সহিংসতার পর নগরে চাঁদাবাজি, ১৩ দুষ্কৃতকে গণপিটুনি
রাজশাহী ব্যুরো
প্রকাশ: ০৮ আগস্ট ২০২৪, ০৯:২০ পিএম
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
সহিংসতা ও লুটতরাজের বিরুদ্ধে রাজশাহীর গ্রামে গ্রামে মাইকে ঘোষণা দিয়ে দুষ্কৃতদের প্রতিরোধ শুরু হয়েছে। বুধবার রাজশাহীর গোদাগাড়ী ও পবার বিভিন্ন এলাকায় হামলা ও লুটের সময় মোট ১৩ দুষ্কৃতকে আটক করেন এলাকাবাসী।
তবে বৃহস্পতিবার দুপুর পর্যন্ত আটক ১৩ জনের মধ্যে ৭ জনকে গণপিটুনি দিয়ে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। বাকি ৬ জনকে সেনাবাহিনীর হাতে দেওয়া হয়েছে।
রাজশাহী বরেন্দ্র অঞ্চলের আদিবাসী গ্রামগুলোতে তীর ধনুক নিয়ে পাহারা বসিয়েছে আদিবাসী জনগোষ্ঠীর লোকেরা।
এদিকে জানা গেছে, নৈরাজ্য, সহিংসতা, লুটতরাজ ঠেকাতে রাজশাহীর গ্রামে গ্রামে রাত জেগে পাহারা শুরু করেছেন এলাকাবাসী। মসজিদের মাইক থেকে ঘোষণা দিয়ে এলাকাবাসীকে দুষ্কৃতদের বিরুদ্ধে শক্ত প্রতিরোধ গড়ে তোলার আহবান জানানো হচ্ছে। তবে রাজশাহী নগরীতে এখনো বন্ধ হয়নি নৈরাজ্য। চার দিনব্যাপী হামলা ভাঙচুর লুটপাট ও অগ্নিসংযোগের পর এখন নগরীর মহল্লায় মহল্লায় শুরু হয়েছে ব্যাপক চাঁদাবাজি ও দখল।
বৃহস্পতিবার দিনভর নগরীর বিভিন্ন পাড়া মহল্লাতেও মাইকিং করে দুষ্কৃতদের প্রতিরোধের ঘোষণা প্রচার করা হয়েছে। কোথাও কোনো বাড়িতে দুষ্কৃতরা হামলা করলে সম্মিলিতভাবে প্রতিরোধে এগিয়ে আসার জন্য এলাকাবাসীর কাছে আহবান জানানো হয়েছে। তবে সহিংসতা ও লুটতরাজ বন্ধে বিএনপি বা জামায়াতের স্থানীয় কোনো নেতার পক্ষ থেকে এখনো কোনো উদ্যোগ দেখা যায়নি।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, রাজশাহীর গোদাগাড়ীর একটি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান পরিবার নিয়ে থাকেন রাজশাহী নগরের সপুরা এলাকায়। গত ৬ আগস্ট দুপুরে পরিষদে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। এ সময় ৩০ থেকে ৩৫ জনের একটি সশস্ত্র দল তার বাড়িটি ঘেরাও করে। দুর্বৃত্তরা প্রথমে তিনতলা বাড়িটির ভেতরে ঢুকে সমস্ত জিনিসপত্র লুট করে।
পরে দুষ্কৃতি দলের প্রধান জনৈক সুমন সর্দার ৫০ লাখ টাকা না দিলে তাকে স্ত্রী ছেলে মেয়েসহ প্রাণে মেরে ফেলার হুমকি দেন। প্রাণ বাঁচাতে ইউপি চেয়ারম্যান বাসায় থাকা টাকাপয়সা সোনা দানা যা ছিল সবকিছু তাদের হাতে তুলে দিয়ে কোনভাবে প্রাণ নিয়ে বাসা থেকে বেরিয়ে অজানা গন্তব্যে চলে যান।
এদিকে এই দুষ্কৃতরা বাড়িটিতে তালা দিয়ে দখল করে নিয়েছে। সেনাবাহিনীর যোগাযোগ নম্বরে ফোন দিয়ে অভিযোগ দেওয়া হয়েছে। জানা গেছে দুষ্কৃত দলের প্রধান সুমন সর্দার রাজশাহীর ১৫নং ওয়ার্ড যুবদলের সেক্রেটারি। তার নেতৃত্বে বুধবার দিনে ও রাতে সপুরা এলাকার বিভিন্ন বাসাবাড়ি লুট হয়েছে এবং এখনো হচ্ছে। যুবদল নেতা সুমন সর্দারের মোবাইল নম্বর সংগ্রহ করে ফোন দেওয়া হলেও তা বন্ধ পাওয়া গেছে।
রাজশাহীর বিদিরপুর এলাকায় দুষ্কৃতরা গত ৫ আগস্ট বিকাল থেকে এলাকার বাড়িতে বাড়িতে লুটতরাজ চালিয়ে আগুন দিয়েছে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে স্থানীয় এক ব্যবসায়ী বলেন, এলাকার বিএনপি জামায়াতের নেতাকর্মীরা রাজশাহী শহর থেকে বহিরাগত সন্ত্রাসীদের এনে বাড়িঘর চিনিয়ে দিচ্ছে ও লুটতরাজ করে আগুন জ্বালিয়ে সব কিছু পুড়িয়ে দিচ্ছে। বাসাবাড়ির মূল্যবান জিনিসপত্র লুট করে নিয়ে যাচ্ছে। তবে বুধবার রাত থেকে এলাকাবাসী মাইকে ঘোষণা দিয়ে সন্ত্রাসী প্রতিরোধের ডাক দিয়েছে। এলাকার মানুষ রাত জেগে গ্রামের পর গ্রাম পাহারা দিচ্ছে।
এদিকে বুধবার গভীর রাতে গোদাগাড়ীর কুমরপুর এলাকায় কয়েকটি বাড়িতে ঢুকে লুটপাটের সময় এলাকার মসজিদের মাইক থেকে ঘোষণা দেওয়া হয়। এ সময় চার গ্রামের শত শত মানুষ লাঠিসোটা নিয়ে ঘেরাও দিয়ে পাঁচ যুবককে ধরে ফেলে। গণপিটুনির পর সেনাবাহিনীর সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়। বৃহস্পতিবার দুপুরে এ প্রতিবেদন লেখার সময় পর্যন্ত পাঁচ দুষ্কৃতকে ধরে রাখেন এলাকাবাসী। এই পাঁচ দুষ্কৃতির দলটি রাজশাহী নগরীর তালাইমারী থেকে গোদাগাড়ীতে গিয়েছিল লুট করতে।
অন্যদিকে বুধবার গভীর রাতে রাজশাহীর উপকণ্ঠ নওহাটা বিল্লা এলাকায় কয়েকটি দোকান লুটের সময় এলাকাবাসী ঘেরাও দিয়ে পাঁচ দুষ্কৃতকে দেশি অস্ত্রসহ আটক করেন। গণপিটুনি দিয়ে বৃহস্পতিবার ভোরের দিকে তাদের ছেড়ে দেওয়া হয়।
বুধবার গভীর রাতে পবা উপজেলার হুজুরিপাড়া এলাকার কয়েকটি বাড়িতে হামলা ও লুটপাটের সময় মসজিদের মাইক থেকে প্রতিরোধের ঘোষণা দেওয়া হয়। এলাকাবাসী লাঠিসোটা হাতে ছুটে গিয়ে ঘেরাও দিলে দুষ্কৃতরা মোটরসাইকেল ফেলে পালিয়ে যায়। তবে ধরা পড়ে একজন। দেওয়া হয় গণপিটুনি।
পবা উপজেলা নির্বাহী অফিসার আবুল হাসনাত বৃহস্পতিবার ঘটনাস্থলে গিয়ে আটক দুষ্কৃতিকে ছেড়ে দেন। ইউএনও বলেন, আটক ব্যক্তি একজন মাদকাসক্ত। এ কারণে তাকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে।
এদিকে বৃহস্পতিবার ভোরের দিকে গোদাগাড়ীর দেওপাড়া ইউপির সাবেক চেয়ারম্যান আকতারুজ্জামানের বাড়িতে হামলা করে একদল দুষ্কৃতি। মাইকে ঘোষণা পেয়ে এলাকাবাসী চারদিক থেকে দুষ্কৃতিদের ঘেরাও করে। এলাকাবাসীর উপস্থিতি টের পেয়ে দুষ্কৃতিরা পাঁচটি মোটরসাইকেল ফেলে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলে একজনকে আটকে গণপিটুনি দেন। এই সন্ত্রাসীর বাড়িও নগরীতে বলে জানা গেছে।
রাজশাহীর গোদাগাড়ী পৌরসভার কাউন্সিলর শামিম আকতার জানান, ৫ আগস্ট বিকেল থেকে গত বুধবার সন্ধ্যা পর্যন্ত এলাকার বহু পরিবারের সর্বস্ব লুট করা হয়েছে। তবে রাত থেকে এলাকাবাসী ঐক্যবদ্ধভাবে সন্ত্রাসীদের প্রতিরোধ শুরু করেছেন। ভয়াবহ অরাজকতা বন্ধে দ্রুত সেনাবাহিনীকে সক্রিয় ভূমিকা নেওয়ার দাবি করেন তিনি।
এদিকে বৃহস্পতিবারও রাজশাহী মেট্রোপলিটন পুলিশের ১২ থানায় কোন কার্যক্রম শুরু হয়নি। অধিকাংশ পুলিশ কর্মকর্তা কর্মচারী কর্মস্থলে ফিরতে পারেননি। রাজশাহী জেলা পুলিশের ৯টি থানাতেও কোনো কাজ শুরু হয়নি।
রাজশাহীর পুলিশ সুপার মো. সাইফুর রহমান জানান, থানাগুলোর অবকাঠামো ও সেবা সরঞ্জাম ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। কাজ শুরু করতে একটু সময় লাগবে। পুলিশ কর্মকর্তাদের নিজ নিজ কর্মস্থলে যেতে বলা হয়েছে।
এদিকে বৃহস্পতিবারও রাজশাহী সিটি করপোরেশনের মুল ভবন ও ওয়ার্ড কার্যালয়গুলিতে কোনো কার্যক্রম শুরু হয়নি। কয়েকটি ওয়ার্ড কার্যালয় ঘুরে সেগুলোকে তালাবদ্ধ দেখা গেছে। যেগুলো পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে সেগুলো পরিত্যক্ত অবস্থায় রয়েছে। পুড়ে যাওয়া জিনিসপত্র এখনো সরানো ও পরিষ্কারের কাজ শুরু হয়নি। তবে রাজশাহী জেলা প্রশাসনের কার্যক্রম সীমিতভাবে চলছে। উপজেলা নির্বাহী অফিসগুলো হামলায় ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় সেগুলোতেও কার্যক্রম শুরু হয়নি।
রাজশাহীর বিভাগীয় কমিশনার অতিরিক্ত সচিব ড. দেওয়ান মো. হুমায়ুন কবীর বলেন, পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে আসছে। জেলা প্রশাসন ও উপজেলা নির্বাহী অফিসগুলোকে স্বাভাবিক কার্যক্রমে ফিরতে কিছুটা সময় লাগবে। আমরা জনগণের সহায়তা চাচ্ছি।
