বিএনপির ২ গ্রুপের সংঘর্ষে রিকশাচালক নিহত, চিকিৎসায় বাধা মামলা নেয়নি পুলিশ

রাজশাহী ব্যুরো
প্রকাশ: ১২ মার্চ ২০২৫, ১০:৫৭ পিএম

রাজশাহীতে বিএনপির দুই গ্রুপের সংঘর্ষের সময় ছুরিকাঘাতে রিকশাচালক গোলাম হোসেন রকি (৪৮) গুরুতর আহত হলে তাকে হাসপাতালে চিকিৎসা করাতেও বাধা দেওয়া হয়েছে। ঘটনার পরদিন গোলাম হোসেনের স্ত্রী পরীবানু বেগম মামলা করতে আরএমপির বোয়ালিয়া থানায় গেলেও তা নেওয়া হয়নি।
স্বামীর মৃত্যুর পর বুধবার এমন অভিযোগ করেছেন নিহতের স্ত্রী। তবে পুলিশ বলছে তারা অভিযোগ পায়নি।
জানা গেছে, গোলাম হোসেনের জন্ম কুমিল্লায়। ছয় বছর বয়সে বাবা-মা মারা যাওয়ার পর তার মামা তাকে রাজশাহী এনে এতিমখানায় রেখেছিলেন। কিছুটা বড় হওয়ার পর এতিমখানা থেকে এসে মামার বাড়িতেই মানুষ হন। মামা নূরু চৌধুরী মোহনপুরের মেয়ে পরীবানুর সঙ্গে গোলামের বিয়ে দিয়েছিলেন। কোনো রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন না। রিকশা চালিয়ে সংসার চালাতেন। পরিবার নিয়ে নগরীর দড়িখড়বোনা রেললাইনের পাশে টিনের ঘর ভাড়া নিয়ে থাকতেন গোলাম।
নিহতের স্ত্রী পরীবানুর দাবি কয়েক দিন আগে এলাকার একটি ফ্ল্যাট থেকে একজন আওয়ামী লীগ নেতাকে গ্রেফতারের ঘটনাকে কেন্দ্র গত ৮ মার্চ রাতে বিএনপির দুই গ্রুপের মধ্যে ব্যাপক সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। সংঘর্ষে ব্যাপক বোমাবাজি ও হামলা পালটা হামলার ঘটনায় ১০ জন আহত হয়। কয়েকটি মোটরসাইকেলে অগ্নিসংযোগ করা হয়। সংঘর্ষের একপক্ষে ছিলেন মহানগর মহিলা দলের সহ-ক্রীড়া সম্পাদক লাভলী খাতুনের অনুসারীরা। অন্যপক্ষে ছিলেন মহানগর যুবদলের সদস্য সচিব মারুফ হোসেনের অনুসারীরা।
এদিকে সংঘর্ষের সময় রিকশাচালক গোলাম বাসায় যাচ্ছিলেন। তখন দড়িখড়বোনা মোড়ে বিএনপির একটি গ্রুপ তাকে ছুরিকাঘাত করে। রাজশাহী মেডিকেল কলেজ (রামেক) হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মঙ্গলবার রাতে গোলাম মারা যান। ময়নাতদন্তের পর বুধবার গোলামের লাশ পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়।
স্বামী নিহতের বিষয়ে স্ত্রী পরীবানু বলেন, হাসপাতালে তার স্বামী তাকে বলেছিলেন, যারা আমাকে মেরেছে, আমি তাদের চিনি রে চিনি। সুস্থ হই, ক্লাবে মামাদের কাছে যাব। বলব, ‘মামা, আমি কী অপরাধ করেছিলাম? আমাকে এভাবে পঙ্গু করে দিলা? আমি আর কিছু কইরে খেতে পারব না তো আর।’
পরীবানু আরও বলেন, হেঁটে যাওয়ার সময় আমার স্বামীকে সোহেল নামে একজন ঘিরে ধরে। এ সময় আমার স্বামী তাদের বলেছিল আমি এখানে ভাড়া থাকি, আমি গরিব মানুষ। তাও তারা আমাকে ছুরি মারল।
পরীবানু বোয়ালিয়া থানায় দেওয়া একটি অভিযোগের কপি উপস্থিত সাংবাদিকদের দেন।
অভিযোগে রিকশাচালক গোলামকে ছুরিকাঘাত করার জন্য সুমন সরদার, মীর তারেক, ফাইজুল হক ফাই, লাভলী, সোহেল, নাইম, লাম, রনি ও ছানার নাম লেখা হয়েছে। তাদের পুরো ঠিকানাও আছে।
থানায় এই অভিযোগ দেওয়া হয়েছিল কিনা- জানতে চাইলে পরীবানু বলেন, তিনি এটি বোয়ালিয়া থানায় দিয়েছিলেন, কিন্তু মামলা হয়নি। অভিযোগে লেখা নামগুলো পড়ে শোনানো হলে পরীবানু স্বীকার করেন, এদের নাম তিনিই লিখেছিলেন।
হাসপাতালে নেওয়ার পর গোলাম হোসেনের চিকিৎসা করতে মহানগর মহিলা দলের ক্রীড়া সম্পাদক বিথী খাতুন ও সহ-ক্রীড়া সম্পাদক লাভলী খাতুন বাধা দিচ্ছিলেন বলেও অভিযোগ করেন পরীবানু বেগম। তিনি বলেন, ওই লাভলী আর বিথী, দুজনে বলছে- না, না এই রোগী ভর্তি চলবে না। হটান হটান, এই রোগী হবে না ভর্তি। লাভলী এই রকম করে বললেন। বিথী বললেন- না না চলবে না। ফলে চিকিৎসা শুরু হতে এক ঘণ্টা দেরি হয়।
পরীবানু অভিযোগে আরও বলেন, ‘হাসপাতালে লাভলী বলেছেন, এই রোগী নিবেন না, নিবেন না, খবরদার! আমার স্বামীকে ভর্তি করতে দিচ্ছিল না। আমি অনেক রিকোয়েস্ট করলাম- আগে একটু চিকিৎসাটা দেন। লাভলী ওখানে আমার কোনো কথা শুনছিল না। তখন পুলিশের কাছে গিয়ে হাত ধরলাম। কিন্তু লাভলী বলছে, খবরদার, এই লোককে ঢোকাতে দেবেন না ভেতরে। ওখানে কোনো প্রকারেই ভর্তি নিতে দিচ্ছিল না। লাভলী যদি আমার স্বামীকে ভর্তি করতে দিত, আরও এক ঘণ্টা আগে আমার স্বামী চিকিৎসা পেত। আমার স্বামীর ট্রলি রেখে সবাই চলে যাচ্ছে, আমি দৌড়াদৌড়ি করছি। ডাক্তারের হাত-পা ধরে বলেছি, স্যার, আগে রক্ত পড়ার চিকিৎসাটা হোক। আমি অনেক রিকোয়েস্ট করেছি। তখন লাভলী ট্রলি ধরে বলছে- না, এই রোগীর কোনো চিকিৎসা চলবে না। এভাবে বাধা দিয়েছে।’
হাসপাতালের জরুরি বিভাগের সিসি ক্যামেরার ফুটেজ দেখার অনুরোধ জানিয়ে তিনি বলেন, ‘ওই সিসি ক্যামেরা যদি টানেন দেখতে পাবেন, লাভলী কি করেছিল সেদিন। আমার স্বামীর চিকিৎসা এক ঘণ্টা আগে হতো, লাভলী পিছে করে দিয়েছে। লাভলী রাউন্ড দিচ্ছে, এইভাবে ট্রলি ধরে বলছে চিকিৎসা হবে না। লাভলীকে বলেছি, আমাদের চিনেন? আমরা ১০ বছর ধরে ভাড়া থাকি। আমরা তো কোনো দল করি না। আমাদের সঙ্গে কেন এই আচরণ?’
স্বামী হত্যার বিচার চেয়ে পরীবানু বলেন, ‘আমার ছেলে বিদেশে আছে। সে বলেছে, আমরা কিছু চাই না। আমরা এই হত্যার বিচার চাই। স্বামীর মৃত্যুর পরও রাতেই থানায় গেছি। বলেছি, আমি কেস করতে চাই। ওসি বললেন- ঠিক আছে কেস করবেন। আপনি কি চিনেন কাউকে? আমি বলি, দুই-তিনজনকে চিনি। তাদের বিরুদ্ধেই আমি কেস করব। কাগজ নিয়ে রেখে দিয়েছে পুলিশ।
রিকশাচালকের চিকিৎসা করতে না দেওয়ার অভিযোগের ব্যাপারে কথা বলতে মহিলা দল নেত্রী লাভলী খাতুনের মোবাইলে কয়েক দফা ফোন করা হলেও সংযোগ পাওয়া যায়নি। বাড়িতে গিয়েও তাকে পাওয়া যায়নি।
মহানগর মহিলা দলের ক্রীড়া সম্পাদক বিথী খাতুন বলেন, ওই রিকশাওয়ালাকেও তিনি চেনেন না, তার স্ত্রীকেও চেনেন না। বাড়িতে হামলার ফলে মহিলাদল নেত্রী লাভলী ও তার নাতনি আহত হয়েছিল। হাসপাতালে তিনি তাদের নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন। এ সময়ের মধ্যে কে হাসপাতালে গেছে, না গেছে তিনি কিছুই খেয়াল করেননি।
বিথী বলেন, এটা একটা ষড়যন্ত্র। পরিবানুকে দিয়ে কেউ বলাচ্ছে।
গোলাম হোসেন আহত থাকা অবস্থায় পরীবানুর দেওয়া অভিযোগ গ্রহণ না করার অভিযোগের বিষয়ে বোয়ালিয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোস্তাক হাসান বলেন, এ রকম কোনো অভিযোগ তিনি দেখেননি। গোলাম হোসেনের মৃত্যুর পর পরীবানু থানায় এসেছিলেন। পরে চলে গেছেন। মামলা নেওয়ার জন্য তাকে ডাকা হয়েছে। লাশ দাফনের পর হয়ত আসবেন।