কিশোরগঞ্জের পাগলা মসজিদ
এক বছরে দানবাক্সে ২২ কোটি টাকা
এ টি এম নিজাম, কিশোরগঞ্জ
প্রকাশ: ১০ ডিসেম্বর ২০২৩, ০৯:২৮ পিএম
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
দানবাক্স যেন টাকার মেশিন। খুলতেই দেশি-বিদেশি মুদ্রা, স্বর্ণ-রৌপ্য, হীরার অলংকার। এমন দানবাক্স রয়েছে কিশোরগঞ্জের ঐতিহাসিক পাগলা মসজিদে। এখানে মানত ও দান করলে মনস্কামনা পূর্ণ হয়-এমন বিশ্বাস থেকে হিন্দু-মুসলিম নির্বিশেষে দুই হাত ভরে দান করে থাকেন। বৈদেশিক মুদ্রা এবং স্বর্ণ-রৌপ্য ও হীরার অলংকারের বাইরেই গত এক বছরে মসজিদটির দানবাক্সে পড়েছে ২২ কোটি টাকা। প্রতিদিনই এখানে বাড়ছে লোকসমাগম। এতে সমৃদ্ধ হচ্ছে দানবাক্সের অর্থের পরিমাণ।
ঐতিহাসিক পাগলা মসজিদটির ব্যবস্থাপনা কমিটি সূত্রে জানা যায়, চলতি অর্থবছরে দানবাক্স খোলা হয়েছে চারবার। সর্বশেষ ৯ ডিসেম্বর মসজিদের ৯টি দানবাক্স খুলে বৈদেশিক মুদ্রা এবং স্বর্ণ-রৌপ্য অলংকার ছাড়াই পাওয়া যায় ছয় কোটি ৩২ লাখ ৫১ হাজার ৪২৩ টাকা। এ নিয়ে চারবার দানবাক্স খুলে বছরে রেকর্ড ২১ কোটি ৮৭ লাখ ৮৫ হাজার ১৮১ টাকা পাওয়া গেছে। এ ছাড়াও পাওয়া গেছে বৈদেশিক মুদ্রা এবং স্বর্ণ-রৌপ্য ও হীরার অলংকার। দান-মানতের গরু-মহিষ-ছাগল-ভেড়া, হাঁস-মুরগি ও ফল-ফলাদি বিক্রির টাকা তো আছেই।
সূত্র জানায়, গত ৯ ডিসেম্বর সকাল সাড়ে ৭টায় মসজিদের ৯টি দানবাক্স খুলে ২৩ বস্তা দেশি-বিদেশি মুদ্রা এবং স্বর্ণ-রৌপ্য অলংকার পাওয়া যায়। রূপালী ব্যাংকের কর্মকর্তা-কর্মচারী এবং মসজিদ কমপ্লেক্স মাদ্রাসা-এতিমখানার শিক্ষক-শিক্ষার্থী ও কর্মচারীসহ ২২০ জন অংশ নেন টাকা গণনার কাজে। দীর্ঘ ১৫ ঘণ্টা ধরে ভাঁজ করে মেশিনে গণনা করে রেকর্ড ছয় কোটি ৩২ লাখ ৫১ হাজার ৪২৩ টাকা পাওয়া যায়।
নিয়ম অনুযায়ী জেলা প্রশাসক ও পাগলা মসজিদ পরিচালনা কমিটির সভাপতি এবং পুলিশ সুপার, জেলা প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ও কমিটির সদস্যসহ শহরের গণ্যমান্য ব্যক্তিদের উপস্থিতিতে দানবাক্স খোলা হয়।
চলতি বছরের ১৯ আগস্ট খোলা হয় মসজিদের আটটি দানবাক্স। সে সময় পাঁচ কোটি ৭৮ লাখ ৯ হাজার ৩২৫ টাকার পাশাপাশি বৈদেশিক মুদ্রা, স্বর্ণ-রৌপ্য ও হীরার অলংকার পাওয়া যায়। এর আগে ৬ মে দানবাক্স খোলা হয়। তখন আটটি দানবাক্স থেকে পাওয়া যায় পাঁচ কোটি ৫৯ লাখ সাত হাজার ৬৮৯ টাকা এবং বৈদেশিক মুদ্রা, স্বর্ণালংকার ও হীরার আংটি। এরও আগে ৭ জানুয়ারি তিন মাস একদিন পর দানবাক্স খোলা হয়। তখন চার কোটি ১৮ লাখ ১৬ হাজার ৭৪৪ টাকা এবং বৈদেশিক মুদ্রা, স্বর্ণ-রৌপ্য ও হীরার অলংকার পাওয়া যায়।
কিশোরগঞ্জের জেলা প্রশাসক ও পাগলা মসজিদ পরিচালনা কমিটির সভাপতি মোহাম্মদ আবুল কালাম আজাদ জানান, দান থেকে পাওয়া অর্থ পাগলা মসজিদ এবং মসজিদ কমপ্লেক্সের অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের ব্যয়ভার নির্বাহের পাশাপাশি জেলার বিভিন্ন মসজিদ-মাদ্রাসা ও এতিমখানার উন্নয়ন, দরিদ্র মেধাবী এমনকি দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত দরিদ্র ব্যক্তিকে সহযোগিতা করা হয়।
বর্তমানে মসজিদটি ঘিরে আন্তর্জাতিক মানের দৃষ্টিনন্দন ইসলামিক কমপ্লেক্স প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। ‘পাগলা মসজিদ ইসলামিক কমপ্লেক্স’ নামে নির্মিতব্য এ প্রতিষ্ঠানটির ব্যয় ধরা হয়েছে ১২৫ কোটি টাকা। আর সেই কমপ্লেক্সে একসঙ্গে ৩০ হাজার মুসল্লি নামাজ আদায় করতে পারবেন।
জনশ্রুতি আছে, একসময় এক সাধক পাগলের বাস ছিল কিশোরগঞ্জ শহরের হারুয়া ও রাখুয়াইল এলাকার মাঝ দিয়ে প্রবাহিত নরসুন্দা নদের মধ্যবর্তী স্থানে জেগে ওঠা উঁচু টিলাকৃতি স্থানে। মুসলিম-হিন্দু নির্বিশেষে সব ধর্মের লোকের যাতায়াত ছিল ওই সাধকের আস্তানায়। ওই সাধকের দেহাবসানের পর তার উপাসনালয়টিকে মসজিদ হিসাবে ব্যবহার শুরু করেন এলাকাবাসী। ওই সাধকের দেহাবসানের পর থেকে আশ্চর্যজনকভাবে স্থানীয় এমনকি দেশের দূর-দূরান্তের লোকজনের ভিড় বাড়তে থাকে সেখানে। মানত কিংবা দান খয়রাত করলে মনের বাসনা পূরণ হয়- এমন বিশ্বাস থেকে বিভিন্ন ধর্ম-বর্ণের নারী-পুরুষ ছুটে আসেন এ মসজিদে। তারা নগদ টাকা-পয়সা, সোনা ও রুপার অলংকারের পাশাপাশি গরু, ছাগল, হাঁস-মুরগি দান করেন। প্রতি শুক্রবার জুমার নামাজের দিন এ মসজিদে মানত নিয়ে আসা বিভিন্ন বয়সের নারী-পুরুষের ঢল নামে। আগতদের মধ্যে মুসলিমদের বেশির ভাগই জুমার নামাজ আদায় করেন মসজিদে। পাগলা মসজিদের এ ইতিহাস প্রায় আড়াইশ বছরেরও অধিক সময়ের পুরোনো।
