রামগতি-কমলনগরে সয়াবিন চাষে লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে শঙ্কা
কমলনগর (লক্ষ্মীপুর) প্রতিনিধি
প্রকাশ: ১৬ এপ্রিল ২০২৫, ০৯:১৪ পিএম
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
সয়াল্যান্ড খ্যাত লক্ষ্মীপুরের রামগতি ও কমলনগর উপজেলায় এবার ২৯ হাজার পাঁচশ হেক্টর জমিতে সয়াবিন আবাদের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে উপজেলা কৃষি অফিস।
এতে দুই উপজেলায় চলতি মৌসুমে সয়াবিন উৎপাদনের পরিমাণ দাঁড়াতে পারে ৬৫ হাজার ৫০ মেট্রিক টন; যার আনুমানিক বাজারমূল্য ধরা হয়েছে ৩৯০ কোটি টাকা।
তবে আবহাওয়া অনুকূলে থাকলে উৎপাদনের পরিমাণ লক্ষ্যমাত্রাকেও ছাড়িয়ে যাবে বলে মনে করা হলেও প্রাকৃতিক বৈরী আবহাওয়ার কারণে লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে শঙ্কা দেখা দিয়েছে।
মৌসুমের অর্ধেকরও বেশি সময় অতিবাহিত হলেও বৃষ্টি না হওয়ায় গাছে ফল আসলেও তা পুষ্ট হচ্ছে না বলে অভিযোগ কৃষকদের।
কৃষকরা বলেছেন, উপকূলীয় এলাকা হওয়ায় প্রাকৃতিক দুর্যোগ, জলোচ্ছ্বাস ও অতিবৃষ্টির কারণে প্রতিবছরই ফসলহানি ঘটে। এবার আবহাওয়া এখনো অনুকূলে থাকলেও হচ্ছে না বৃষ্টি। যে কারণে জমি লবণাক্ত হয়ে ঝলসে যাচ্ছে সয়াবিনের গাছ। এতে উৎপাদন লক্ষমাত্রা ব্যাহত হওয়ার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে।
উপজেলা কৃষি অফিসের তথ্যানুযায়ী, এবার রামগতি ও কমলনগর উপজেলায় মোট ২৯ হাজার ৫০০ হেক্টর জমিতে সয়াবিন আবাদ করা হয়েছে। হেক্টরপ্রতি জমিতে উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ২.৩ মেট্রিক টন হারে মোট ৬৫ হাজার ৫০ মেট্রিক টন সয়াবিন উৎপাদন লক্ষমাত্রা ধরা হয়েছে।
এর মধ্যে রামগতিতে ১৭ হাজার হেক্টর জমিতে সয়াবিন চাষ হয়েছে। এতে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ৩৭ হাজার ৪০০ মেট্রিক টন; যার বাজার মূল্য ২২৫ কোটি টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে।
অন্যদিকে কমলনগরে ১২ হাজার ৫০০ হেক্টর জমিতে সয়াবিন চাষ করা হয়েছে। এতে উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয় ২৭ হাজার ৫০০ মেট্রিক টন; যার বাজার মূল্য প্রায় ১৬৫ কোটি টাকা।
কৃষি অফিস সূত্রে জানা গেছে, রামগতি-কমলনগরে চলতি রবি মৌসুমে সয়াবিনের লক্ষমাত্রা অর্জনে দুই উপজেলার অন্তত ৪ হাজার ২শ কৃষকের মাঝে উচ্চ ফলনশীল নতুন জাতের সোহাগ-১, বারি-২, বারি-৩ জাতের সয়াবিনের বীজ বিতরণ করা হয়েছে। এর সঙ্গে প্রণোদনা হিসেবে জনপ্রতি কৃষককে ১০ কেজি করে সার (এমওপি ও ড্যাপ) দেওয়া হয়েছে।
অন্যদিকে, এর আগে ২০২২-২৩ অর্থবছরে ২৯ হাজার হেক্টর জমিতে উৎপাদনের পরিমাণ ছিল ৫২ হাজার মেট্রিক টন।
কৃষি বিভাগ জানায়, উচ্চফলনশীল নতুন জাতের সোহাগ-১, বারি-২, বারি-৩ জাতের সয়াবিন চাষ করে ভালো ফলন পেয়েছেন কৃষকরা।
২০২৩-২৪ বিপণন বছরে ২৯ হাজার হেক্টর জমিতে উচ্চফলনশীল নতুন জাতের সোহাগ-১ প্রতি হেক্টর ১.৮ ও বারি-২ বারি-৩, হেক্টরপ্রতি ২.১ মেট্রিক টন হারে প্রায় ৫০ মেট্রিক টন সয়াবিন উৎপাদন লক্ষমাত্রা অর্জিত হয়।
উৎপাদিত সয়াবিন পোলট্রি খাদ্য, ফিশ ফিড, সয়া নাগেট, সয়াবিস্কুট, সয়ামিট, সাবান, সয়াদুধ, শিশু খাদ্যসহ অন্তত ৬১ ধরনের পুষ্টিকর খাদ্য ও পণ্য তৈরিতে ব্যবহার হয় বলে জানান উপজেলা কৃষি অফিস কর্মকর্তা।
কৃষকদের সঙ্গে যোগাযোগ করে জানা গেছে, বছরে দুবার সয়াবিন উৎপাদন করেন চাষিরা। প্রথমবার আশ্বিন মাসের মাঝামাঝি সয়াবিন বীজ আবাদ করা হয়, যা খরিপ-২ মৌসুম নামে পরিচিত। দ্বিতীয়বার পৌষ মাসের মাঝামাঝি থেকে মাঘ মাসের শুরুর দিকে কৃষকরা রবি শস্য হিসেবে সয়াবিনের আবাদ করেন।
উপজেলার হাজিরহাট ইউনিয়নের চর জাঙ্গালিয়া গ্রামের কৃষক মো. সেলিম বলেন, চলতি মৌসুমে প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও ভয়াবহ বন্যার কারণে পুরো এলাকা দীর্ঘদিন যাবত পানিতে নিমজ্জিত ছিল। যে কারণে সয়াবিন চাষের বীজ বপনে প্রায় এক মাস দেরি হয়েছে।
সাধারণত ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহ হতে জানুয়ারি মাসের মধ্যে সয়াবিন বীজ বপন করতে হয়। সেক্ষেত্রে এবার প্রায় এক মাস দেরিতে বীজ বপন করতে হয়েছে। তবে দেরিতে বীজ বপন করলেও গাছে ফল আসতে শুরু করেছে। প্রাকৃতিক দূর্যোগ থেকে রক্ষা পেলে এবারও ভালো ফলন ঘরে তুলতে পারবেন বলে তিনি আশা করেন।
কমলনগরের চর মার্টিন ইউনিয়নের কৃষক মো. সাইফুল্লাহ বলেন, কৃষি অফিস থেকে বীজ সহায়তা পেয়ে এক একর জমিতে সয়াবিন আবাদ করেছেন তিনি। বৃষ্টি না হওয়ার ফলে গাছে ফল আসলেও দানা পুষ্ট হচ্ছে না। কৃষি অফিসের লোকজনের পরামর্শ অনুযায়ী পরিচর্যা করছি। তবে বৃষ্টি খুব দরকার বলে জানান তিনি।
রামগতির চর পোড়াগাছা গ্রামের কৃষক সফিক জমাদার বলেন, এ বছর দুই একর জমিতে সয়াবিন চাষ করেছি। এখানকার মাটির গুণাগুণ ভালো। তাই ফলন ভালো হয়। ১৫ বছর ধরে ধান, সয়াবিন ও সবজির চাষ করছি। প্রতি বছরই প্রাকৃতিক দুর্যোগ আর অতিরিক্ত জোয়ারের পানিতে ক্ষতির সম্মুখীন হতে হয়। এই ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে সরকারি সহযোগিতা পেলে সয়াবিন চাষের প্রতি আরও আগ্রহ বাড়বে বলে জানান তিনি।
স্থানীয় আছিয়া পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষক সারোয়ার মিরন বলেন, রামগতি ও কমলনগরে উৎপাদিত সয়াবিন স্থানীয় বাজারসহ দেশের বিভিন্ন বাজারে যাচ্ছে। খাদ্য উৎপাদনে রামগতির কৃষকরা ভূমিকা রাখছেন। কিন্তু কৃষিপণ্য বাজারজাতের ক্ষেত্রে কৃষকদের ঠকতে হয়। তারা ন্যায্য মূল্য পান না। পণ্য বাজারজাতে সংশ্লিষ্টদের সহযোগিতা প্রয়োজন। এতে কৃষি উৎপাদনে উৎসাহিত হবেন কৃষকরা।
উপজেলার আশ্রম পোলেরগোড়া এলাকার স্মার্ট সয়াবিন ক্রয়-বিক্রয় প্রতিষ্ঠানের মালিক জসিম উদ্দিন বলেন, মৌসুমে প্রতি মণ সয়াবিন ২ হাজার ৫০০ টাকা থেকে ৩ হাজার টাকা দরে বিক্রি হয়। এতে স্থানীয় বাজারেই লেনদেন হয় অন্তত দেড়শ কোটি টাকার বেশি। এতে কৃষক ও ব্যবসায়ী উভয়ই লাভবান হন।
কমলনগর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা (রামগতিতে অদা:) মোহাম্মদ শাহীন রানা বলেন, দেশের অন্যান্য উপজেলার তুলনায় রামগতি ও কমলনগরে অধিক পরিমাণে সয়াবিনের চাষ হয়। এখানকার কৃষকরা সয়াবিন চাষের প্রতি খুবই আগ্রহী, যে কারণে কৃষি অফিস থেকে কৃষকদের বীজ ও সার সাপোর্ট দেওয়া হয়েছে।
তিনি বলেন, সাধারণত ১০০ দিনের মধ্যে সয়াবিনের ফসল ঘরে তোলা যায়। সেক্ষেত্রে এবার প্রাকৃতিক দূর্যোগ আর বন্যার কারণে এখানকার বীজতলা পানিতে নিমজ্জিত থাকায় বীজ বপনে কৃষকদের ১ মাস দেরি করতে হয়েছে। তারপরেও প্রাকৃতিক দূর্যোগ থেকে রক্ষা পেলে লক্ষমাত্রা অর্জন হবে বলে আশা করছেন তিনি।
