ভালুকার চাঞ্চল্যকর দিপু হত্যা, সেদিন যা ঘটেছিল
গ্রেফতার ব্যক্তিরা ৩ দিনের রিমান্ডে
ভালুকা (ময়মনসিংহ) প্রতিনিধি
প্রকাশ: ২২ ডিসেম্বর ২০২৫, ০৭:৪৯ পিএম
স্ত্রী ও সন্তানসহ দিপু চন্দ্র দাস। ফাইল ছবি
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
ময়মনসিংহের ভালুকায় হজরত মুহাম্মদ (সা.)-কে নিয়ে কটূক্তির অভিযোগে হিন্দু যুবক দিপু চন্দ্র দাসকে গণপিটুনিতে হত্যার ঘটনা কেন্দ্র করে ফেসবুক ও বিভিন্ন গণমাধ্যমে বিভ্রান্তিমূলক তথ্য ছড়ানোর অভিযোগ উঠেছে।
ঘটনার সময় দিপুর সঙ্গে চার সহকর্মীর কী ধরনের কথা হয়েছে তার একটি অডিও বক্তব্য পাওয়া গেছে। দিপুর পরিবারের দাবি, সে এমন কথা বলতে পারে না। তাকে পরিকল্পিত ও নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়েছে।
নিহত দিপু তারাকান্দা উপজেলার বানিহালা ইউনিয়নের মোকামিয়াকান্দা গ্রামের রবি চন্দ্র দাসের ছেলে।
এ ঘটনায় তার ভাই বাদী হয়ে অজ্ঞাতপরিচয় ১৫০ জনকে আসামি করে হত্যা মামলা করেছেন। মামলাটি তদন্ত করছে ডিবি। এ ঘটনায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ১২ জনকে গ্রেফতার করেছে। পাঁচ দিনের রিমান্ড আবেদন করলে শুনানি শেষে আদালত প্রত্যেকের তিন দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন।
সোমবার (২২ ডিসেম্বর) সকালে ময়মনসিংহ পুলিশ সুপার কারখানা পরিদর্শন করেছেন।
ঘটনাটি ঘটেছিল উপজেলার হবিরবাড়ি ইউনিয়নের ৫নং ওয়ার্ড জামিরদিয়া ডুবালিয়াপাড়া এলাকার বাদশাহ গ্রুপের একটি অঙ্গ প্রতিষ্ঠান পাইওনিয়ার নিটওয়্যারস (বিডি) লিমিটেডের ম্যান্ডিং সেকশনে।
ঘটনার দিন ১৮ ডিসেম্বর বৃহস্পতিবার বিকাল আনুমানিক ৪টার সময় ম্যান্ডিং সেকশনের তিন নারী শ্রমিক হ্যাপি, রহিমা ও কুলসুমের মাঝে কথা হচ্ছিল; পাশেই দাঁড়ানো ছিল ওই বিভাগের কোয়ালিটি ইন্সপেক্টর দিপু চন্দ্র দাস ও সেলিম মিয়া।
কারখানার ম্যান্ডিং অপারেটর রহিমা খাতুন বলেন, ‘আমি হ্যাপিকে উদ্দেশ করে বলেছি আজকে কী বার? হ্যাপি বলছে আজকে বৃহস্পতিবার গোনাহ মাপের দিন। সারা সপ্তাহে যে গোনাহ করেছে আল্লাহর কাছে মাফ চাইলে আল্লাহ মাফ করে দিবেন। এ সময় দিপু বলতেছে এটা কোন হাদিসে আছে? কোন শরীয়তে আছে? তখন সেলিম বলেন- তুমি আমাদের ইসলাম সম্পর্কে কী জান? তোমার কাছে বলতে হবে? দিপু বলেন- এটা কুসংস্কার। তোমাদের নবীজিও তো নয় বছরের শিশুকে ধর্ষণ করে বিয়ে করেছে।
অপারেটর সেলিম বলেন, ‘দিপু দাদা বলেছেন- এগুলো কোন হাদিসে পেয়েছেন? এগুলো কুসংস্কার। আমি তাকে বললাম তুমি আমাদের ধর্মের কে? তুমি মুসলমান? না তুমি আলেম-ওলামা; তুমি এসবের কী বুঝ? তোমাদের ধর্মেও তো আছে ১২ মাসে ১৩ পূজা। আমাদের মাঝেও অনেক কুসংস্কার আছে। এ কথা বলার সঙ্গে সঙ্গেই তিনি বলেন, তোমাদের মাঝেও অনেক কুসংস্কার রয়েছে। তখন আমি বললাম আমাদের মাঝে কী কুসংস্কার আছে? তখন তিনি আবারও বলেন- তোমাদের নবীজি ৯ বছরের শিশু ধর্ষণ করে বিয়ে করেছেন। দাদা তুমি এটা কি বললা? এসব উলটা পালটা বলো না। তুমি এখান থেকে চলে যাও। তখন দিপু দাদা বলেন- এখন কেমন লাগে, এখন কেমন লাগে। পরে আমি নামাজে চলে যাই। পেছন থেকে ফ্লোরে উত্তেজনা সৃষ্টি হয়ে গেছে। এক সময় পুরো কারখানার মাঝে এ কথা ছড়িয়ে যায়। উত্তেজনা সৃষ্টি হলে আমাদের পিএম আলমগীর স্যার দাদাকে কোয়ালিটি সেকশন থেকে অ্যাডমিন বিভাগে নিয়ে যান। কারখানার ভেতরে দিপুর ওপর কেউ হামলা করেনি।’
কোম্পানির সিনিয়র কমপ্লেক্স ম্যানেজার উদয় হোসেন জানান, বিভিন্ন গণমাধ্যমে বেশ কিছু বিভ্রান্তিমূলক তথ্য প্রকাশ করা হচ্ছে। দিপু এক বছর দুই মাস পূর্বে আমাদের কোম্পানির লিংকিংয়ের ম্যান্ডিং সেকশনে জুনিয়র কোয়ালিটি ইন্সপেক্টর হিসেবে নিয়োগ পেয়ে অদ্যাবধি কর্মরত ছিলেন। তার সঙ্গে কেউ প্রতিদ্বন্দ্বী ছিল না ও তিনি শ্রমিকদের নেতাও ছিলেন না। অনেক গণমাধ্যমে তাকে শ্রমিকদের নেতা হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে; যা মোটেও সত্য নয়। ওই সেকশনের নির্বাচিত প্রতিনিধি হলেন সম্রাট মিয়া।
তিনি জানান, ঘটনার পর রাত ৮টা ২০ মিনিটের দিকে একজন এসআই ৩ জন পুলিশ নিয়ে কারখানায় এলে উত্তেজিত জনতার চাপের মুখে তিনি কিছুই করতে পারেননি। উত্তেজিত জনতা এতই ক্ষুব্ধ ছিলেন- থানা, শিল্প পুলিশ ও সেনাবাহিনী এসেও দিপুর লাশ উদ্ধার করতে বেগ পেতে হয়। সর্বশেষ রাত ১১টা ৪০ মিনিটে লাশ উদ্ধার করে থানায় নিয়ে আসা হয়। মিলের শ্রমিকদের নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য ঘটনার পর দিপুকে অফিস কক্ষে ডেকে এনে অব্যাহিতপত্র নেওয়ার ঘোষণা দেওয়ার পরও তারা নিভৃত হয়নি। ভেতরে শ্রমিকরা উত্তেজিত, বাইরে উত্তেজিত জনতা যখন কারখানার গেট ভেঙে ভেতরে প্রবেশের চেষ্টা করছে- কারখানা রক্ষা করতে গিয়ে বাধ্য হয়ে নিরাপত্তা কর্মীরা দিপুকে রাত ৮টার দিকে বাইরে বের করে দেন। সাধারণত বিকাল ৫-৭টার পর বিভিন্ন মিল কারখানাগুলো ছুটি হয়।
ফেসবুকের পোস্ট ও প্রোপাগান্ডায় মিল গেটের সমানে শত শত উত্তেজিত জনতা জড়ো হয়ে যান। এ সময় পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। তৃতীয়পক্ষ ঘটনাটি রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহারে অপচেষ্টায় লিপ্ত।
কোম্পানির সিসিটিভি ভিডিও ফুটেজ থেকে দেখা যায়, উত্তেজিত জনতা কারখানার প্রধান ফটকের বাইরে থেকে ভেতরে প্রবেশের চেষ্টা করছেন। বেশ কিছু সময় পর নিরাপত্তা কর্মীরা একপর্যায়ে কারখানার পকেট গেটটি খুলে দিপু চন্দ্র দাসকে উত্তেজিত জনতার হাতে তুলে দেন। উত্তেজিত জনতা তাকে গণপিটুনি দিয়ে নৃশংসভাবে হত্যা করেন। বিবস্ত্র করে গলায় রশি বেঁধে ডুবালিয়াপাড়া থেকে টেনেহিঁচড়ে প্রায় ২ কিলোমিটার দূরে জামিরদিয়া মাস্টারবাড়ি এলাকায় ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কে নিয়ে আসেন। পরে মহাসড়ক বিভাজনের মাঝখানের একটি গাছে ঝুলিয়ে মরদেহে লাঠি দিয়ে গণহারে পিটিয়ে একপর্যায়ে আগুন ধরিয়ে স্লোগান দেন।
ঘটনার পর থেকেই আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ঘটনাস্থলের আশপাশ ও বিভিন্ন এলাকায় সাঁড়াশি অভিযান পরিচালনা করে। গ্রেফতার আতঙ্কে অনেকেই এ বিষয়ে কথা না বলে এড়িয়ে যান।
দিপু চন্দ্র দাসকে গণপিটুনিতে হত্যায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা ১২ জনকে গ্রেফতার করেছে। এরা হলেন- পাইওনিয়ার নিটওয়্যারস (বিডি) লিমিটেডের ম্যানেজার তারেক হোসেন (১৯), ফ্লোর ইনচার্জ আলমগীর হোসেন (৩৮), কোয়ালিটি ইনচার্জ মিরাজ হোসেন আকন্দ (৪৬), লিমন সরকার (১৯), মানিক মিয়া (২০), এরশাদ আলী (৩৯), নিঝুম উদ্দিন (২০), স্থানীয় মসজিদের ইমাম আজমল হাসান ছগির (২৬), শাহীন মিয়া (১৯), নাজমুল হোসেন (২১), স্থানীয় একটি কিন্ডার গার্টেনের শিক্ষক কাইয়ুম মিয়া (২৫) ও আশিকুর রহমান (২৫)।
সোমবার (২২ ডিসেম্বর) দুপুরে কড়া নিরাপত্তায় ময়মনসিংহ কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে আসামিদের আদালতে হাজির করা হয়। মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা প্রত্যেকের পাঁচ দিনের রিমান্ড আবেদন করলে শুনানি শেষে সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের বিচারক শাহাদাত হোসেন প্রত্যেকের তিন দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন।
দিপুর বাবা রবি চন্দ্র দাস বলেন, ‘ছেলেকে মেরে রাস্তায় ফেলে রাখা হয়। আমার ছেলে এমন কোনো কাজ (ধর্ম অবমাননা) করতে পারে না। এর তদন্ত করে বিচার চাই, হত্যাকারীদের শাস্তি চাই।’
দিপুর স্ত্রী মেঘলা রাণী দাসের দাবি, তার স্বামীকে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয়েছে। আমার স্বামী পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি ছিলেন। আমার দুই বছরের মেয়েকে নিয়ে কিভাবে আমার সংসার চলবে। চোখে সব অন্ধকার দেখছি।
বাদশাহ গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. বাদশাহ মিয়া বলেন, আমি নিজে ৮শ মিলিয়ন ডলারের অধিক গার্মেন্টসের কাপড় রপ্তানি করি। আমি কি চাইব আমার কোম্পানিতে মবের সৃষ্টি হোক। এ ঘটনার পর বাইয়ারদের কাছে জবাবদিহি করতে হচ্ছে। আমি একজন শ্রমিকবান্ধব মালিক। সময় পেলেই ফ্লোরে গিয়ে শ্রমিকদের সঙ্গে সরাসরি কথা বলি, তাদের পরিবারের খোঁজখবর নেই। আমার কোম্পানির পক্ষ থেকে দিপু এবং তার পরিবারকে সহযোগিতা করব। দিপুকে কারখানার বাইরে হত্যা করা হয়েছে। আমার কারখানার ভেতর ও বাইরের সিসি টিভি ফুটেজ দেখলেই প্রমাণ পাওয়া যাবে। আমি এ ঘটনার দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করছি। যারা এর সঙ্গে জড়িত তাদের সবাইকে আইনের আওতায় এনে বিচারের সম্মুখীন করার দাবি জানাচ্ছি।
ভালুকা মডেল থানার অফিসার ইনচার্জ জাহিদুল ইসলাম জানান, মামলাটি গত রাতে ডিবি পুলিশের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। এ পর্যন্ত ১২ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। তাদের মাঝে একজন স্থানীয় বাকিরা দেশের বিভিন্ন স্থানের অধিবাসী। তাদের সঙ্গে রাজনৈতিক কোনো সংশ্লিষ্টতা পাওয়া যায়নি।
ময়মনসিংহ পুলিশ সুপার মিজানুর রহমান জানান, এখানে হাজার হাজার শ্রমিক কর্মরত আছেন। কারখানা কিভাবে চালু রাখতে হয় সেক্ষেত্রে আমাদের সর্বাত্মক সহযোগিতা থাকবে। এখানে শ্রমিকদের রুটি-রোজগারের ব্যাপার। এ ঘটনার সঙ্গে যারা জড়িত তাদের কাউকেই ছাড় দেওয়া হবে না। আর যারা ঘটনার সঙ্গে সম্পৃক্ত না, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তাদের কোনো ধরনের হয়রানি করবে না।
