একজন মুক্তিযোদ্ধার অসহায় আর্তনাদ!
মুহসিন আল জাবির, হাতিয়া (নোয়াখালী)
প্রকাশ: ২২ ডিসেম্বর ২০২৫, ০৬:৪৯ পিএম
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
এক সময় যে মানুষটি বুক চিতিয়ে দাঁড়িয়েছিলেন দেশের স্বাধীনতার জন্য, যার কাঁধে ছিল যুদ্ধের ভার, চোখে ছিল একটি মুক্ত দেশের স্বপ্ন—আজ সেই মানুষটির বুক ভারি শুধু দীর্ঘশ্বাসে। চোখে আর স্বপ্ন নেই, আছে অশ্রু।
যে হাতে একদিন অস্ত্র তুলে নিয়েছিলেন দেশের জন্য, আজ সেই হাত কাঁপছে অসহায়ত্বে। এই কাঁপুনি বয়সের ভারে নয়, এই কাঁপুনি জন্মেছে নিজের সন্তানের দেওয়া অবর্ণনীয় কষ্ট থেকে।
জীবনের শেষপ্রান্তে এসে এক বীর মুক্তিযোদ্ধা আজ দাঁড়িয়ে আছেন এমন এক নিষ্ঠুর বাস্তবতার সামনে, যেখানে কোনো যুদ্ধক্ষেত্র নেই, নেই শত্রু সেনা—আছে শুধু নিজের ঘরের মানুষ, নিজের সন্তান। এই যুদ্ধে কোনো বিজয়ের গান নেই, নেই সম্মানের পদক—আছে নিঃসঙ্গতা, অপমান, ভয় আর না বলা কান্না।
নোয়াখালীর দ্বীপ উপজেলা হাতিয়ার সোনাদিয়া ইউনিয়নের চর ফকিরা গ্রামের বাসিন্দা আব্দুল মন্নান। তিনি একজন গর্বিত বীর মুক্তিযোদ্ধা। জীবনের সোনালি সময় কেটেছে দেশের সেবায়। পাঁচ সন্তানের জনক এই মানুষটি আজ সবচেয়ে অসহায় নিজের ঘরের ভেতরেই।
তার অভিযোগ, নিজের ছেলে রায়হান ও পুত্রবধূ দীর্ঘদিন ধরে তাকে শারীরিক ও মানসিকভাবে নির্যাতন করে আসছেন। বয়সের ভারে যখন তার শরীর দুর্বল, তখন সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন ছিল সন্তানের ভালোবাসা আর যত্ন—কিন্তু ভাগ্যে জুটেছে অবহেলা আর অত্যাচার।
তিনি জানান, নির্যাতনের শুরুটা ছিল ধীরে। কথা দিয়ে অপমান, চোখ রাঙানি, হুমকি। এরপর ধীরে ধীরে তা রূপ নেয় মানসিক চাপ আর শারীরিক নিপীড়নে। সম্পত্তি নিয়ে বিরোধ, অন্যের কুমন্ত্রণা আর লোভ যেন ছেলের হৃদয় থেকে বাবার প্রতি সব মমত্ববোধ মুছে দিয়েছে। নিজের রক্তের সম্পর্কই আজ তার কাছে সবচেয়ে বড় আতঙ্ক হয়ে দাঁড়িয়েছে।
তিনি আরও জানান, একজন বাবা হিসেবে তিনি সব সহ্য করেছেন। সন্তানের ভবিষ্যৎ, সমাজে সম্মান, পরিবারের কথা ভেবে মুখ বুজে থেকেছেন। দিনের পর দিন, মাসের পর মাস নিজের কষ্ট নিজের মধ্যেই চেপে রেখেছেন; কিন্তু কষ্ট যখন আর সহ্যের সীমায় থাকে না, যখন নিজের ঘরেই নিরাপত্তাহীনতা তৈরি হয়, তখন আর নীরব থাকা সম্ভব হয় না।
আব্দুল মন্নান জানান, ন্যায়ের আশায় তিনি বহুবার স্থানীয়ভাবে বিচার চেয়েছেন। গ্রামের প্রভাবশালী, স্থানীয় মাতব্বর, জনপ্রতিনিধিদের দ্বারে দ্বারে ঘুরেছেন; কিন্তু কোথাও যেন তার মুক্তিযোদ্ধা পরিচয়টিও তাকে রক্ষা করতে পারেনি। প্রতিবারই ফিরে এসেছেন হতাশ হয়ে, বুকভরা দীর্ঘশ্বাস নিয়ে। শেষপর্যন্ত ভেঙে পড়া শরীর আর ক্ষতবিক্ষত মন নিয়ে তিনি হাজির হন সোনাদিয়া ইউনিয়ন পরিষদে।
সংবাদ সম্মেলনের মাইকের সামনে দাঁড়িয়ে কথা বলতে গিয়ে বারবার থমকে যাচ্ছিলেন আব্দুল মন্নান। গলা ধরে আসছিল। চোখে জমে উঠছিল জল। শব্দ যেন আর বের হতে চাইছিল না। সন্তানের হাতে নির্যাতিত হওয়ার বেদনা প্রকাশ করাই যেন তার জীবনের সবচেয়ে কঠিন যুদ্ধ হয়ে দাঁড়ায়।
কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে তিনি বলেন, এই বয়সে আমার আর কোনো চাওয়ার নেই। আমি টাকা চাই না, সম্পত্তি চাই না। শুধু একটু শান্তিতে বাঁচতে চেয়েছিলাম। একটু সম্মান নিয়ে শেষ দিনগুলো কাটাতে চেয়েছিলাম; কিন্তু সম্পত্তির লোভ আর মানুষের কুমন্ত্রণায় আমারই ছেলে আজ আমার শত্রু হয়ে গেছে। দেশের জন্য জীবন বাজি রেখেছিলাম, অথচ আজ নিজের ঘরেই আমি নিরাপদ নই।
এ কথাগুলো বলতে বলতে তার চোখ বেয়ে অশ্রু ঝরতে থাকে। উপস্থিত অনেকের চোখও ভিজে ওঠে। একজন বাবার কান্না, একজন মুক্তিযোদ্ধার অসহায় আর্তনাদ—এই দৃশ্য যেন মুহূর্তেই নাড়া দেয় উপস্থিত সবার হৃদয়। কেউ কেউ নীরবে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকেন, কেউ চোখ মুছতে থাকেন বারবার।
তিনি আরও জানান, দীর্ঘদিন ধরে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের শিকার হলেও সন্তানের মুখের দিকে তাকিয়ে তিনি এতদিন সব সহ্য করে গেছেন। সমাজ কী বলবে, মানুষ কী ভাববে—এই ভয়ে তিনি নীরব ছিলেন; কিন্তু যখন কষ্ট সহ্যের সীমা ছাড়িয়ে গেছে, তখন বাধ্য হয়েই তিনি সমাজ ও প্রশাসনের কাছে সাহায্যের হাত বাড়িয়েছেন।
এ ঘটনা শুধু একটি পরিবারের ভেতরের সংকট নয়—এটি আমাদের সমাজের জন্য এক ভয়ংকর সতর্কবার্তা। যে মানুষটি দেশের স্বাধীনতার জন্য নিজের জীবন উৎসর্গ করতে প্রস্তুত ছিলেন, যিনি আমাদের লাল-সবুজ পতাকা উপহার দিয়েছেন—আজ তার জীবনের শেষ সময়ে কেন তাকে এভাবে অপমানিত ও অবহেলিত হতে হবে? মুক্তিযোদ্ধার সম্মান কি কেবল বইয়ের পাতায় আর অনুষ্ঠানের মঞ্চেই সীমাবদ্ধ থাকবে?
এ ঘটনায় এলাকাবাসী ও সচেতন মহল গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। তারা অবিলম্বে প্রশাসনের কার্যকর হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন এবং বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল মন্নানের নিরাপত্তা, মর্যাদা ও ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার জোর দাবি জানিয়েছেন।
একটি স্বাধীন দেশের স্বাধীন নাগরিক হয়েও আজ একজন বীর মুক্তিযোদ্ধার চাওয়া খুবই সামান্য। তিনি আর কিছু চান না— শুধু এই কথাটুকুই বলেন, আমাকে একটু শান্তিতে বাঁচতে দিন।
