বেগম রোকেয়াকে মুরতাদ-কাফের আখ্যায় অনড় শিক্ষক, নীরব রাবি প্রশাসন
রাজশাহী ব্যুরো
প্রকাশ: ১০ ডিসেম্বর ২০২৫, ১০:৪১ পিএম
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
নারী জাগরণ ও নারী অধিকার আন্দোলনের অগ্রদূত মহীয়সী নারী ব্যক্তিত্ব বেগম রোকেয়াকে মুরতাদ ও কাফের বলে উল্লেখ করা রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থ বিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক খন্দকার মোহাম্মদ মাহমুদুল হাসান ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়লেও তিনি তার বক্তব্যে অনড় রয়েছেন।
গত ৯ ডিসেম্বর ছিল বেগম রোকেয়া দিবস। সমাজে নারীর ন্যায্য অধিকার প্রতিষ্ঠা, নারীর সামাজিক অধিকার ও সুবিচার নিশ্চিতকরণ ও মানবিক মর্যাদার সংগ্রামে বেগম রোকেয়া এক বিদ্রোহী অনুকরণীয় সত্ত্বার প্রতীক হয়ে আছেন বিশ্বজুড়ে। মহীয়সী এই নারীর অবদান স্মরণে প্রতি বছর ৯ ডিসেম্বর তার প্রয়াণ দিবসে রোকেয়া দিবস দেশে-বিদেশে মর্যাদার সঙ্গে পালিত হয়।
এদিকে মঙ্গলবার সকালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থ বিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক খন্দকার মোহাম্মদ মাহমুদুল হাসান তার ফেসবুকে আইডিতে সাজিদ হাসান নামের একজনের একটি পোস্ট শেয়ার করে লেখেন- ‘আজ মুরতাদ কাফের বেগম রোকেয়ার জন্মদিন।' পোস্টে তিনি বেগম রোকেয়ার একটি প্রতিকৃতিও যুক্ত করেন।
একদিন আগে করা রাবি শিক্ষকের ওই পোস্ট ঘিরে রাবি ক্যাম্পাস ছাড়াও সামাজিক মাধ্যমজুড়ে তীব্র আলোচনা-সমালোচনা অব্যাহত রয়েছে।
অন্যদিকে সমাজে নারী শিক্ষা ও অধিকার প্রতিষ্ঠার অগ্রদূত হিসেবে সারা বিশ্বে সমাদৃত ও প্রশংসিত একজন মহীয়সী নারীকে মুরতাদ ও কাফের বলার কারণে রাবি শিক্ষক মাহমুদুল হাসানের তীব্র সমালোচনা হলেও তিনি তার অবস্থান থেকে একটুও সরে আসেননি। এমনকি তিনি এ ধরনের বিতর্কিত ও ঘৃণামূলক বক্তব্য সামাজিক মাধ্যমে ছড়ালেও তাতে একটু অনুতপ্ত হননি বলে জানা গেছে।
মঙ্গলবার সন্ধ্যায় তিনি আরেকটি পোস্ট দেন ফেসবুকে। সেখানে তিনি তার আগের মন্তব্য ও মতামতকে বিশদে ব্যাখ্যার চেষ্টা করেন।
এদিকে নারী অধিকার রক্ষায় আজীবন সংগ্রামী একজন নারী ব্যক্তিত্ব সম্পর্কে বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষকের অমর্যাদাকর ও ঘৃণামূলক বক্তব্যের পরও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ, রাকসু, বিভিন্ন ছাত্র সংগঠনের নেতৃত্ব ছাড়াও শিক্ষকগণের নীরবতা নিয়েও আলোচনা সমালোচনাও হচ্ছে বিভিন্ন মাধ্যমে।
অনেকেই বলছেন, সময়টা এখন আপেক্ষিত মতাদর্শে বিশ্বাসী একটা বিশেষ শ্রেণি-গোষ্ঠীর নিয়ন্ত্রণে হলেও অতীতে বিভিন্ন জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা এমন পরিস্থিতিতে কখনই চুপ করে থাকেননি। এবার ব্যতিক্রম হিসেবে দেখা যাচ্ছে বেগম রোকেয়ার মতো নারী ব্যক্তিত্বের ক্ষেত্রে; যেখানে ধর্মীয় ভাবনায় তার বিরুদ্ধে ঘৃণা ছড়ানোর কাজটি হচ্ছে সেখানে শিক্ষক শিক্ষার্থীরা অনেকটা নীরব ভূমিকায় রয়েছেন- বলছিলেন নাম প্রকাশ না করার শর্তে রাবির একটি বিভাগের একজন প্রবীণ শিক্ষক।
অন্যদিকে বেগম রোকেয়াকে ‘কাফের-মুরতাদ’ আখ্যা দিয়ে সামাজিক মাধ্যম ফেসবুকে বিতর্কিত ও ঘৃণামূলক পোস্ট দিয়ে সমালোচনার মুখে পড়লেও খন্দকার মাহমুদুল হাসান নামের এই শিক্ষকের ভাবনায় কোনো হেরফের ঘটেনি। মঙ্গলবার সকালে বিতর্কিত পোস্ট দিয়ে তীব্র সমালোচনার মুখে পড়লেও এদিন সন্ধ্যা সাড়ে সাড়ে ৬টার দিকে আরেকটি পোস্ট দেন তিনি।
মঙ্গলবার সন্ধ্যায় তিনি নিজের ফেসবুক পোস্টে বেগম রোকেয়াকে উদ্দেশ্য করে লেখেন- ‘আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালার নাজিলকৃত কিতাব অস্বীকার করেছেন, মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের রিসালাত অস্বীকার করেছেন, তাকে প্রতারক বলেছেন, আল্লাহর নাজিলকৃত বিধান নিয়ে কটূক্তি করেছেন। এত কিছুর পরে কোনো মানুষের ইমান থাকতে পারে না। আমার বক্তব্য একটু ফতওয়ার মতো মনে হচ্ছে। ফতওয়া দেওয়ার অধিকার আলেমদের, আমার না। এই জায়গায় অনধিকার চর্চা করেছি বলতে পারেন। ইমান ভঙ্গের কারণ সম্পর্কে যার মোটামুটি ধারণা আছে, তিনি কখনই এমন কাউকে ইমানদার বলবেন না।’
তিনি সেখানে আরও লিখেছেন- ‘কী অদ্ভুত ব্যাপার, একজন মানুষ কিতাব অস্বীকার করল, রিসালাত অস্বীকার করল, রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে প্রতারক বলল, তার পক্ষে কিছু মানুষ এভাবে দাঁড়িয়ে যাচ্ছে। ভালোবাসা কার প্রতি? আল্লাহর রাসুলের প্রতি, নাকি তাকে (সা.) অস্বীকারকারীর প্রতি- প্রশ্ন তোলেন তিনি। শিক্ষক খন্দকার মাহমুদুল হাসানের পোষ্টে পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের এক শিক্ষার্থী বলেন, একই বিভাগের একজন শিক্ষক যখন কোনো ঐতিহাসিক ব্যক্তিত্বকে ঘৃণামূলক ভাষায় আক্রমণ করেন, তখন সেটা শুধু ব্যক্তিগত মতামত থাকে না, বরং শিক্ষার্থীদের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। একজন শিক্ষকের কাছ থেকে আমরা দায়িত্বশীল ও গ্রহণযোগ্য অনুকরণীয় আচরণ প্রত্যাশা করি। এমন বক্তব্য বিশ্ববিদ্যালয়ে মুক্ত পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর এবং এসব বন্ধ হওয়া উচিত।’
জেমস সরকার নামে সমাজ বিজ্ঞান বিভাগের একজন শিক্ষার্থী বলেন, একজন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক যখন কাউকে ‘কাফের’ বা ‘মুরতাদ’ বলেন, সেটা শুধু ব্যক্তিগত মত নয়; এটি ঘৃণামূলক বক্তব্য। এতে সমাজে অসহিষ্ণুতা বাড়ে এবং সহিংসতার ঝুঁকি তৈরি হয়। বিশ্ববিদ্যালয় একজন শিক্ষকের কাছ থেকে দায়িত্বশীল আচরণ প্রত্যাশা করে সবাই।
এর আগে মঙ্গলবার বিকালে পদার্থ বিজ্ঞানের সহযোগী অধ্যাপক খন্দকার মাহমুদুল হাসান বিভিন্ন গণমাধ্যমকে দেওয়া প্রতিক্রিয়ায় বলেন, আমি যে ক্যাপশন দিয়ে পোস্টটি শেয়ার করেছি সেই পোস্টটাতে বিস্তারিত বলা আছে। আপনারা যদি সেটা পড়ে থাকেন তাহলে বুঝতে পারবেন। আমার বক্তব্যের সত্যতা যাচাই করতে চাইলে ভালো কোনো আলেমের কাছে জানতে পারেন। কাউকে হেয় করার জন্য আমি মন্তব্যটি করিনি। এটি ছিল আমার ব্যক্তিগত মতামত।
এদিকে বেগম রোকেয়াকে নিয়ে রাবি শিক্ষকের এমন মন্তব্যে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক পরমা পারমিতা। তিনি বলেন, বেগম রোকেয়া ছিলেন উপমহাদেশের নারীশিক্ষা ও মানবিক মূল্যবোধের অন্যতম পথিকৃৎ। তিনি কখনই ধর্মবিদ্বেষী ছিলেন না; বরং অন্ধ কুসংস্কার, বৈষম্য ও অজ্ঞতার বিরুদ্ধে লড়াই করেছেন যা ইসলামসহ সব ধর্মই সমর্থন করে।
জানা গেছে, শিক্ষক খন্দকার মাহমুদুল হাসানের বিতর্কিত পোস্ট নিয়ে রাবি প্রশাসন অস্বস্তিতে পড়লেও এই শিক্ষকের বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না রহস্যজনক কারণে।
আরও জানা গেছে, রাবির বর্তমান উপাচার্য ড. সালেহ হাসান নকীব নিজেও পদার্থ বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক। এ বিষয়ে প্রতিক্রিয়া জানতে বুধবার একাধিকবার রাবি উপাচার্যের অফিশিয়াল মোবাইল ফোন নম্বরে কল দেওয়া হলেও তিনি ফোন ধরেননি।
বিকালে রাবির উপ-উপাচার্য (একাডেমিক) অধ্যাপক ফরিদ উদ্দিন খানের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি জানান, এ বিষয়ে রাবি কর্তৃপক্ষের কোনো সিদ্ধান্ত নেই। সুতরাং এ বিষয়ে তিনি অফিসিয়ালি কোনো মন্তব্য করবেন না।
মতামত জানার জন্য বুধবার সন্ধ্যায় সহযোগী অধ্যাপক খন্দকার মুহাম্মদ মাহমুদুল হাসানের মোবাইল ফোন নম্বরে কল করা হলে তিনি রিসিভ করেননি। ফলে এ বিষয়টি সম্পর্কে তার সর্বশেষ কোনো মতামত পাওয়া যায়নি।
