Logo
Logo
×

সারাদেশ

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ছাড়লেন রাঙামাটির দুই নেত্রী

Icon

রাঙামাটি প্রতিনিধি

প্রকাশ: ০৫ মার্চ ২০২৫, ০৭:৪২ পিএম

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ছাড়লেন রাঙামাটির দুই নেত্রী

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ছাড়লেন রাঙামাটির দুই নেত্রী আফিয়া তাসনীম ও দ্যুতিমনি তালুকদার। সম্প্রতি বেশকিছু দিন ধরে রাঙামাটিতে প্লাটফর্মটির কার্যক্রম পরিচালনায় এ দুই নেত্রীর উপস্থিতি ছিল উল্লেখযোগ্য।

কিন্তু হঠাৎ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে নিজেদের পৃথক স্ট্যাটাসে বিবৃতি দিয়ে সংগঠন থেকে সরে যাওয়ার ঘোষণা দিলেন রাঙামাটি সরকারি কলেজের এই দুই ছাত্রী।

আফিয়া ৩ মার্চ ও দ্যুতিমনি ৪ মার্চ ফেসবুকের নিজ ওয়ালে দেওয়া স্ট্যাটাসে এ ঘোষণা দেন। শিক্ষার্থীর পাশাপাশি দ্যুতিমনির ব্যক্তিগত পারিবারিক পরিচয় হলো তিনি রাঙামাটি জেলা বিএনপির সভাপতি দীপন তালুকদার ওরফে দীপুর মেয়ে এবং জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান কাজল তালুকদারের ভাতিজি।

এদিকে জুলাই ২৪ আন্দোলনে রাঙামাটিতে বড় ধরনের কোনো একটা উত্তাল বা উত্তাপ পরিস্থিতি তৈরি করতে না পারলেও ৫ আগস্টের পর হঠাৎ একে একে প্রকাশ মেলে বেশ কয়েকজন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন পরিচয়ধারী সমন্বয়কের। দেখা মেলে প্লাটফর্মটির পরিচয়ধারী গুটিকয়েক শাখার তৎপরতা। আবার তাদের নিজেরার ভেতর স্পষ্ট হয় বিভক্তিও।

সংগঠনটির সঙ্গে সংশ্লিষ্টতার দাবি তুলে নানা ইস্যুতে নিজেদের মধ্যে অন্তর্কোন্দল, বিরোধ আর স্বার্থের দ্বন্দ্বে সংঘাতে জড়িয়ে পড়ে এসব শিক্ষার্থীরা।

অন্যদিকে ছাত্রদল এবং ছাত্রশিবিরের যারা ছিলেন তারা পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে ফিরে যান নিজেদের সংগঠনে। ফলে রাঙামাটিতে অনেকটা দুর্বল হয়ে পড়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সাংগঠনিক শক্তি। তবু এর মধ্যে সর্বশেষ যে কয়েক অরাজনৈতিক শিক্ষার্থী প্ল্যাটফর্মটিতে নিজেদের জড়িয়ে রেখেছিলেন তাদের অন্যতম ছিলেন আফিয়া তাসনীম ও দ্যুতিমনি তালুকদার।

৩ মার্চ আফিয়া তাসনীম তার ফেসবুক ওয়ালে লিখেছেন- ‘আসসালামু আলাইকুম। আমি আফিয়া তাসনীম। রাঙামাটি বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের একজন প্রতিনিধি। বেশকিছু দিন ধরে একটা বিষয়ে লিখব ভাবছিলাম কিন্তু শারীরিক এবং মানসিক অবস্থা খুব একটা ভালো না থাকায় আর লিখা হয়নি। আপনারা অনেকেই জানেন, জুলাই আন্দোলনে আমি সরাসরি মাঠপর্যায়ে আন্দোলনের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলাম এবং সেই থেকে এখন অবধি সহযোদ্ধাদের প্রচেষ্টায় রাঙামাটিতে নানান কর্মসূচি করার চেষ্টা করেছি আলহামদুলিল্লাহ। তবে যদিও ওভাবে আমার ফেসবুকে কিছু প্রচার করা হয়নি। যদিও রাঙামাটিতে তেমন বড় পরিসরে কোনো আন্দোলন করার সুযোগ হয়নি, কারণ রাঙামাটির প্রেক্ষাপট ভিন্ন ছিল। আন্দোলন থেকে শুরু করে গত ৭ মাসে এই বৈষম্যবিরোধী প্ল্যাটফর্মের পেছনে অনেক সময়, শ্রম দিয়েছি।

সিনিয়র, জুনিয়র অনেকের সঙ্গে কাজ করার সুযোগ হয়েছে। অনেকের সঙ্গে মনোমালিন্যও হয়েছে কিছু কিছু ক্ষেত্রে। তবুও সবকিছু উপেক্ষা করে চেয়েছি এই প্ল্যাটফর্মে থেকে নিজের শহরের জন্য, শহরের মানুষগুলোর জন্য ভালো কিছু করার। এই চিন্তা চেতনা থেকেই গত ৭ মাস এই প্ল্যাটফর্মে সময় দেওয়া। আর সময় দিতে গিয়ে নিজের পড়াশোনা, একমাত্র ইনকাম সোর্স টিউশন, নিজের পরিবার পরিজন, বন্ধুবান্ধব সবকিছুতে এসেছে দূরত্ব। কিন্তু দিনশেষে উপলব্ধি করলাম আসলে এসব কিছুই নয়। কিছু সহযোদ্ধাদের আচরণে খুবই কষ্ট পেয়েছি। সব কেমন যেন অগোছালো, সিনিয়র জুনিয়র মান্য নাই, শৃঙ্খলা নাই। সবাই কেমন যেন নেইম, ফেইম, স্বার্থের পিছে দৌড়ায়।

সুপরামর্শদাতা যাদের ভাবতাম দিনশেষে দেখি তাদের অনেকের সেইম অবস্থা। সবাই সুযোগের অপেক্ষায় থাকে বৈষম্যবিরোধী প্ল্যাটফর্মকে নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করতে।তাছাড়া রাঙামাটির বৈষম্যবিরোধী ব্যানারেই যখন বৈষম্য করা হয় (নারী পুরুষ বৈষম্য, সাম্প্রদায়িক বৈষম্য ইত্যাদি) তখন আর এই প্ল্যাটফর্মে কাজ করার পক্ষে আমি অন্তত নই। তাই, সিদ্ধান্ত নিলাম আজ থেকে এই প্ল্যাটফর্মে আমি আর থাকবো না। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সকল প্রকার কাজ থেকে নিজেকে অব্যাহতি দিলাম। আমার পড়াশোনার অবস্থা, শারীরিক অবস্থা, মানসিক অবস্থা, আর্থিক অবস্থা সবই বিধ্বস্ত। তাই ভাবলাম এখন নিজেকে টাইম দেওয়া উচিত। যেখানে কোনো শৃঙ্খলা নাই, লক্ষ্য নাই সেখানে থাকাটা আমার জন্য বেমানান। এই প্ল্যাটফর্মে আমার আবেগ, ভালোবাসা জড়িত। অনেক শ্রম দিয়েছি এই প্ল্যাটফর্মে। তাই কষ্ট হচ্ছে খুব এই প্ল্যাটফর্মের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করতে। বিগত সময়গুলোতে কারো মনে কোন কষ্ট দিয়ে থাকলে, আমার কাজে কেউ কষ্ট পেলে দয়া করে এই পবিত্র মাহে রমজানের অসিলায় সকলে ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।

এই ৭ মাসে অনেক অনেক ভালো, খারাপ সময়ের সম্মুখীন হয়েছি। অনেক স্মৃতি রয়েছে একসঙ্গে কাজ করার। এই প্ল্যাটফর্মে কাজ করতে গিয়ে ব্যক্তিগতভাবে অনেক মানুষের দোয়া পেয়েছি, স্নেহ পেয়েছি, অনেক জুনিয়রদের সম্মান পেয়েছি। দিনশেষে এসবই আমার প্রাপ্তি। খুব ইচ্ছে ছিল, রাঙামাটিতে একটা জুলাই প্রদর্শনী দেওয়ার। নিজ উদ্যোগে জেলা প্রশাসনের সহায়তায় তারুণ্যের মেলা উৎসবে তা করতে সক্ষম হয়েছি, আলহামদুলিল্লাহ। এই জুলাই প্রদর্শনীতে কত মানুষ যে এসে আমাকে বাহবা জানিয়েছে, খুশি হয়েছে তা শব্দে লিখে প্রকাশ করার মতন নয়। একজন আঙ্কেল ঢাকা থেকে এসেছিলেন, তিনি এত খুশি হয়েছিলেন যে স্যালুট দিয়েছিলেন আমাকে খুশি হয়ে। যদিও তখন খুব বিব্রতবোধ হচ্ছিল, লজ্জায় পড়ে গিয়েছিলাম কারণ এত সম্মান ভালোবাসা পাওয়ার মতোন কিছুই আমি করতে পারিনি। এই জুলাই প্রদর্শনী দেওয়ার একটাই কারণ ছিল তরুণ প্রজন্ম এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের মধ্যে জুলাইকে ছড়িয়ে দেয়া, জুলাই স্পিরিটকে ধরে রাখা। আর এটার সার্থকতা অনুভব করছিলাম যখন পিচ্চি পিচ্চি ছেলেরা এসে আবু সাঈদের ছবির সামনে গিয়ে তার মতোন বুক চিতিয়ে দাঁড়াচ্ছিল। আরেকজন বাবা এসে তার ছোট্ট ছেলেকে জুলাই বিপ্লবের ছবি দেখিয়ে কাহিনীগুলো বর্ণনা করছিলেন আর ছেলেটা মনোযোগ সহকারে শুনছিল। এসব দেখে তখন চোখে পানি আসতো, জুলাই প্রদর্শনীতে দাঁড়িয়ে কত যে ইমোশনাল হয়েছিলাম তার হিসাব নেই। অন্তত এই ব্যানার নিয়ে কোনোরকম দুর্নীতি করিনি,শহীদদের রক্তের সঙ্গে বেঈমানি করিনি এটাই আমার সার্থকতা। আমার বিবেকের কাছে আমি পরিষ্কার। এই প্ল্যাটফর্মে কাজ করতে গিয়ে মানুষের স্নেহ,সম্মান, ভালোবাসা যেমন পেয়েছি তেমন কিছু কিছু কাছের মানুষের ষড়যন্ত্রের শিকারও হয়েছি। এসব প্রাপ্তি, অপ্রাপ্তিগুলো নিয়েই আমি এই ব্যানার থেকে সড়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি।

তবে হ্যাঁ, আবারো যদি কখনো প্রয়োজন হয় দেশের জন্য, জাতির জন্য রাস্তায় নামতে, জীবন উৎসর্গ করতে পিছপা হবো না, ইনশাআল্লাহ! কোথাও কেউ গিয়ে যদি আমার নাম বিক্রি করে কোনো সুবিধা নেয়ার চেষ্টা করে, তাহলে আমাকে জানানোর জন্য অনুরোধ জানাচ্ছি।’

নিজের স্ট্যাটাসে বেশকিছু অভিযোগ তুলে সরে যাওয়ার ঘোষণা দেন আফিয়া। তার স্ট্যাটাসের নিচে মন্তব্য করেছেন নানা শ্রেণি-পেশার মানুষ। বেশিরভাগই তার সিদ্ধান্তকে সমর্থন জানিয়েছেন। কেউ কেউ রাজনীতিতে সক্রিয় হওয়ার পরামর্শও দিয়েছেন।

আফিয়ার স্ট্যাটাসের পরদিনই ৪ মার্চ নিজের ওয়ালে পোস্ট করেন দ্যুতিমনি তালুকদার। তিনি লেখেন- ‘দেশের স্বার্থে দেশে হওয়া বৈষম্য ও দুর্নীতি দূর করার উদ্দেশ্যে জীবনের পরোয়া না করে মাঠে নামা। পারিবারিক, সামাজিক ও জাতিগত সকল বাধাবিপত্তি উপেক্ষা করে দেশের ভালোর জন্য এতদিন পর্যন্ত বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সর্বকনিষ্ঠ ছাত্র প্রতিনিধি হিসেবে প্রথমসারিতে থেকে কাজ করেছি। সবসময় চেয়েছি আমার ভালবাসা ও আবেগের এই বৈষম্যবিরোধী প্ল্যাটফর্মকে রাঙ্গামাটিতেও প্রতিষ্ঠা করা হবে জুলাইয়ের চেতনা দিয়ে।

এই প্ল্যাটফর্মে কাজ করে দূরত্ব সৃষ্টি হয়েছে পরিবার, বন্ধু-বান্ধব ও অনেক সহকর্মীদের সঙ্গে। এখন আমি মানসিক ও শারীরিকভাবে বিপর্যস্ত। তবে এতকিছুর বিনিময়ে পেয়েছি বিশ্বাসঘাতকতা ও এক রাশ হতাশা।

জুলাই চেতনা ধারণ করে দেশের উন্নতির জন্য কাজ করার বদলে যখন দেখছি প্রায় সবাই ব্যক্তিস্বার্থে নিমগ্ন তখন আর এমন জায়গায় কাজ করা আমার পক্ষে সম্ভব না। ব্যক্তিস্বার্থে দুর্নীতি করে অন্য সহকর্মীদের দমিয়ে রাখার চেষ্টা ও আমি এত শ্রম ও ত্যাগ করার পরেও আমার কিছু সহকর্মীর আমার প্রতি করা জাতিগত বৈষম্য আমাকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছে। তাই আত্মসম্মানের কথা মাথায় রেখে আমি খুব ভেবে চিন্তে সিদ্ধান্ত নিয়েছি এই প্ল্যাটফর্ম থেকে অব্যাহতি নেওয়ার।

আমি জেনে বুঝে কোনো অন্যায় করি না, খুব প্রয়োজন ছাড়া কোনো কথা বলি না। কখনো কোথাও দুর্নীতি বা অন্যায় দেখলে নিজেকে সামলাতে পারি না। তাই আমার কোনো ব্যবহারে কেউ কষ্ট পেয়ে থাকলে তা একান্তই আপনাদের দোষ। যদি আমি কখনো কারোর সঙ্গে দুর্ব্যবহার করে থাকি তবে তা আপনাদের করার অন্যায়ের কারণেই করেছি।

এত শত অভিজ্ঞতার জন্য ধন্যবাদ বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন, রাঙ্গামাটি শাখাকে। দেশের প্রয়োজনে আবারও মাঠে নামতে আমি সদা প্রস্তুত।’

রাঙামাটি ছাত্র আন্দোলন

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম