যে কারণে মেয়েদের তুলনায় ছেলেরা পিছিয়ে পড়ছে
একরাম তালুকদার, দিনাজপুর প্রতিনিধি
প্রকাশ: ১৯ জুলাই ২০১৯, ০৪:২৫ পিএম
এইচএসসি পরীক্ষায় পাসের পর শিক্ষার্থীদের উল্লাস
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
দিনাজপুর শিক্ষা বোর্ডের অধীনে এবারের এইচএসসি পরীক্ষায় পাসের হারের দিক থেকে ছেলেদের তুলনায় মেয়েরা ভালো করেছে।
শুধু এবার নয়, এই শিক্ষা বোর্ডের ফলাফল পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, গত ৭ বছরেই ছেলেদের পিছনে ফেলে এগিয়ে রয়েছে মেয়েরা।
ছেলেদের এই পিছনে পড়ে যাওয়ার পেছনে ছেলেদের বহির্মুখী মনোভাব এবং মোবাইল ফোন ও ইন্টারনেট এর অপব্যবহারকেই দুষছেন শিক্ষাবিদরা।
দিনাজপুর শিক্ষাবোর্ডের গত ১৭ জুলাই ঘোষিত এইচএসসি পরীক্ষার ফলাফলে জানা গেছে, এই বোর্ডের অধীনে এবার মেয়েদের পাসের হার ৭৫ দশমিক ৩৯ শতাংশ, আর ছেলেদের পাসের হার ৬৮ দশমিক ৩৭ শতাংশ।
শুধু এবার নয় ২০১৩ সাল থেকে এ পর্যন্ত গত ৭ বছরেই মেয়েরা এগিয়ে রয়েছে ছেলেদের তুলনায়।
এর মধ্যে গত ২০১৮ সালে মেয়েদের পাসের হার ছিল ৬৪ দশমিক ৫১ শতাংশ এবং ছেলেদের পাসের হার ছিল ৫৬ দশমিক ২২ শতাংশ। ২০১৭ সালে মেয়েদের পাসের হার ছিল ৬৮ দশমিক ৩৯ শতাংশ, আর ছেলেদের পাসের হার ছিল ৬২ দশমিক ৮১ শতাংশ।
২০১৬ সালে মেয়েদের পাসের হার ছিল ৭৩ দশমিক ২৩ শতাংশ, আর ছেলেদের পাসের হার ছিল ৬৮ দশমিক ৩৩ শতাংশ। ২০১৫ সালে মেয়েদের পাসের হার ছিল ৭২ দশমিক ৬৪ শতাংশ, আর ছেলেদের পাসের হার ছিল ৬৮ দশমিক ৪০ শতাংশ।
২০১৪ সালে মেয়েদের পাসের হার ছিল ৭৫ দশমিক ৭৪ শতাংশ, আর ছেলেদের পাসের হার ছিল ৭২ দশমিক ৬৩ শতাংশ। ২০১৩ সালের এইচএসসি পরীক্ষায় এই বোর্ডের অধীনে মেয়েদের পাসের হার ছিল ৭৪ দশমিক ১৭ শতাংশ, আর ছেলেদের পাসের হার ছিল ৬৯ দশমিক ৭০ শতাংশ।
নানান প্রতিকূল অবস্থার মধ্যেও ছেলেদের তুলনায় পড়াশুনায় মেয়েরা ভালো করার বিষয়টিকে ভিন্নভাবে দেখছে দিনাজপুরের শিক্ষাবিদ ও সমাজকর্মীরা।
তারা বলছেন, সামাজিক অনেক প্রতিকূলতার মধ্যেও মেয়েরা ভালো করছে এটি একটা ভালো দিক। কিন্তু মেয়েদের তুলনায় ছেলেরা এগিয়ে থাকার কথা থাকলেও তারা পিছিয়ে পড়ছে-এটা কোনোভাবেই ভালো দিক নয়।
এজন্য ছেলেদের বহির্মুখী মনোভাব এবং মোবাইল ও ইন্টারনেট-এর অপব্যবহারকেই দায়ী করছেন তারা। তারা বলছেন, মেয়েদের তুলনায় ছেলেদের পড়াশোনার সুযোগ বেশি। কিন্তু এরপরও মেয়েদের তুলনায় ছেলেরা পিছিয়ে থাকছে।
মাদকসহ বিভিন্ন অসামাজিক কার্যকলাপের বিস্তার লাভের যুগে এটা অবশ্যই শংকার। এ জন্য অভিভাবকদের সতর্ক থাকার তাগিদ দেন তারা।
দিনাজপুর সঙ্গীত মহাবিদ্যালয়ের উপাধ্যক্ষ ও সমাজকর্মী ড. মারুফা বেগম বলেন, এবার এইচএসসি পরীক্ষায় ছেলেদের তুলনায় মেয়েরা এগিয়ে রয়েছে-এটা অত্যন্ত আনন্দের ব্যাপার। মেয়েদেরকে যতটা কষ্ট করে সামনের দিকে এগিয়ে আসতে হয়, ছেলেদেরকে জন্মগতভাবেই তার চেয়ে অনেক কম কষ্ট করতে হয়।
তিনি বলেন, মেয়েরা এই কষ্টটা করছে তাদের নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষার জন্য। বর্তমানে মেয়েদের যে অগ্রগতি, তাতে মেয়েদের চেষ্টাটাই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
ছেলেদের পিছিয়ে পড়ার কারণ হিসেবে ড. মারুফা বেগম বলেন, ইদানিংকালে ছেলেদের বাড়ির বহির্মুখী মনোভাবটাই বেশি দেখা যাচ্ছে। অন্যদিকে মেয়েরা বাড়িতে থেকে অত্যন্ত মনযোগের সঙ্গে পড়ালেখার পাশাপাশি শিক্ষকদের আদেশ-উপদেশ ঠিকভাবে মেনে চলছে।
ছেলেরা খারাপ না করলেও মেয়েদের তুলনায় খারাপ করছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ছাত্রদের অমনযোগের জায়গাটা বেশি এবং বর্তমান যে সামাজিক অবস্থায় মোবাইলফোনের কালচারটা ছেলেদের মধ্যে অনেক বেশি। এটাও ছেলেদের পিছিয়ে থাকার কারণ।
মহিলা পরিষদের এই নেত্রী বলেন, কষ্ট করে এগিয়ে যাওয়ার যে ফল, এইচএসসি পরীক্ষার ফলাফলে মেয়েরা এগিয়ে যাওয়ার এটাই একটা প্রমাণ।
বিশিষ্ট লেখক, গবেষক ও শিক্ষাবিদ দিনাজপুর সরকারি কলেজের দর্শন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. মাসুদুল হক বলেন, বাংলাদেশের সার্বিক উন্নয়নের সুচকে নারীর ভুমিকা এখন অগ্রগন্য। সরকারি কর্মকর্তা, বিজ্ঞানী, সেনা-কর্মকর্তাসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে এখন নারীরা অবস্থান করে নিয়েছে, এর পিছনেই রয়েছে শিক্ষা। নারীরা অনেক মনযোগ দিয়ে লেখাপড়া করছে বলেই তারা ভালো করছে।
তিনি বলেন, নারীরা গ্রামাঞ্চলে মাইলের পর মাইল সাইকেল চালিয়ে লেখাপড়া করছে। এতেই বোঝা যায়, তাদের ভালো করার চেষ্টা রয়েছে।
ছেলেদের পেছনে পড়ার কারণ হিসেবে ইন্টারনেটের অপব্যবহারকেও দায়ি করেন ড. মাসুদুল হক। তিনি বলেন, ইন্টারনেটের সুযোগ নিয়ে ছেলেরা খারাপ দিকটা গ্রহণ করে সেদিকে এগিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু মেয়েরা ইন্টারনেটের সুযোগ নিয়ে পজেটিভ দিকটা গ্রহণ করে শিক্ষায় কাজে লাগাচ্ছে।
এসব কারণেই মেয়েরা ছেলেদের তুলনায় ভালো করছে বলে অভিমত ব্যক্ত করেন তিনি।
‘তোমরা আমাকে একটা শিক্ষিত মা দাও-আমি তোমাদের একটা ভালো জাতি ও রাষ্ট্র উপহার দেবো’ আলেকজান্ডারের এই উক্তির উদ্ধৃতি দিয়ে ড. মাসুদুল হক বলেন, মেয়েরা ভালো করছে- এটা অবশ্যই আমাদের জন্য ভালো এবং আমরা মনে হয় সেই দিকেই এগুচ্ছি। পাশাপাশি ছেলেরা পিছিয়ে পড়ার বিষয়টিকে তিনি আমলে নিয়ে এ ব্যাপারে অভিভাবকদের সতর্ক হওয়ার আহ্বান জানান।
