স্বামীর কথায় ভোট দিতে হয় যে এলাকার নারীদের
সিদ্দিক আলম দয়াল, গাইবান্ধা
প্রকাশ: ২২ ডিসেম্বর ২০২৫, ০৯:০০ পিএম
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
গাইবান্ধার ৫টি সংসদীয় আসনের অধিকাংশ নারীরা নিজের ইচ্ছায় কোনো দিন তাদের মনোনীত প্রার্থী বা মার্কায় ভোট দিতে পারেননি। স্বামী, শ্বশুর-শাশুড়ি আর মুরুব্বিদের কথায় ভোট দিতে হয়। মেম্বার চেয়ারম্যান এমনকি এমপি ভোটেও স্বামীরা যা বলেন সেই মার্কায় সিল মারতে হয়।
এ অবস্থা গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জ, সাদুল্লাপুর, সাঘাটা, ফুলছড়ি, গোবিন্দগঞ্জ, পলাশবাড়ীসহ ৭ উপজেলার গ্রামীণ নারী ভোটারদের চিত্র।
গাইবান্ধার তিস্তা যমুনা, ব্রহ্মপুত্র নদীর ১৬৫টি চরাঞ্চলের ভোটের হিসাবকিতাব আলাদা। এখানে কেন্দ্র আলাদা হলেও ভোট হয় গোষ্ঠীগতভাবে। দলমত নির্বিশেষে যার নাম বেশি শোনা যায় তার বাক্সেই পড়ে ভোট। আর মার্কা নির্ধারণ করেন পরিবারের কর্তা। সেই কারণে ভোট দিতে হয় স্বামী অথবা পরিবারের কর্তার ইচ্ছায়।
অনেকেই আবার বিয়ের আগে নিজের ইচ্ছায় ভোট দিতে পেরেছেন; কিন্তু বিয়ের পর আর পারেননি।
গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জ উপজেলার চর কাপাসিয়ার ভাটি বুড়াইল গ্রামের বাসিন্দা ময়না, আফরোজা, জাহিমা, আফিয়া, মমতাজ, জাহানারা। ভোটার হওয়ার পর স্বামীর বাড়িতে এসে কোনো দিন ভোট দেওয়ার ক্ষেত্রে নিজ ইচ্ছা প্রয়োগ করতে পারেনি। তাদের কথা হচ্ছে আমরা মেয়ে মানুষ। আমাদের অভিভাবক যা বলবেন তাই শুনতে হয়। সিল মারতে হয় স্বামীর পছন্দের সেই মার্কায়। এ অবস্থা গাইবান্ধার গ্রাম ও তিস্তা যমুনা ও ব্রহ্মপুত্র নদীর চরাঞ্চলের চিত্র।
মাঠপর্যায়ে খবর সংগ্রহ করতে গিয়ে তাদের মুখে শোনা গেছে এমন কথা। গাইবান্ধার গ্রামাঞ্চলে নারী ভোটারদের মধ্যে ভোট দেওয়া নিয়ে নানা কথা শোনা যাচ্ছে। অনেক ভোটার আছেন তারা কোনো দিন নিজের ইচ্ছায় ভোট দিতে পারেনি। স্বামী, শ্বশুর আর নিকটতম স্বজনদের প্রভাবিত হয়ে ভোট দিয়েই চলছেন।
গাইবান্ধা শহর থেকে মাত্র ১২ কিলোমিটার দূরে মালিবাড়ি ইউনিয়নের নয়নসুখ গ্রাম। এই গ্রামের গৃহিণী ময়নাসহ শত শত নারীদের কেউ মাঠে কাজ করেন, কেউ আবার স্বামী-শ্বশুরদের সঙ্গে গৃহস্থালির কাজ ছাড়াও ধান মাড়াই থেকে শুরু করে গবাদিপশুর যত্ন করেন।
ময়না বলেন, এ পর্যন্ত ইউনিয়ন পরিষদের ভোট ছাড়াও উপজেলা চেয়ারম্যান এবং দুবার এমপি ভোটও দিয়েছেন স্কুলের সেন্টারে গিয়ে। তার পিতা বলেছিল- ওমুককে ভোট দিতে কিন্তু পারেনি। ভোট দিয়েছে তার স্বামী ফুলমিয়ার কথা অনুযায়ী। তার কথা হলো এখন স্বামীর বাড়িই নিজের বাড়ি, স্বামীর কথা না শুনলে পাপ হবে। তাই পিতার কথা না শুনে স্বামীর কথা অনুযায়ী ভোট দিয়েছি।
আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনের কথা বলতেই তিনি বলেন, ভোট দেব তবে ছোলের বাপ যাকে ভোট দিতে বলবে তাকেই ভোট দেমো।
এই গ্রামের বাসিন্দা কৃষক আব্দুস সাত্তার, তার সাফ কথা। তার পরিবারের ৫ জন ভোটার আছে। তারা সবাই তার কথায় ওঠে-বসে। ৫ ভোটারের মধ্যে কে কোথায় ভোট দিবেন তা আমিই নির্ধারণ করব। বউ আম্বিয়া খাতুনেরও একই কথা- তিনিও বলেন, স্বামী যা বলবো তাই শুনব।
কামারজানির বারোবলদিয়া গ্রামের কহিনুর বেগম। তিনি বলেন, এর আগে ভোট নিয়ে স্বামীর সঙ্গে ঝগড়া হয়েছিল। স্বামী বলে একটা আর আমি বলি আরেক মার্কা। এই নিয়ে দুজনের তর্কবিতর্কের কারণে ভোট সেন্টারে যাওয়া হয়নি।
কোহিনুর পড়ালেখা জানেন অল্প। তাই নিজের স্বাধীনতায় ভোট দিতে চান; কিন্তু স্বামী সাত্তারের কথা- আমি যা বলব সেই মার্কায় ভোট দিতে হবে। না হলে ভোটের সেন্টারে যাওয়া হবে না।
গাইবান্ধার পাঁচটি আসনে নারী ভোটারের সংখ্যা অনেক বেশি।
গাইবান্ধা-১ সুন্দরগঞ্জ আসনে নারী ভোটার ২ লাখ ১১ হাজার ৫৩৫ জন, গাইবান্ধা-২ সদর আসনে ২ লাখ ৯ হাজার ৪১২, গাইবান্ধা-৩ (পলাশবাড়ি ১ লাখ ১৯ হাজার ৫৯৪ ও সাদুল্লাপুর ১ লাখ ৩৭ হাজার ৬৮১), গাইবান্ধা-৪ (গোবিন্দগঞ্জ) আসনে ২ লাখ ৩৬ হাজার ৭৪৫, গাইবান্ধা-৫ (সাঘাটা-১ লাখ ২৬ হাজার ৪০৯ ও ফুলছড়ি ৬৬ হাজার ৫৭১ জন। জেলায় মোট ১১ লাখ ৭ হাজার ৯৪৬ জন নারী ভোটার আসন্ন ত্রয়োদশ নির্বাচনে ভোট প্রয়োগ করবেন।
প্রত্যেক আসনের শহর-গ্রামে ভোটের জমজমাট অবস্থা। হইহই অবস্থা পুরুষ ভোটারদের মধ্যে; কিন্তু সারা নেই নারী ভোটারদের মধ্যে। তারা ভোট দেন শুধু ভোটের দিন সেন্টারে গিয়ে সিল মারবেন। সঙ্গে থাকেন তাদের স্বামী ও স্বজনরা। তাদের কথা মতোই সিল মারতে হয় মার্কায়।
ফাহিমা নামের এক গৃহবধূ বলেন, ভোটের ট্যাকা খায় স্বামীরা। তারা নিজেরা আমার ভোট কখন বিক্রি করে দেয় তা আমি বুঝতেও পারি না। কিন্তু ভোটের দিন বোঝা যায় আসল কথা। গাইবান্ধার বিস্তীর্ণ চরাঞ্চলজুড়ে নারীদের অধিকার বঞ্চিত হয়ে আসছে। ব্রহ্মপুত্র নদীবেষ্টিত চর খারজানি। এই গ্রামের অধিকাংশ নারী ভোটার ভোটের আগের দিনও জানতে পারে না কাকে ভোট দেওয়া হবে।
গোষ্ঠীবদ্ধ হয়ে বাস করলেও চরাঞ্চলের মেম্বার চেয়ারম্যান আর স্বামী শ্বশুরের কথামতো ভোট দিতে হয়। এমন কথা জানালেন জোলেখা বেগম। তিনি বলেন, আমাগো ভোট তো দিয়া দিছি। খালি সিল মারা বাকি আছে। চেয়ারম্যান আর মেম্বাররা যে মার্কায় সিল মারতে বলেন হামরাও সেই মার্কায় ভোট দেই। হামার যাই উপকার করে, বিপদের সময় আসিয়া খোঁজখবর নেয় তাকে ভোট দেই।
তবে চরাঞ্চলজুড়ে নারীরা মাঠে ময়দানে গতর খাটলেও তাদের ভোটের অধিকার সম্পর্কে কেউ তাদের কোনো সহযোগিতা করে না। ভোট এলে হয়তো তাদের কপালে কোনো লাভ-লোকসানের হিসাব না থাকলেও তারা তাদের ইচ্ছে মতো ভোট দিতে পারে না। সকালে ভোট শুরু হলে স্বামী আর স্বজনরা এসে একখানে জড়ো করে সেন্টারে নিয়ে লাইনে দাঁড় করিয়ে বলেন- অমুক মার্কায় ভোট দিবু। সেই আদেশ পেয়েই গ্রামীণ এসব পরিবারের নারীরা ভোট দিয়ে থাকেন- এসব কথা বলেন সুন্দরগঞ্জ উপজেলার চর বেলকার গৃহিণী সাইবানী বেগম। তিনি বলেন, এবার তাদের মধ্যে ভোটের আনন্দ থাকলেও তারা নিজের মতে ভোট দেওয়ার ক্ষমতা নেই। স্বামী যা বলবেন সেই মার্কায় সিল দিয়ে আসবেন।
