ে ছিলাম। তারা আটজন ছিল, কিছু না হলেও দুই ঘণ্টা গুলি করেছে। প্রথমে আমানের মাথায় গুলি লাগে। তাকে দেখে নাজমুল চিৎকার দিয়ে উঠে। এ সময় আমানকে ধরতে গিয়ে নাজমুলেরও গুলি লাগে। তাদের আটজনের হাতে অস্ত্র ছিল।
তিনি বলেন, আমরা তো সাধারণ লোক। আমরা মাঠ দেখতে গিয়েছি। এই মাঠে দেড়শ বিঘা জমি আছে। সেই জমির খড় জোর করে নিয়ে নেয় কাঁকন বাহিনীর লোকজন।
বাঘা উপজেলা কৃষি অফিসার শফিউল্লাহ সুলতান বলেন, কুষ্টিয়ার কাছাকাছি হবিরচরে প্রায় ১ হাজার বিঘা জমিতে ফসল ফলে। এই চরে আগে শুধু বাদাম হতো। বর্তমানে সেখানে ধান, গম, ভুট্টা, ডাল জাতীয় ফসল ফলে। কোনো কোনো চরে চাষাবাদ হয় না, শুধু পড়ে থাকে।
৮ নভেম্বর রাত ৮টা থেকে ৯ নভেম্বর দুপুর ১২টা পর্যন্ত পুলিশ, র্যাব ও এপিবিএনের ১ হাজার ২০০ জন সদস্য পদ্মার চরে ‘অপারেশন ফাস্ট লাইট’ অভিযান পরিচালনা করে। এ সময় ৬৭ জনকে অস্ত্র ও মাদকসহ গ্রেফতার করা হয়েছে। এর মধ্যে রাজশাহীর ১৪ জন, নাটোরের ২০ জন, পাবনার ২৪ জন এবং কুষ্টিয়ার ৯ জন রয়েছেন।
৯ নভেম্বর বিকালে রাজশাহী রেঞ্জের ডিআইজি মোহাম্মদ শাহজাহান বলেন, অভিযানে ৬৭ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। এ সময় ১০টি অস্ত্র, চার রাউন্ড গুলি, দুইটি গুলির খোসা, ২৪টি হাঁসুয়া, ৬টি ডেসার, ২টি ছোরা, ৪টি চাকু, ৩টি রামদা, ২টি চাইনিজ কুড়াল, ২০ বোতল ফেনসিডিল, ৫০ পিস ইয়াবা, ৮০০ গ্রাম গাঁজা, ৫টি মোটরসাইকেল ও একটি লোহার পাইপ উদ্ধার করা হয়েছে। চরাঞ্চলে শান্তি ফেরাতে এমন অভিযান অব্যাহত থাকবে।
