উদীচী ট্র্যাজেডি: ৩ মিনিট স্তব্ধ ছিল নেত্রকোনা শহর
নেত্রকোনা প্রতিনিধি
প্রকাশ: ০৮ ডিসেম্বর ২০২৫, ১০:১৮ পিএম
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
আজ ৮ ডিসেম্বর, নেত্রকোনা ট্র্যাজেডি দিবস। ২০০৫ সালের এই দিনে উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী নেত্রকোনা কার্যালয়ের সামনে আত্মঘাতী বোমা হামলা করে জঙ্গি সংগঠন জেএমবি। এতে নিহত হন আটজন।
নিহতদের স্মরণে সোমবার ১০টা ৪০ মিনিট থেকে ৩ মিনিট স্তব্ধ ছিল নেত্রকোনা শহর।
এ সময় শহরের রাস্তায় চলেনি কোনো যানবাহন, হাঁটেননি কোনো পথচারী। ঘড়ির কাঁটায় ১০টা ৪০ বাজার সঙ্গে সঙ্গেই সবাই নিজেদের কাজ ফেলে রাস্তায় নেমে আসেন। সড়কের যানবাহনগুলো চলাচল থামিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। দোকানিরাও এ সময় নেমে আসেন রাস্তায়। তারা শ্রদ্ধা জানান, ২০ বছর আগে নেত্রকোনা উদীচীতে বোমা হামলায় নিহত ব্যক্তিদের প্রতি। পাশাপাশি ঘৃণা জানানো হয় ধর্মান্ধ দেশদ্রোহী জঙ্গিগোষ্ঠীকে।
২০০৫ সালের এই দিনে উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী নেত্রকোনা সংসদ কার্যালয়ের সামনে আত্মঘাতী বোমা হামলা করে জঙ্গি সংগঠন জেএমবি। ওই বোমা হামলায় প্রাণ হারান- জেলা উদীচীর সাবেক সহ-সাধারণ সম্পাদক খাজা হায়দার হোসেন, সাংগঠনিক সম্পাদক সুদীপ্তা পাল শেলি, মোটরসাইকেল মেকানিকস যাদব দাস, পুলিশ কর্মকর্তার স্ত্রী রানী আক্তার, মাছ বিক্রেতা আফতাব উদ্দিন, শ্রমিক রইছ মিয়া, ভিক্ষুক জয়নাল ও আত্মঘাতী বোমা হামলাকারী আল বাকি মো. কাফিসহ আটজন। আহত হন অর্ধশতাধিক।
নিহতদের স্মরণে প্রতি বছর ৮ ডিসেম্বর শহরের বিভিন্ন সামাজিক-সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক সংগঠন নেত্রকোনা ট্র্যাজেডি দিবস পালন করে আসছে।
দিনটি উপলক্ষে সোমবার সকাল ৯টা ১০ মিনিটে কালো পতাকা উত্তোলন ও কালো ব্যাজ ধারণ, উদীচী ট্র্যাজেডি স্মৃতিস্তম্ভে পুষ্পস্তবক অর্পণ, স্মৃতিচারণ ও গণসংগীত হয়। সেখানে ‘মানব না এই বন্ধনে’, ‘তীর হারা এ ঢেউয়ের সাগর’, ‘কারা মোর ঘর ভেঙেছে’, ‘এ লড়াই বাঁচার লড়াই’, ‘প্রিয় ফুল খেলবার দিন নয় অদ্য’ ইত্যাদি গণসঙ্গীতের ফাঁকে ফাঁকে দিবস উদযাপন কমিটির আহ্বায়ক বীর মুক্তিযোদ্ধা হায়দার জাহান চৌধুরীর সভাপতিত্বে ও উদীচীর সাধারণ সম্পাদক মো. আলমগীরের পরিচালনায় বক্তব্য দেন- জেলা উদীচীর সাবেক সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা মোজাম্মেল হক, প্রবীণ সাংবাদিক শ্যামলেন্দু পাল, বোমা হামলায় আহত সংস্কৃতিকর্মী তুষার কান্তি রায়, জেলা উদীচীর সভাপতি মো. মোস্তাফিজুর রহমান খান, গবেষক আলী আহাম্মদ খান আইয়োব, জাতীয় রবীন্দ্র সংগীত সম্মেলন পরিষদ নেত্রকোনা শাখার সভাপতি পূরবী কুণ্ডু, কবি এনামূল হক পলাশ, নারী নেত্রী কোহিনূর বেগম, নারী প্রগতির কেন্দ্র ব্যবস্থাপক মৃণাল চক্রবর্তী প্রমুখ।
পরে ৩ মিনিট স্তব্ধ নেত্রকোনা পালন শেষে সন্ত্রাস, মৌলবাদ ও সাম্প্রদায়িকতা বিরোধী মানববন্ধন হয়। শেষে শহীদদের কবর জিয়ারত, শ্মশানের স্মৃতিফলকে পুষ্পস্তবক অর্পণ ও শহীদদের পরিবারের সঙ্গে সাক্ষাৎ করা হয়।
উদীচী সূত্রে জানা গেছে, ৯ ডিসেম্বর নেত্রকোনা হানাদারমুক্ত দিবস উপলক্ষে আজকের এই দিনে সকালে উদীচী কার্যালয়ের সামনে চলছিল উদীচীর মহড়ার প্রস্তুতি। এ সময় আত্মঘাতী বোমা হামলায় প্রাণ হারান আটজন। আহত হন অর্ধশতাধিক।
ওই ঘটনায় চলে নানা নাটকীয়তা। হামলায় নিহত যাদব দাসকে বানানো হয় ‘হিন্দু জঙ্গি’। চলে যাদবের পরিবারসহ সংখ্যালঘু সম্প্রদায় ও সংস্কৃতিকর্মীদের ওপর নানা হয়রানি। তারপর গণমাধ্যমকর্মী ও বিভিন্ন সাংস্কৃতিক ব্যক্তিরা প্রমাণ করেন যাদব জঙ্গি নন।
মামলা ও বর্তমান অবস্থা
ওই ঘটনায় পুলিশ বাদী হয়ে নেত্রকোনা মডেল থানায় দ্রুতবিচার ট্রাইব্যুনাল ও বিস্ফোরক আইনে পৃথক দুটি মামলা করে। এর মধ্যে বিস্ফোরক আইনে আসামি জেএমবির কমান্ডার সালাউদ্দিন ওরফে সালেহীন, শূরা সদস্য আসাদুজ্জামান চৌধুরী ওরফে পনিরের মৃত্যুদণ্ড দেন আদালত।
এছাড়া ২০০৮ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি আসামি আসাদুজ্জামান চৌধুরী, সালাউদ্দিন ও ইউনুছ আলীকে মৃত্যুদণ্ড দেন ঢাকার দ্রুতবিচার ট্রাইব্যুনাল-২। একই বছরের ২৩ মার্চ ঢাকার দ্রুতবিচার ট্রাইব্যুনাল-১ একই রায় প্রদান করেন। মামলার অপর আসামি সিদ্দিকুর রহমান বাংলা ভাই ও আতাউর রহমান সানির অন্য মামলায় ফাঁসি কার্যকর হওয়ায় তাদের অব্যাহতি দেওয়া হয়। এ ছাড়া বাংলা ভাইয়ের স্ত্রী ফারজানাকে খালাস দেওয়া হয়।
মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামিদের মধ্যে আসাদুজ্জামান চৌধুরী ওরফে পনিরের ২০২১ সালের ১৫ জুলাই রাতে গাজীপুরের কাশিমপুর হাই সিকিউরিটি কেন্দ্রীয় কারাগারে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হয়। আর সালাউদ্দিন ওরফে সালেহীনকে ২০১৪ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি ময়মনসিংহের ত্রিশালে প্রিজনভ্যানে হামলা চালিয়ে এক পুলিশ সদস্যকে হত্যা করে ছিনিয়ে নেওয়া হয়।
আজ সমাবেশ চলাকালে সংগঠনের সহ-সভাপতি মাসুদুর রহমান খান বলেন, ‘দ্রুতবিচার ও বিস্ফোরক মামলার রায় কার্যকর হওয়ায় আমরা খুশি। তবে জঙ্গিবাদের মূলোৎপাটন করতে হলে আরও শেকড়ে যেতে হবে। স্থানীয় মদদদাতাদের খুঁজে বের করতে হবে। তা না হলে মৌলবাদ, জঙ্গিবাদ ও সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাস নির্মূল সম্ভব হবে না।’
এদিকে ঘটনার ২০ বছর পার হলেও এখনও সেই স্মৃতি তাড়া করে বেড়ায় নিহতদের স্বজনদের। পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম খাজা হায়দার হোসেনকে হারিয়ে এখনো দিশেহারা তার স্ত্রী শাহানাজ পারভিন। স্বামীর রেখে যাওয়া এক চিলতে জায়গার ওপর একটি টিনের চালাঘরে একমাত্র ছেলেকে নিয়ে থাকেন তিনি। আর শহরের নিউটাউন এলাকায় ভাড়া বাসায় থাকেন সুদীপ্তা পাল শেলির পরিবার। একমাত্র উপার্জনক্ষম মেয়েকে হারানোর পর কষ্টে দিন পার করছেন মা অরুণা রাণী পাল।
