সাগরপথে গ্রিসে, গ্রিন কার্ড পেয়েও স্বপ্নপূরণ হলো না ইদ্রিসের
হাটহাজারী (চট্টগ্রাম) প্রতিনিধি
প্রকাশ: ০৫ মার্চ ২০২৩, ০৭:১৩ পিএম
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
বাল্যকালে মধ্যপ্রাচ্যের দেশ ওমানে সড়ক দুর্ঘটনায় জন্মদাতা পিতাকে হারিয়েছিল চট্টগ্রামের হাটহাজারীর মো. ইদ্রিস (৪০)। এরপর বড় সন্তান হিসেবে পরিবারের হাল ধরতে পিতৃহারা ইদ্রিস ভাগ্য বদলের আশায় ইলেক্ট্রিশিয়ান হিসেবে ২০০৮ সালে সংযুক্ত আরব আমিরাতে পাড়ি জমান।
সেখানে একটি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেও জীবনমানের কোনো পরিবর্তন হচ্ছিল না। স্বপ্নপূরণ ও উন্নত জীবনের আশায় ২০১৪ সালে প্রায় এক মাস সাগর পথ পাড়ি দিয়ে যান ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশ গ্রিসে।
দীর্ঘ ৯ বছর ধরে গ্রিসের রাজধানী এথেন্সে মোবাইল এক্সেসরিজ ও শিশুদের খেলনা বিক্রি করে খুব ভালোভাবেই কেটে যাচ্ছিল তার জীবন। তার আয়-রোজগার দিয়ে পরিবারের মা, ভাইবোনদের নিয়ে ভালোই চলছিল দিনগুলো। ওই দেশের নাগরিকত্বের অস্থায়ী গ্রিন কার্ডও পায় ইদ্রিস।
২০১৮ সালে তিনি দেশে ছুটিতে এসে পারিবারিকভাবে বিয়ে করেন। বছরখানেক আগে ছুটি কাটিয়ে পুনরায় প্রবাসে ফিরে যান। মাত্র কয়েক দিন আগেই জানতে পারেন গ্রিসের নাগরিকত্ব পেতে যাচ্ছেন ইদ্রিস।
সেই গ্রিন কার্ডটি সংগ্রহ করার জন্য স্থানীয় সময় গত ২৮ ফেব্রুয়ারি রাতে যাত্রীবাহী ট্রেনে করে গ্রিসের রাজধানী এথেন্স থেকে উত্তরাঞ্চলীয় শহর থেসালোনিকি যাচ্ছিলেন। গ্রিসের উত্তরাঞ্চলীয় শহর লারিসায় নামক এলাকায় পৌঁছলে বিপরীত দিক থেকে একটি ফ্রেইট ট্রেনের মুখোমুখি সংঘর্ষে অর্ধ শতাধিক মানুষের মৃত্যু হয়। ওই দুর্ঘটনায় আরেক বাংলাদেশিসহ না ফেরার দেশে পাড়ি জমান ইদ্রিস। গত শুক্রবার রাতে ডিএনএ টেস্টের মাধ্যমে নিশ্চিত হওয়া গেছে ইদ্রিস মারা গেছেন।
নিহত ইদ্রিস হাটহাজারী উপজেলার ৮নং মেখল ইউনিয়নের ৯নং ওয়ার্ড এলাকার মৃত সাহেব মিয়ার ছেলে। তার মৃত্যুর বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন তার ছোট ভাই ব্যবসায়ী মো. ইলিয়াস।
তিনি জানান, দীর্ঘ ২৩ বছর আগে বাবাকে হারিয়েছিলাম। বড় ভাই ইদ্রিস আমাদেরকে বাবার স্নেহ দিয়ে আগলে রেখেছিলেন। আমাদের আশা ভরসার একমাত্র ঠিকানা বড় ভাই ইদ্রিস মারা গেছেন কখনো কল্পনা করতে পারছি না। বড় ভাই গত সপ্তাহে মোবাইল ফোনে আমাকে বলেছিল, তিনি চলতি মাসে ওই দেশের গ্রিন কার্ড নিয়ে দেশে ফিরবেন।
নিহতের বাল্যবন্ধু জিয়া হাসানের সঙ্গে মোবাইল ফোনে কথা হলে তিনি জানান, সম্পর্কে ভাগিনা (চাচাতো বোনের ছেলে) হলেও একই বয়সী হওয়ায় আমরা ছিলাম ভাই, বন্ধুর মতো। যেদিন তাকে বহনকারী ট্রেন দুর্ঘটনার শিকার হয় সেদিন ট্রেন ছাড়ার ৩০ মিনিট আগেও আমার সঙ্গে ফোনে কথা হয়েছিল ইদ্রিসের। ওই সময় ইদ্রিস বলেছিল- গ্রিন কার্ডের জন্য সে ওই শহরে যাচ্ছে; কিন্তু কিছুতেই আজ ট্রেনে ভ্রমণ করতে ইচ্ছে করছে না। পরে রাত বেশি হয়ে যাওয়াতে ওই শহরে পৌঁছে সকালে ফোন দিবে বলে ভাই (ইদ্রিস) বিদায় নিল। বুঝতে পারিনি এ বিদায় শেষ বিদায় হবে। আমি কিছুতেই মনকে সান্ত্বনা দিতে পারছি না।
শনিবার গ্রিস প্রবাসী নিহত ইদ্রিসের মৃত্যুর খবরটি এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে। এতে তার পরিবারে নেমে আসে শোকের ছায়া। স্বজনদের আহাজারিতে এলাকার পরিবেশ ভারি হয়ে উঠেছে। তাদের পরিবারে চলছে শোকের মাতম।
পুত্র শোকে বারংবার বিলাপ করছেন গর্ভধারিণী মা রওশন বেগম। তিনি উপস্থিত গণমাধ্যমকর্মীদের পেয়ে অশ্রুসিক্ত নয়নে বলেন, তিনি সরকারের কাছে একটি অনুরোধ করতে চান, যেন সরকার তার ছেলের মরদেহটি সহসা দেশে ফিরিয়ে আনার ব্যবস্থা করে দেয়।
অন্যদিকে শনিবার বাংলাদেশ সময় দুপুর আড়াইটার দিকে গ্রিসের বাংলাদেশ দূতাবাসে নিহতের বন্ধু জামিল ও বাচ্চু যান বলে জানা গেছে। তারা জানিয়েছেন, প্রয়োজনীয় প্রক্রিয়া শেষে হলে আগামী ২-৩ দিনের মধ্যে ইদ্রিসের মরদেহ দেশে পাঠানো সম্ভব হবে।
