Logo
Logo
×

সারাদেশ

এড়িয়ে চলতেন বিচারকের স্ত্রী, ক্ষোভে হামলা চালায় লিমন

Icon

রাজশাহী ব্যুরো

প্রকাশ: ২৬ নভেম্বর ২০২৫, ০৬:২৭ পিএম

এড়িয়ে চলতেন বিচারকের স্ত্রী, ক্ষোভে হামলা চালায় লিমন

রাজশাহী মহানগর দায়রা জজ মোহাম্মদ আব্দুর রহমানের স্কুলপড়ুয়া ছেলে তওসিফ রহমান তৌসিফকে (১৫) হত্যা ও বিচারকের স্ত্রী তাসমিন নাহার লুসিকে ছুরিকাঘাতে হত্যাচেষ্টা মামলার আসামি লিমন মিয়া (৩৪) স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন।

আদালতে ফৌজদারি কার্যবিধির ১৬৪ ধারায় দেওয়া জবানবন্দিতে বলা হয়েছে- পূর্ব পরিচয়ের সূত্রে বিচারকের স্ত্রী তাসমিন নাহার লুসির কাছ থেকে লিমন নিজের অভাব-অনটনের কথা বলে মাঝে মধ্যেই টাকাপয়সা নিতেন। এই টাকাপয়সা নেওয়াটা নিয়মিত অভ্যাসে পরিণত হয়েছিল।

এদিকে গত কয়েক মাস ধরে বিচারকের স্ত্রী বিরক্ত হয়ে আসামি লিমন মিয়াকে এড়িয়ে চলছিলেন। এমনকি তার ফোন ধরাও বন্ধ করেছিলেন। এতে আসামি লিমন মিয়া মনে মনে খুবই ক্ষিপ্ত ছিলেন। ঘটনার দিন গত ১৩ নভেম্বর বিকালে তিনি একটা দফা-রফার মানসিকতা নিয়ে বিচারকের রাজশাহীর বাসভবনে গিয়েছিল।

বিচারকের স্ত্রী তাকে দেখে প্রথমে চলে যেতে বলেছিল; কিন্তু লিমন মিয়া যেতে অস্বীকার করলে বিচারকের স্ত্রী ঘরের দরজা বন্ধ করে ফোনে পুলিশ ডাকার চেষ্টা করেন। এতে আরও ক্ষিপ্ত হয়ে ঘরের দরজা ভেঙে লিমন মিয়া বিচারকের স্ত্রীর ওপর ধারাল ছুরি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েন। এ সময় মায়ের চিৎকার শুনে অন্য ঘরে থাকা ছেলে তওসিফ রহমান তৌসিফ মাকে বাঁচাতে গেলে আসামি লিমন মিয়া তাকেও ছুরিকাঘাত করে। এতেই বিচারকের ছেলে তৌসিফ নিহত হয় এবং বিচারকের স্ত্রী গুরুতর জখম হন।

ধস্তাধস্তির একপর্যায়ে নিজের ছুরিতেই দুই হাতের তালু কিছুটা কেটে যায় আসামির। যে ছুরির আঘাতে বিচারকের ছেলে নিহত হয়েছেন সেটি আসামি লিমন মিয়া সঙ্গে করে এনেছিল বলে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে বলেছেন। ঘটনার পর ছুরিটি বাসার জানালা দিয়ে বাইরে ফেলে দেন।

মঙ্গলবার বিকালে রাজশাহী মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট-২ এর বিচারক মামুনুর রশিদের আদালতে লিমন মিয়ার ঘটনার দায় স্বীকার করে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন। বিকাল ৩টায় শুরু হয়ে আসামির জবানবন্দি গ্রহণ করা হয় রাত ৮টা পর্যন্ত। আসামি লিমন মিয়া মোট পাঁচ ঘণ্টায় সাত পৃষ্ঠার স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি প্রদান করেন। ওই রাতেই তাকে রাজশাহী কেন্দ্রীয় কারাগারে পাঠানো হয়।

বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন আরএমপির রাজপাড়া থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) ও হত্যা মামলার তদন্ত কর্মকর্তা হাবিবুর রহমান।

মহানগর কোর্ট পুলিশ সূত্রেও আসামি লিমন মিয়ার স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি প্রদানের বিষয়টি নিশ্চিত হওয়া গেছে।

রাজশাহী মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালত ও পুলিশের সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো থেকে জানা গেছে, দ্বিতীয় দফা রিমান্ড শেষে গত মঙ্গলবার দুপুর আড়াইটায় বিচারকের ছেলে হত্যা মামলার আসামি লিমন মিয়াকে মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালত-২ এর বিচারক মামুনুর রশিদের খাস কামরায় হাজির করা হয়। এ সময় বিচারক স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি প্রদানের আগে আসামি লিমন মিয়াকে কিছু সময় ভাববার সময় দেন। সে নিজে থেকে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিতে চায় কিনা তাও আসামির কাছে জানতে চান বিচারক। আসামি নিজেই ঘটনার দায় স্বীকার করে আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিবেন বলার পর রাজশাহী মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট মামুনুর রশিদ জবানবন্দি রেকর্ড শুরু করেন।

সূত্রমতে, আসামি লিমন মিয়া জবানবন্দিতে আরও বলেন- ২০১৮ সালে সেনাবাহিনীর চাকরি চলে যাওয়ার পর কিছু সময় হতাশাগ্রস্ত ছিলেন তিনি। এ সময় মানসিক সমস্যা হয় তার। ফলে পরিবারের পরামর্শে সে গাইবান্ধা শহরে কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশনে ভর্তি হন। সেখানেই পরিচয় হয় বিচারকের স্ত্রীর সঙ্গে।

বিচারকের স্ত্রীর বাবার বাড়ি গাইবান্ধা শহরে। বিচারকের স্ত্রী তাসমিন নাহার লুসি গাইবান্ধা শহরের ঐতিহ্যবাহী ও বিত্তশালী হাক্কানি পরিবারের মেয়ে। নিজের চাকরি যাওয়ার পর অভাব-অনটন নিয়ে বিচারকের স্ত্রীকে জানালে তাকে আর্থিক সাহায্য করতেন বিচারকের স্ত্রী। গত কয়েক বছরে বিচারকের স্ত্রীর কাছ থেকে বিভিন্ন সময়ে  ও প্রয়োজনে আর্থিক সহায়তা পান লিমন মিয়া; কিন্তু গত কয়েক মাস ধরে তাকে এড়িয়ে চলা শুরু করেন। মাঝে মধ্যে ফোনে তাদের মধ্যে কথা বার্তা হতো। বিচারকের স্ত্রীর কাছে টাকাপয়সার আবদার করতেন।

এদিকে বিচারকের স্ত্রী সম্প্রতি সিলেটে যান মেয়ের বাসায়। লিমন মিয়া খবরটি নিশ্চিত হয়ে গত ৩ নভেম্বর সিলেটে যান। তার টাকার খুব প্রয়োজন হয়। আবারও বিচারকের স্ত্রীকে ফোন করে কিছু টাকার আবদার করেন। তবে তাকে টাকা দেওয়ার কথা বলে কৌশলে ডেকে মেয়ের বিশ্ববিদ্যালয়ের সহপাঠীদের সহায়তায় পুলিশ দিয়ে তাকে ধরিয়ে দেওয়া হয়।

জামিনে মুক্তি পেয়ে বিচারকের মেয়ের ফেসবুক ম্যাসেঞ্জারে বার্তা পাঠিয়ে দেখে নেওয়ার হুমকি দিয়েছিলেন লিমন। ফলে বিচারকের স্ত্রী গত ৬ নভেম্বর সিলেট মহানগর পুলিশের জালালাবাদ থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি করেন। এতে লিমন মিয়া আরও ক্ষিপ্ত হন। ফোনে তাকে হত্যার হুমকি দেন। বিচারকের স্ত্রী সিলেট থেকে রাজশাহীতে ফিরেছেন তথ্যটি কৌশল করে লিমন মিয়া বিচারকের মেয়ের কাছ থেকে নেন।

অন্যদিকে গত ১৩ নভেম্বর লিমন রাজশাহীতে পৌঁছান। আসামি লিমন মিয়া জবানবন্দিতে আরও বলেছেন, তিনি আগে থেকেই বিচারকের রাজশাহীর বাসাটি চিনতেন। কারণ আগে একবার এ বাসায় এসেছিল। বিচারকের ভাই পরিচয়ে ভবনের ফটক পার হয়ে লিমন যখন বাসায় প্রবেশ করেন, তখন তাকে দেখে বিচারকের স্ত্রী ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন। বসতে বলেই বিচারকের স্ত্রী ঘরের দরজা বন্ধ করে কাউকে ফোন করছিলেন।

লিমন মিয়া জবানবন্দিতে বলেন, আমি ধরেই নিয়েছিলাম বিচারকের স্ত্রী পুলিশ ডেকে আমাকে আবার ধরিয়ে দেবেন। আমি মাথা ঠিক রাখতে পারিনি। ব্যাগ থেকে চাকু বের করে ঘরের দরজায় লাথি মারতে থাকি। একপর্যায়ে দরজা ভেঙে ফেলি। ওই সময় বিচারকের স্ত্রী কাউকে আমার বিষয়ে কথা বলছিলেন। আমি চাকু দিয়ে তাকে শরীরের কয়েকটি জায়গায় এলোপাতাড়ি ছুরিকাঘাত করি। এ সময় মায়ের চিৎকার শুনে অন্য ঘর থেকে ছেলে তৌসিফ এসে আমার কাছ থেকে তার মাকে ছাড়িয়ে নেওয়ার চেষ্টা করে। আমি তাকেও ছুরি মারি ও তার এক পা কামড়ে ধরি। এ সময় তৌসিফ অজ্ঞান হয়ে মেঝেতে পড়ে যায়। বিচারকের স্ত্রীও অজ্ঞান হয়ে ফ্লোরে পড়ে যান। ধস্তাধস্তির সময় আমার দুই হাতের তালু  ছুরিতে কিছুটা কেটে যায়। আমিও ফ্লোরে শুয়ে পড়ি। লোকজন এসে আমাদের উদ্ধার করে হাসপাতালে নিয়ে যান। আমাকেও অপারেশন থিয়েটারে নেওয়া হয়। অপারেশন থিয়েটার থেকে বের হয়ে পুলিশসহ লোকজন বলাবলি করছিল জজ সাহেবের ছেলে মারা গেছে। তখন আমি জানতে পারি। পুলিশ আমাকে গ্রেফতার করার পর রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে। আমি তাদেরও একই কথা বলেছি।

কোর্ট পুলিশ সূত্রে আরও জানা গেছে, ঘটনার পর ১৪ নভেম্বর মহানগর দায়রা জজ মোহাম্মদ আব্দুর রহমান নিজে বাদী হয়ে লিমন মিয়াকে আসামি করে আরএমপির রাজপাড়া থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন। ওই দিনই বিচারকের পৈতৃক নিবাস জামালপুর জেলার সরিষাবাড়ীর রুদ্র বয়রা চকপাড়া গ্রামের পারিবারিক গোরস্থানে নিহত তৌসিফকে সমাধিস্থ করা হয়।

এদিকে গত ১৫ নভেম্বর লিমন মিয়াকে প্রথম দফায় পাঁচ দিন ও গত ২০ নভেম্বর দ্বিতীয়বার আদালতে হাজির করে আরও পাঁচ দিনের রিমান্ডে নেন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা। দ্বিতীয় দফা রিমান্ডের শেষ দিন ২৫ নভেম্বর লিমন মিয়া স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন।

জানা গেছে, আসামি লিমন মিয়া গাইবান্ধা জেলার ফুলছুড়ি থানার মদনেরপাড় গ্রামের সোলাইমান শহিদের ছেলে। সোলাইমান শহিদ ফুলছুড়ি উপজেলা বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক ও লিমন মিয়া ইউনিয়ন স্বেচ্ছাসেবক দলের যুগ্ম আহ্বায়ক।

মামলার তদন্ত কর্মকর্তা জানান, বিচারকের ছেলে হত্যা ও স্ত্রী হত্যাচেষ্টা মামলার দ্রুত সময়ে আদালতে চার্জশিট দেওয়া হবে।

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম