উপকূলে হারিয়ে যাওয়া শৈশব, কন্যা শিশুর বিয়ে
শিপু ফরাজি, চরফ্যাশন (ভোলা)
প্রকাশ: ২১ ডিসেম্বর ২০২৫, ০৯:১৪ পিএম
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
ভোরের আলো ফুটেছে মাত্র। মেঘনার পাড়ে ভোলার চরফ্যাশন উপজেলার সামরাজ মাছঘাটে ঢেউয়ের শব্দে মিশে আছে চায়ের কাপে চুমুকের টুংটাং আওয়াজ। ঘাটের পাশে এক কোণে বসে আছে নয়ন নামের বারো-তেরো বছরের এক কিশোর। পরনে জিন্সের প্যান্ট, আধাভেজা ময়লা টি-শার্টে তার মুখে ক্লান্তির ছাপ। চায়ের কাপে পাউরুটি ভিজিয়ে খাচ্ছে সে। কাছে গিয়ে কথা বলতেই জানায়, তার স্কুলে পড়ার খুব ইচ্ছা ছিল; কিন্তু টাকার অভাবে সেটা হয়ে ওঠেনি। এখন বই-খাতার বদলে তার হাতে উঠেছে জালের দড়ি আর নৌকার বৈঠা।
নয়নের গল্পটা চরফ্যাশনের শত শত শিশুর জীবনেরই প্রতিচ্ছবি। উপকূলীয় এ অঞ্চলের শিশুদের একটা বড় অংশ স্কুলের ক্লাশরুমে নয়, জীবনযুদ্ধে উত্তাল নদীতে পড়েছে।
শৈশব থেকে জালের ফাঁদে
মেঘনা-তেঁতুলিয়া নদীর পাড় ঘেঁষে থাকা চরগুলোতে ঘুরলে দেখা মেলে, ছোট ছোট বালকদের কাঁধে বৈঠা। কারো হাতে মাছ ধরার জাল, কারো হাতে বালতি। এদের কেউ ক্লাশ থ্রি, কেউ বা ফোর পর্যন্ত পড়েছিল; কিন্তু দরিদ্রের নদীতে ডুবে গেছে তাদের পড়ার খাতা।
উপজেলার মুজিবনগরের জেলে ছোবহান মিয়া জানালেন, ছেলেমেয়েদের স্কুলে পাঠাতে ইচ্ছে করে, কিন্তু পেটে ভাত না থাকলে স্কুলে যাবে কী করে? নদীতে মাছ নেই, সারা দিন পরিশ্রম করেও ৫০০ টাকা ভাগে পড়ে না। সংসার চালানোতো দূরের কথা, কিস্তির টাকাও জোটে না। তাই বাধ্য হয়েই সন্তানদের নিয়ে যেতে হয় মাছ ধরতে।
দরিদ্রতার এই ঘূর্ণিতে পড়েই শিশুরা ঝুঁকিপূর্ণ শ্রমে নামছে। জেলে শিশুরা নৌকায় জাল টানা, মাছ বাছাই, প্রক্রিয়াজাতকরণ- সব কাজ করে। এর মধ্যেই কোনো শিশু কখনো নদীতে পড়ে যায়, কেউ অসুস্থ হয়, কেউ আবার প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার আগেই পেশাদার জেলে হয়ে যায়।
রাসেলদের অসম জীবন
চর কচ্ছপিয়ার বেড়িবাঁধে থাকে রাসেল। সকালে স্কুলে যায়, বিকালেই আবার বৈঠা হাতে নদীতে। তার বাবা চায় ছেলে যেন লেখাপড়া শিখে বড় হয়, কিন্তু অভাব তাকে সেই সুযোগ দেয়নি। রাসেল জানায়, স্কুলে যেতে ভালো লাগে, কিন্তু না গেলে মা-বাবা খাওয়ায় না। তাই মাছ ধরতেই হয়।
একই অবস্থা চরমানিকা, চর কুকরীমুকরী, আসলামপুরের শিশু রাসেল, সুমন, রিয়াজ, মিঠুনের মতো হাজারও শিশুর। এদের স্কুলের খাতায় নাম থাকলেও, ক্লাশে উপস্থিতি কম। দুপুরে বই নয়, হাতে থাকে মাছভর্তি ঝুড়ি।
নদীর বুকে শিশুরা
সামরাজ ঘাটে কথা হয় জেলে আরিফ (১৪) আর মোস্তফার (১২) সঙ্গে। আরিফ জানায়, ক্লাশ থ্রিতে পড়তাম, একদিন বাপ বলল, আর পড়া লাগবে না, নৌকায় যাও। তারপরে নদীতে। এখন সে অন্যের নৌকায় কাজ করে। মোস্তফা জানায়, চার বছর ধরে ভাইয়ের সঙ্গে নদীতে যাই। স্কুলে ভর্তি হয়েছিলাম, কিন্তু যাওয়া বন্ধ হয়ে গেছে। এখন মাছ ধরে দিন চলে।
মোস্তফার মা রাহিমা বেগম কাঁদতে কাঁদতে বলেন, ছেলেকে স্কুলে দিতে চেয়েছিলাম, কিন্তু সংসারে অভাব। বৃদ্ধ স্বামী কাজ করতে পারে না। বাধ্য হয়েই নদীতে পাঠাই।
নৃশংস বাস্তবতা
চরফ্যাশনের নতুন স্লুইজ এলাকায় প্রায় ২৫০টি ট্রলার রয়েছে, প্রতিটিতেই দুই-তিনজন করে শিশু জেলে। উপজেলা জুড়ে এমন ২৮টি মাছঘাটে প্রতিদিন হাজারো শিশু জীবনঝুঁকি নিয়ে মাছ ধরে। স্থানীয় জেলে সিদ্দিক মিয়া বলেন, আমরা গরিব মানুষ, সন্তানরা নদীতে না গেলে সংসার চলে না। মাছ না পেলে ক্ষুধায় থাকতে হয়।
একই কথা বলেন ট্রলার মালিক কবির হোসেনও— অভাবের তাড়নায় শিশুরা নৌকায় কাজ করে। কেউ জাল টানে, কেউ বাবুর্চির কাজ করে। নদীতে ঝুঁকি আছে, কিন্তু না গেলে খাওয়া জোটে না।
সরকারি হিসাবে চরফ্যাশনের প্রায় ৮০ শতাংশ মানুষ মৎস্য পেশায় যুক্ত। উপজেলার নিবন্ধিত জেলে ৪৪ হাজারের বেশি, অনিবন্ধিত আরও প্রায় ৪৬ হাজার। তাদের নৌকা-ট্রলারে কাজ করা শিশু জেলের সংখ্যা অন্তত ১০ হাজার। বেসরকারি হিসাবে এই সংখ্যা ৫০ হাজার ছাড়িয়েছে। পেটের দায়ে শিশুরা মাত্র ৫-১০ হাজার টাকায় ‘দাদনে’ বিক্রি হয়ে যায় ট্রলার মালিকদের কাছে।
কন্যাশিশুরা আরও অবহেলিত
চরফ্যাশনের চরাঞ্চলে কন্যা সন্তান মানেই যেন বোঝা। অধিকাংশ পরিবারে মেয়েদের ১২-১৪ বছর বয়সেই বিয়ে দেওয়া হয়। ছোটবেলার খেলার স্বপ্ন, স্কুলের বারান্দা—সব পেছনে ফেলে তারা নামছে সংসারের চক্করে।
চর মাদ্রাজের রিপা আক্তার (১৪) জানায়, স্কুলে যেতে ইচ্ছা করে, কিন্তু বাবা বলল মেয়ে বড় হয়েছে, বিয়ে দিতে হবে।
১৪ বছর বয়সেই মা হয়েছে জাকিয়া। এখন চার মাসের শিশুকে কোলে নিয়ে সংসার সামলায় সে। জানে না শিশু অধিকার কী, জানে শুধু—'খেয়ে বাঁচলেই শান্তি।'
আইন আছে, বাস্তবতা আলাদা
বাংলাদেশ ১৯৮৯ সালে জাতিসংঘের শিশু অধিকার সনদে স্বাক্ষর করে। এরপর শিশু আইন ২০১৩ ও শিশুশ্রম নিরোধ নীতিমালা ২০১০ প্রণয়ন করা হয়। কিন্তু এসব আইন চরফ্যাশনের নদী তীরে পৌঁছায়নি। শিক্ষা অধিদপ্তরের তথ্যমতে, উপজেলার ২১টি ইউনিয়নে প্রাথমিক পর্যায়ের শিক্ষার্থী ৬২ হাজারের বেশি, এর ৩০-৪০ শতাংশ উপকূলীয় এলাকার; কিন্তু স্কুলের হাজিরা খাতায় নাম থাকলেও তারা নদীতে জাল ফেলছে।
আশার আলো
চরফ্যাশন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা লোকমান হোসেন বলেন, শিশুদের স্কুলমুখী করতে বিভিন্ন দপ্তর ও সংস্থাকে নিয়ে কাজ করছি। আশা করছি, শিগগিরই শিশুশ্রম বন্ধ হবে।
তিনি আরও বলেন, কন্যা শিশুরাও শিক্ষিত হলে সমাজের উন্নয়নে বড় ভূমিকা রাখতে পারে। এজন্য দরকার সচেতনতা ও সহায়তা।
নদীর পাড়ে দাঁড়িয়ে নয়নের দিকে তাকিয়ে মনে হয়, তার বয়স যতই ছোট হোক, দায়িত্বের বোঝা বহন করছে এক পরিণত মানুষের মতো। বইয়ের পাতায় নয়, নদীর ঢেউয়েই সে পড়ছে জীবনের কঠিন পাঠ।
