Logo
Logo
×

সারাদেশ

গাজীপুরে স্কুল-কলেজ পড়ুয়ারা জড়িয়ে পড়ছে বিপজ্জনক কিশোর গ্যাংয়ে

Icon

শাহ সামসুল হক রিপন, গাজীপুর

প্রকাশ: ০৬ জানুয়ারি ২০২১, ০৪:১২ পিএম

গাজীপুরে স্কুল-কলেজ পড়ুয়ারা জড়িয়ে পড়ছে বিপজ্জনক কিশোর গ্যাংয়ে

গাজীপুরের বিভিন্ন এলাকায় স্কুল-কলেজ পড়ুয়া শিক্ষার্থীরা বিপজ্জনক কিশোর গ্যাংয়ের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ছে। এতে অভিভাবকদের মাঝে আতঙ্ক বিরাজ করছে।

দিন দিন এদের তৎপরতা বৃদ্ধি পাওয়ায় স্থানীয় পুলিশ প্রশাসন বিষয়টি নিয়ে চিন্তিত হলেও কমিশনার খন্দকার লুৎফুল কবির এদের ‘কিশোর গ্যাং’ হিসেবে পরিচিত করতে নারাজ। এ সমস্যা সমাধানে তিনি নিজ পরিবার থেকে শুরু করে সব পর্যায়ের মানুষদের একসঙ্গে কাজ করার আহবান জানান।

গাজীপুর মেট্রোপলিটন সদর, পূবাইল, টঙ্গী, বাসন, গাছা, কোনাবাড়ী, কাশিমপুর থানাসহ জেলার বিভিন্ন উপজেলায় রয়েছে কিশোর গ্যাং গ্রুপ। এসব গ্রুপ তাদের দেয়া বিভিন্ন নামে পরিচিত। উঠতি বয়সের কিশোররা এসব গ্যাং কালচারের সঙ্গে জড়িত। পশ্চিমা কালচারের অনুকরণে এসব গ্রুপ গড়ে উঠেছে। এসব গ্যাং গ্রুপের মধ্যে সামান্য ছোটখাটো বিষয় নিয়ে দ্বন্দ্ব ঝগড়া বিবাদ লেগেই থাকে।

মঙ্গলবার রাতে শহরের নীলেরপাড়া সড়কে দুইটি কিশোর গ্রুপের মধ্যে ধাওয়া পাল্টাধাওয়া ও গুলি বিনিময়ের ঘটনা ঘটে। এ ঘটনায় পুলিশ তাৎক্ষণিক ধাওয়া দিয়ে একজন কিশোরকে আটক করে।

ওই আটক কিশোরের একটি ভিডিও রেকর্ডিং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্যাপকভাবে ভাইরাল হয়। ওই ভিডিও রেকর্ডিংয়ে কিশোর ছেলেটি বলে- শাহীন ভাই দুটি অটো এবং একটি মাইক্রোবাসযোগে তাদের ২০-২৫ জন কিশোরকে দা-কাচি ও অস্ত্রসহ নিয়ে এসে অবস্থান নেয়। পরে প্রতিপক্ষ গ্রুপের সদস্যরা হঠাৎ কয়েকটি মোটরবাইকে এসে গুলি ছুড়ে। এতে তারা ছত্রভঙ্গ হয়ে ছোটাছুটি করে পালিয়ে যায়। এ ঘটনায় একজন পায়ে গুলিবিদ্ধ হয়।

গাজীপুর মেট্রোপলিটন সদর থানার ওসি মো. রফিকুল ইসলাম জানান, মঙ্গলবার রাতে শহরের নীলেরপাড়া রোডে দুইপক্ষ একটি মারামারির প্রস্তুতি নিচ্ছিল। সংবাদ পেয়ে আমরা ঘটনাস্থলে গিয়ে তাৎক্ষণিক ধাওয়া দেই এবং দুটি ছেলেকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য নেয়া হয়।

গাজীপুর জেলা জজ আদালতে কর্মরত এক পুলিশ কর্মকর্তা জানান, গত বৃহস্পতিবার শহরের দুপুরে রাজদিঘীরপাড় সংলগ্ন সাহাপাড়ার বালুর মাঠ এলাকায় উঠতি বয়সী কিছু কিশোর দা-ছেনি ও লাঠিসোটা নিয়ে মহড়া দেয়ার সংবাদ পেয়ে তিনি বিষয়টি মেট্রোপলিটন সদর থানা পুলিশকে জানিয়েছিলেন। 

বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, জেলা শহরকেন্দ্রিক কিশোর গ্যাং গ্রুপের সদস্যরা জড়ো হয়- রাজবাড়ি মাঠে ও বাউন্ডারির দক্ষিণ পাশে, জোর পুকুরের উত্তর ও পূর্বপাড়, দক্ষিণ ছায়াবীথি-হাড়িনাল রোডের কালভার্টে, লালমাটি, শ্মশানঘাটে, বারেকের টেক, ফুলস্টপের গলি, বরুদা, ছায়াবীথি, রথখোলা, ভোড়া, হাজীবাগ, কাজীবাড়ি, পূর্ব চান্দনা, নীলেরপাড়া রোড, পশ্চিম জয়দেবপুর (লক্ষ্মীপুর), মারিয়ালী, কলাবাগান, দেশীপাড়া, ভূরুলিয়ার ময়লার টেক, ডুয়েট ও রয়েল ইনস্টিটিউট কেন্দ্রিক আশপাশের এলাকা, এটিআই গেট, শিমুলতলী বাজার সংলগ্ন উত্তর পাশে, চতর স্কুল গেট, ফাউকাল রেলগেট এলাকা, কাউলতিয়া, চান্দনা, কোনাবাড়ী, কাশিমপুর, পূবাইল এলাকায়। এছাড়া গাছা ও টঙ্গীর বিভিন্ন এলাকায় ছোট-বড় কিশোর গ্যাং গ্রুপ সক্রিয় রয়েছে।

এদের মধ্যে আধিপত্য, মাদক, নারী, স্ট্যান্ড দখল, সিনিয়র-জুনিয়রসহ নানা ধরনের ছোটখাটো বিষয় নিয়ে ধাওয়া পাল্টাধাওয়া, মারামারি ও খুন-খারাবির ঘটনাও ঘটছে।

এছাড়া বিভিন্ন স্কুল-কলেজের মোড়ে বা অলি-গলির চা দোকানের পাশে দাঁড়িয়ে প্রকাশ্য ইভটিজিং এবং বীরদর্পে সিগারেট ফুঁকলেও কেউ মুখ খোলে কিছু বলার সাহস করে না। এরা বিভিন্ন স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থী বা স্কুলছুট হওয়ায় এদের সবার বয়স ১৩ থেকে ১৯ বছরের মধ্যে।

গত ৩ সেপ্টেম্বর গাজীপুর জেলা শহরের রাজদিঘীরপাড় এলাকায় সামান্য ‘তুই’ বলাকে কেন্দ্র করে সমবয়সী বন্ধুদের হাতে খুন হয় নুরুল ইসলাম নুরু (১৬) নামে এক কিশোর। পার্শ্ববর্তী সাহাপাড়ার ‘ভাই-ব্রাদারস’ গ্রুপের বেশ কয়েকজন সদস্য কিশোর নুরুকে ধারালো অস্ত্র দিয়ে উপর্যুপরি কুপিয়ে হত্যা করে। এ ঘটনায় র‌্যাব-১ এর সদস্যরা হত্যাকাণ্ডে জড়িত কিশোর গ্যাং চক্রের ৬ জনকে গ্রেফতার করে। তাদের কাছ থেকে হত্যাকাণ্ডে ব্যবহৃত চাপাতি ও ছোরা উদ্ধার করে। 

গত ৭ জুলাই গাজীপুর মহানগরীর টঙ্গী পূর্ব থানাধীন ফকির মার্কেট এলাকায় আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে স্থানীয় ফিউচার ম্যাপ স্কুলের ৯ম শ্রেণির ছাত্র শুভ আহাম্মেদকে (১৬) বুকে, পিঠে ও মাথায় উপর্যুপরি কুপিয়ে হত্যা করা হয়। এ সময় হত্যার কাজে ব্যবহৃত ধারালো অস্ত্র, সুইস গিয়ার ও চাকু উদ্ধার করা হয়। নিহত শুভ ছিল বাবা-মায়ের একমাত্র সন্তান।

এ ঘটনায় র‌্যাব-১ প্রধান আসামি ও কিশোর গ্যাং লিডার মৃদুল হাসান পাপ্পুসহ ‘পাপ্পু লিডার’ গ্রুপের ৪ জনকে গ্রেপ্তার করে। তারা আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছে।

এ ঘটনার কয়েক দিন পর ২৪ জুলাই একই থানাধীন কাজীপাড়া চন্দ্রিমা এলাকায় বাসায় ঢুকে তৌফিজুল ইসলাম ওরফে মুন্না (১৫) নামে এক স্কুলশিক্ষার্থীকে খুন করা হয়। মুন্না রাজধানীর বিএফ শাহিন একাডেমির অষ্টম শ্রেণির ছাত্র ছিল। এ ঘটনায় পুলিশ মুন্নার ব্যবহৃত মোবাইল সেট উদ্ধার করলেও  হত্যাকাণ্ডের মূল অপরাধীকে এখনো শনাক্ত করতে পারেনি।

গাজীপুর সরকারি মহিলা কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ প্রফেসর এমএ বারী বলেন, কিশোর গ্যাং দেশের অপরাধ জগতের নবআবির্ভূত এক অপরাধী চক্র। বখাটে কিছু কিশোর দলবদ্ধ হয়ে চুরি, ছিনতাই, ধর্ষণ এমনকি খুন-খারাবির দিকে লিপ্ত হয়ে পড়ছে; যা আমাদের সমাজের জন্য অত্যন্ত উদ্বেগের বিষয়। পারিবারিক অনুশাসন, শিক্ষাবিমুখতা, নেশা জাতীয় দ্রব্য সেবন ও হতাশার কারণে একশ্রেণির কিশোরদের অপরাধ প্রবণতার দিকে ঠেলে দিচ্ছে। বিপথগামী এসব উচ্ছৃঙ্খল ছেলেদের সুপথে আনয়ন করতে না পারলে সমাজে এর বিরূপ প্রভাব পড়বে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নজরদারির মাধ্যমে এখনই এদের দমন করা প্রয়োজন।

গাজীপুরের র‌্যাব-১ এর পোড়াবাড়ী ক্যাম্পের কোম্পানি কমান্ডার লে. কমান্ডার আব্দুল্লাহ আল মামুন বলেন, আমারা কিশোর গ্যাং নিয়ে কাজ করছি।

তিনি জানান, থার্টিফার্স্ট নাইটের আগের দিন নগরীর চান্দনা চৌরাস্তা এলাকা থেকে ৫-৬ জন কিশোরকে ধরি। পরে মিলিয়ে দেখি যে, ওই এলাকার বিখ্যাত কুদ্দুস গ্রুপের ইনচার্জসহ আমরা এদের ধরেছি। তিনিও কিশোরদের পরিবারের সদস্যদের প্রতি নজরদারি বাড়ানোর তাগিদ দিয়েছেন। 

এ বিষয়ে গাজীপুর মেট্রোপলিটন পুলিশের (জিএমপি) কমিশনার খন্দকার লুৎফুল কবির বলেন, কিশোর গ্যাং নিয়ে আমরা শুরু থেকেই অত্যন্ত সংবেদনশীল। কিশোর গ্যাং বিষয়ে আমরা কিছু সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা নিয়ে এগোচ্ছি। আমরা এর জন্য কিছু কর্মপরিকল্পনা করেছি এবং সে অনুযায়ী কার্যক্রম শুরু হয়েছে।

তিনি বলেন, বয়ঃসন্ধিকাল বিবেচনা করে তাদের কিশোর গ্যাং বলতে চাই না। ওই বিবেচনায় আমরা পর্যায়ক্রমে ৪টা পর্যায়ে কাজ করছি। মানবিক বিষয়টি সামনে রেখে প্রথমে কাউন্সিল করা এবং শেষপর্যায়ে আসে অ্যাকশনের বিষয়টি। এছাড়া কারা এর সঙ্গে জড়িত এবং তাদের লিডার কে আমরা এসব খুঁজে বের করার চেষ্টা করছি।

গাজীপুর কিশোর গ্যাং

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম