বিলুপ্তির পথে দুর্গাপুরের ঐতিহ্যবাহী মহাশোল মাছ
দুর্গাপুর (নেত্রকোনা) প্রতিনিধি
প্রকাশ: ০৬ সেপ্টেম্বর ২০২০, ০৪:২৬ পিএম
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
নেত্রকোনার দুর্গাপুর উপজেলার কংস নদ ও সোমেশ্বরী নদীতেই দুষ্প্রাপ্য মহাশোল মাছের আবাসভূমি। মহাশোল মাছটিকে অনেকেই মহাশের, মাশোল, টর, চন্দনা প্রভৃতি নামে ডেকে থাকেন।
মহাশোলের দুটি প্রজাতি। একটির বৈজ্ঞানিক নাম Tortor, অন্যটি Torputitora। আমাদের দেশে দুই প্রজাতির মহাশোলই পাওয়া যায়।
নদীর পাথর-নুড়ির ফাঁকে ফাঁকে ‘পেরিফাইটন’ নামের এক রকমের শ্যাওলা জন্মে। এগুলোই মহাশোলের প্রধান খাদ্য। মহাশোল সাধারণত ৫২ সেন্টিমিটার লম্বা ও ৯ কেজি পর্যন্ত ওজন হয়ে থাকে। এর দেহ লম্বা, মুখ অধোমুখী, মাথা অপেক্ষাকৃত ছোট। দেহের বর্ণ উপরের দিকটা বাদামি সবুজ, পেটের দিকটা রূপালী এবং পিঠের পাখনা লালচে বর্ণের হয়ে থাকে। মহাশোল দেখতে খুব সুন্দর, অনেকটা মৃগেল মাছের মতো। আমাদের মিঠাপানির মাছের মধ্যে মহাশোল স্বাদেও সেরা।
স্থানীয় প্রবীণ ব্যক্তিরা বলেন, সুসঙ্গ দুর্গাপুরে ঐতিহ্যবাহী নানিদ ও মহাশোল মাছ ছাড়া নতুন জামাইকে বরণ করা হতো না। শহরের কোনো গুরুত্বপূর্ণ মেহমানকেও মহাশোল মাছ ছাড়া আপ্যায়ন ঐতিহ্যগতভাবেই মানা হতো।
এ বিষয় নিয়ে রোববার বিকালে মাছচাষী ইন্দ্র মোহন জানান, দুর্গাপুরে সোমেশ্বরী নদীর মহাশোল মাছের উৎস মুখগুলো বন্ধ রয়েছে। শুকনো মৌসুমে কংস নদ ও সোমেশ্বরী নদী শুকিয়ে যাওয়ায় বসবাস ও বংশবৃদ্ধির জায়গা নষ্ট হওয়ার ফলে মহাশোল মাছ প্রাপ্তি ধীরে ধীরে কমতে থাকে। বর্তমানে কোনো কোনো সময় পাওয়া গেলেও তা ৩-৪ হাজার টাকা কেজি দরে বিক্রি হতে দেখা যায়।
সোমেশ্বরী নদী ও কংস নদ ছাড়াও আশপাশের হাওর, বিল-ঝিল বা অন্য কোনো মিঠা পানির নদ-নদীতেও হঠাৎ দেখা পাওয়া যায় মাছের রানী মহাশোলের। বৈশ্বিক উষ্ণতা ও জলবায়ুর পরিবর্তনের ফলে জীবজগতের স্বাভাবিক আচরণগত বৈশিষ্ট্যের পরিবর্তন আসায় মাছের ক্ষেত্রেও এর প্রভাব লক্ষ্য করা গেছে।
চকলেঙ্গুরা গ্রামের মাছ ব্যবসায়ী মোহাম্মদ আলী জানান, পুকুরে মহাশোলের চাষ সফল না হওয়ার মূল কারণ হচ্ছে পুকুরে মাছটির বৃদ্ধি খুবই ধীরগতিতে। গত বছর আমরা পোনা ছেড়ে দেখেছি, দুই থেকে দেড় বছরে মাত্র দেড় কেজি ওজন হয়েছে। যে কারণে স্থানীয় জেলেরা বাণিজ্যিকভাবে পুকুরে মহাশোল চাষে আগ্রহ দেখান না। তবে সবকিছু কেবল বাণিজ্যিকভাবে দেখব তা নয়, আমাদের দুর্গাপুরের ঐতিহ্যকে ধরে রাখতেও মাছটি চাষ করে এ প্রজাতিকে টিকিয়ে রাখার দায়িত্ব আমাদেরই।
মৎস্য খামারি জাকির হোসেন বলেন, এই মাছের বংশ বিস্তারে সরকারিভাবে উদ্যোগ নিতে হবে। নইলে বিলুপ্তই হয়ে যাবে ঐতিহ্যবাহী মহাশোল মাছ। সোমেশ্বরী নদীতে অপরিকল্পিতভাবে বালু ও পাথর উত্তোলনের কারণে নদীর জলজ উদ্ভিদগুলো নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। বাংলা ড্রেজারের প্রপেলারের আঘাত ও শ্যালো মেশিনগুলো থেকে নির্গত পোড়া মবিল পানিতে সংমিশ্রণের কারণে নদীগুলো থেকে মূল্যবান নানিদ, মহাশোল ও লাচু মাছগুলো বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। এসব মাছের বংশ বিস্তারে নদী থেকে অপরিকল্পিত বালু ও পাথর উত্তোলন বন্ধ করতে হবে।
এ নিয়ে দুর্গাপুর উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা সুমন কুণ্ডু যুগান্তরকে বলেন, বৃহত্তর ময়মনসিংহের ঐতিহ্যবাহী মাছ মহাশোল। অত্র অঞ্চলের নদীগুলোতে এর বংশ বিস্তারের স্থল। নানা সমস্যার কারণেই নদীগুলোতে এখন আর বংশবিস্তার করতে পারছে না মহাশোল মাছ। তবে মহাশোল মাছের বংশ বিস্তারের জন্য ময়মনসিংহে মৎস্য গবেষণা কেন্দ্র কাজ করছে প্রতিনিয়ত।
