Logo
Logo
×

সারাদেশ

জয়পুরহাটে ট্রান্সফরমার-মিটার চুরির মহোৎসব

সেচ মালিকরা চরম বিপাকে

Icon

জয়পুরহাট প্রতিনিধি

প্রকাশ: ১৮ এপ্রিল ২০২৫, ০৮:৩৭ পিএম

জয়পুরহাটে ট্রান্সফরমার-মিটার চুরির মহোৎসব

ফাইল ছবি

জয়পুরহাটে যেন বৈদ্যুতিক ট্রান্সফরমার ও মিটার চুরির মহোৎসব শুরু হয়েছে। জেলার পাঁচটি উপজেলার বিভিন্ন এলাকার বিস্তীর্ণ ধানখেত থেকে ৯ মাসে বিদ্যুৎচালিত সেচযন্ত্রের ৭১টি মিটার ও ১৬১টি ট্রান্সফরমার চুরির ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে কেবল কালাই উপজেলাতেই চুরি হয়েছে ৭৬টি ট্রান্সফরমার। আর সবচেয়ে বেশি মিটার চুরি হয়েছে আক্কেলপুরে ২৯টি।

সংঘবদ্ধ একাধিক চোর চক্র গোপনে চিঠি দিয়ে চাঁদা দাবি করে অথবা রাতে পাহারাদার ও ড্রেন ম্যানদের মারপিট করে বেঁধে রেখে ধানখেত (ফসলের মাঠ) থেকে চুরি করে নিয়ে যাচ্ছে উল্লেখিত মূল্যবান বৈদ্যুতিক মিটার ও ট্রান্সফরমার। 

চলতি বোরো মৌসুমে বিস্তীর্ণ মাঠে (ধানখেতে) সেচ সুবিধা প্রদানের জন্য জেলায় বিদ্যুতচালিত প্রায় ৭ হাজার গভীর ও অগভীর নলকূপ স্থাপন করা হয়েছে। এসব মাঠ থেকে প্রায়ই কোনো না কোনো সেচযন্ত্রের ট্রান্সফরমার ও মিটার চুরির ঘটনা ঘটছে। চুরির পর সেচযন্ত্রের মালিকদের কাছে বিকাশ বা নগদ নম্বর পাঠিয়ে চাঁদা দিতে বাধ্য করছে সংঘবদ্ধ চোর চক্র।

পুলিশি অভিযানে এ চক্রের ২-৪ জন আটক ও কিছু চোরাই মালামাল উদ্ধার হলেও এই চক্রের দৌরাত্ম্য কমেনি। এমন অবস্থায় একদিকে সেচযন্ত্রের নিরাপত্তা এবং অপরদিকে ধানখেতে প্রয়োজনীয় সেচকার্য পরিচালনা নিয়ে সেচযন্ত্রের মালিকরা পড়েছেন চরম বিপাকে।

জয়পুরহাট পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির দেওয়া তথ্যানুসারে, গত ৯ মাসে জেলার ৫টি উপজেলার বিভিন্ন এলাকার মাঠের সেচ প্রকল্পের গভীর ও অগভীর নলকূপের ১৬১টি ট্রান্সফরমার ও ৭১টি মিটার চুরি হয়েছে। এর মধ্যে জয়পুরহাট সদরে ১৪টি, পাঁচবিবিতে ৩৬টি, কালাইয়ে ৭৬টি,  ক্ষেতলালে ১৪টি ও আক্কেলপুর উপজেলায় ২১টি।

আর সেচযন্ত্রের বৈদ্যুতিক মিটার চুরির ঘটনা ঘটেছে- জয়পুরহাট সদরে ৩টি, পাঁচবিবিতে ১০টি, কালাইয়ে ১৫টি, ক্ষেতলালে ১৪টি ও আক্কেলপুরে ২৯টি।

  

অন্যবারের চেয়ে চলতি বোরো মৌসুমে ট্রান্সফরমার ও মিটার চোর চক্রের চাঁদাবাজি বেশি বেড়েছে।

জানা গেছে, ক্ষেতলাল উপজেলার মামুদপুর ইউনিয়নে সেচমালিকদের কাছে বিকাশ নম্বর পাঠানো হয়েছে। ফোনে ২০ হাজার টাকা চাঁদা দাবি করা হয়েছে প্রত্যেক সেচযন্ত্র মালিকের কাছে। টাকা না দিলে সেচযন্ত্র বন্ধ থাকবে বলে হুমকি দেওয়া হচ্ছে। 

ক্ষেতলাল উপজেলার দক্ষিণ বস্তা গ্রামের শওকত আলীর বিদ্যুতচালিত গভীর নলকূপ থেকে গত ৩ এপ্রিল রাতে মুখোশধারী একদল দুর্বৃত্ত ধারালো অস্ত্র ধরে ড্রেনম্যান এর হাত-পা বেঁধে ১০ কেভির ৩টি ট্রান্সফরমার, খুঁটি থেকে বিদ্যুতের তার এবং ব্যারেল খুলে নিয়ে গেছে। সেই থেকে প্রায় ১০ দিন সেচ কার্যক্রম বন্ধ থাকে ওই গভীর নলকূপে।

এ ঘটনার ১৫ দিন আগে ওই সেচযন্ত্র থেকে বৈদ্যুতিক মিটারও চুরি হয়। একইভাবে ক্ষেতলালের মামুদপুর ইউনিয়নের প্রায় ৩০টি গভীর নলকূপ মালিকদের চাঁদার জন্য চিঠি দেওয়া হয়েছে। তাদের ২০ হাজার টাকা করে চাঁদা না দিলে সেচ কাজ বন্ধ থাকবে বলে মোবাইলে হুমকিও দেওয়া হয়েছে। এ ঘটনার পর ভয়ে অনেক সেচ মালিক চোরদের দেওয়া বিকাশ নাম্বারে টাকা দিতে বাধ্য হয়েছেন বলে দাবি ভুক্তভোগী সেচযন্ত্রের মালিকদের।

সেচযন্ত্রের মালিকরা জানান, মিটার চুরির পর চোরদের টাকা দিয়ে মিটার ফেরত পেলেও পল্লী বিদ্যুৎ কর্তৃপক্ষ সেই মিটার আর গ্রহণ করছেন না। ফলে একদিকে চোরদের টাকা দিতে হচ্ছে, অন্যদিকে নতুন মিটার কিনতেও অতিরিক্ত অর্থ ব্যয় করতে হচ্ছে। আর চুরির পর ১০ কেভির তিনটি ট্রান্সফরমার কিনতে খরচ পড়ছে ২ লাখ ১০ হাজার টাকা। অসময়ে অতিরিক্ত টাকা খরচ করে সেচ কার্যক্রম চালাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে তাদের।  

ক্ষেতলাল উপজেলার দক্ষিণ বাসতা গ্রামের গভীর নলকূপের মালিক শাহিন আলম বলেন, চোরের দল গত ১৫ মার্চ তার গভীর নলকূপ থেকে মিটার চুরি করে। পরে তাদের ১০ হাজার টাকা দিয়ে মিটার ফেরত পেলেও পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি সেই মিটার বাতিল করে। ফলে আবার ১৪ হাজার টাকা দিয়ে মিটার কিনতে হয়েছে। আবার গত ৩ এপ্রিল ওই গভীর নলকূপ থেকে ১০ কেভির ৩টি ট্রান্সফরমারও ডাকাতি স্টাইলে পাহারাদারের হাত-পা বেঁধে চুরি করে চোরের দল। ১০ দিন পর যা সচল করতে তাদের খরচ হয়েছে ২ লাখ ৭০ হাজার টাকা। এভাবে চলতে থাকলে আগামীতে হয়তো সেচ কার্যক্রম বন্ধ রাখতে হবে। 

মহব্বতপুর গ্রামের গভীর নলকূপ মালিক মিলন হোসেন বলেন, চোরেরা ২০ হাজার টাকা চাঁদা দাবি করে তাকেসহ এলাকার প্রায় ৩০টি নলকূপ মালিকদের বিকাশ নাম্বার পাঠিয়ে হুমকি দিয়ে গেছে। টাকা না দিলে সেচ বন্ধ করারও হুমকি দিয়েছে। ধান বাঁচানোর স্বার্থে অনেক সেচমালিক চোরদের বিকাশ নাম্বারে টাকা দিয়ে সেচযন্ত্র সচল রেখেছেন। বিষয়টি ক্ষেতলাল থানায় অভিযোগ করেও কোনো সুফল মেলেনি।

ওই এলাকার মিনিগাড়ি গ্রামের গভীর নলকূপ মালিক সুলতান মাহমুদ বলেন, মীর্জাপুর মৌজার তার গভীর নলকূপ থেকে চোরের দল ঈদের পর মিটার চুরি করলে সেচ বন্ধ থাকে। পরে যোগাযোগ করে বিকাশ নাম্বারে ২০ হাজার টাকা দিলে তারা মিটার যথাস্থানে দিয়ে যায়।

তিনি বলেন, শুধু আমি নই, এ অঞ্চলের বিভিন্ন মাঠে আমাদের গ্রামেরই ১০টি গভীর নলকূপ আছে। যাদের প্রত্যেকেই চোরদের বিকাশে টাকা দিয়ে সেচযন্ত্র সচল রেখেছেন। 

ক্ষেতলাল চৌমুহনী বাজারের সার ও কীটনাশক ব্যবসায়ী শাহজামান তালুকদার বলেন, যেভাবে সেচযন্ত্র থেকে একের পর এক মিটার ও ট্রান্সফরমার চুরি হচ্ছে, তাতে নিরাপদে ফসল চাষ করা কঠিন হয়ে পড়ছে। চোরেরা প্রকাশ্যে বিকাশ নাম্বার দিয়ে চাঁদাবাজি করলেও দেখার কেউ নেই।  

জয়পুরহাট পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির জেনারেল ম্যানেজার (জিএম) আবু ঈমাম মো. মাহবুবুল হক এলাকায় ব্যাপকভাবে ট্রান্সফরমার ও মিটার চুরিতে উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেন, বিগত ২০২২ সালের জুলাই থেকে ২০২৫ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত জেলায় ৪৯৬টি ট্রান্সফরমার চুরি হয়েছে। যার দাম ৩ কোটি ৮৯ লাখ ৮৬ হাজার ৮৮৭ টাকা। এছাড়া মিটার চুরি তো আছেই। জেলায় মোট ৬ হাজার ৯৫২টি ট্রান্সফরমারের মাধ্যমে সেচ কার্যক্রম চলছে। এতগুলো সেচযন্ত্রে নিরাপত্তা দেওয়া পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির পক্ষে সম্ভব নয়। এজন্য পুলিশ প্রশাসনের পাশাপাশি সব মহলকেই এগিয়ে আসতে হবে।

এ ব্যাপারে জেলা প্রশাসক ও জেলা সেচ কমিটির সভাপতি আফরোজা আকতার চৌধুরী বলেন, সেচযন্ত্রের মিটার ও ট্রান্সফরমার চুরি বন্ধে পুলিশি তৎপরতার পাশাপাশি প্রশাসনও সহযোগিতা করছে। আশা করছি খুব শিগগিরই এ পরিস্থিতির অবসান ঘটবে।

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম