সালথায় পেঁয়াজ সংরক্ষণের মডেল ঘর নির্মাণে অনিয়মের অভিযোগ
ফরিদপুর ব্যুরো
প্রকাশ: ০৩ মে ২০২৫, ০৬:৫১ পিএম
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
ফরিদপুরের সালথায় পেঁয়াজ সংরক্ষণের মডেল ঘর নির্মাণে অনিয়ম চলছে। প্রকৃত যোগ্য কৃষকদের বাদ দিয়ে টাকার বিনিময়ে অযোগ্য কৃষকদের ঘর বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। এদিকে যারা এই মডেল ঘর পেয়েছেন, তাদের নির্মাণ কাজ এখনো শেষ হয়নি। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা এবং ঠিকাদার এ অনিয়মের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত বলে জানিয়েছেন ভুক্তভোগীরা।
জানা গেছে, গত বছর ফলন ও দাম ভাল হওয়ায় প্রতিবছরই ফরিদপুর জেলায় বাড়ছে পেঁয়াজের আবাদ। পেঁয়াজ আবাদের জন্য দ্বিতীয় বৃহত্তম জেলা ফরিদপুর। ধান পাটের পাশাপাশি এ অঞ্চলের কৃষকেরা ব্যাপক হারে পেঁয়াজ চাষাবাদ করেন। তবে সংরক্ষণের অভাবে অনেক পেয়াজ নষ্ট হয়। এতে কৃষক সঠিক দাম থেকে বঞ্চিত হন।
সংরক্ষণের অভাবে এখানকার উৎপাদিত পচনশীল ফসল পেঁয়াজের ২৫ থেকে ৩০ শতাংশই নষ্ট হয়ে যাওয়ার কারণে পেঁয়াজ চাষিরা ক্ষতিগ্রস্ত হন।
ফরিদপুর জেলার মধ্যে বেশি পেয়াজ আবাদ হয় সালথা, নগরকান্দা, ফরিদপুর সদর, বোয়ালমারী, সদরপুর ও ভাঙ্গা উপজেলায়। জেলায় পেঁয়াজ সংরক্ষণের জন্য সরকারিভাবে উদ্যোগ নেওয়ার দাবি জানিয়ে আসছিল প্রান্তিক পেঁয়াজ চাষিরা।
এ বছর কৃষি বিপণন অধিদপ্তর কর্তৃক বাস্তবায়নাধীন কৃষক পর্যায়ে পেঁয়াজ ও রসুন সংরক্ষণ পদ্ধতি আধুনিকায়ন এবং বিপণন কার্যক্রম উন্নয়ন প্রকল্পের অধীনে সালথায় ৪৫টি সংরক্ষণ ঘরের বরাদ্দ দেওয়া হয়।
এদিকে সালথা উপজেলা কৃষি অফিস থেকে কৃষকদের নাম পাঠালেও তাদের পাঠানো তালিকার কোনো ঘর পাননি বলে দাবি করেছেন কৃষকরা।
কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের মাঠ কর্মকর্তা শাহজাহান আলী ও আধুনিক পদ্ধতিতে পেঁয়াজ ও রসুন সংরক্ষণাগার নির্মাণ প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক হেলাল উদ্দিনের যোগসাজশে ১০ হাজার থেকে এক লাখ টাকার বিনিময়ে এসব ঘর দেওয়া হয়েছে বলে অভিযোগ করেন ঘর বঞ্চিত কৃষকরা। ঘর নির্মাণ অথবা বিতরণের বিষয়ে কোনো মতামত নেওয়া হচ্ছে না সালথা উপজেলা প্রশাসন ও কৃষি অফিসের।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, পাঁচ লাখ ৯০ হাজার টাকা ব্যয়ে বাড়ির উঠান কিংবা ফাঁকা জায়গায় মাত্র এক শতাংশ জমিতে ১২টি সিমেন্টের তৈরি খুটি, টিন-বাঁশ, লোহা ও কংক্রিটের সমন্বয়ে তৈরি করা হচ্ছে।
এই ঘরের আয়তন প্রায় ৩৭৫ বর্গফুট। প্রতিটি ঘরে বাতাস চলাচলের জন্য ছয়টি বায়ু নিষ্কাশন পাখা সংযুক্ত রয়েছে। মূলত ভ্যান্টিলেশনের পর্যাপ্ত ব্যবস্থা থাকার কারণেই সংরক্ষিত পেঁয়াজ পঁচন থেকে রক্ষা পাবে। তাপমাত্রা ও আর্দ্রতা পরিমাপের জন্য প্রতিটি ঘরে হাইগ্রোমিটার থাকবে।
প্রতিটি ঘরে সংরক্ষণ করা যাবে সাড়ে ৩শ’ থেকে ৪শ’ মণ পেঁয়াজ। প্রতিটি ঘরে আলাদা আলাদা স্তরে পেঁয়াজ সংরক্ষণ করতে পারবেন অন্তত পাঁচজন কৃষক। এ ঘরে ৯ মাস পর্যন্ত পেঁয়াজ ভালো থাকবে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
গত বছরের নভেম্বর মাসে ফরিদপুরের মেসার্স জাকির এন্ড ব্রাদার্স ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান সাত শতাংশ লেস দিয়ে পাঁচ লাখ ৯০ হাজার টাকা ব্যয়ে এ ঘরগুলোর কাজ শুরু করে।
চলতি বছরের ৩০ মার্চ ঘরের কাজ শেষ করার কথা থাকলেও ঠিকাদার ও দায়িত্বশীল কর্মকর্তাদের উদাসীনতার কারণে অধিকাংশ ঘরের কাজ এখনো সম্পূর্ণ করতে পারেনি।
এমনকি কিছু কিছু ঘরের কাজ এখনো শুরুই করা হয়নি। পেঁয়াজ ও রসুন সংরক্ষণের দেশীয় মডেল ঘরের আশায় পেঁয়াজ চাষিরা তাদের পুরাতন ঘর মেরামত না করায় এখন পেঁয়াজ নিয়ে বিপাকে পড়েছেন।
অনেকে নিরুপায় হয়ে পেঁয়াজ সংরক্ষণ করতে না পেরে মৌসুমের শুরুতে কম দামে বিক্রি করে দিতে বাধ্য হয়েছেন। এ ছাড়া মডেল ঘর পাওয়ার জন্য সালথা উপজেলা কৃষি অফিসে ৭০ জন কৃষক আবেদন করেও তারা ঘর পাননি বলে জানিয়েছেন।
কৃষি অফিস যাচাই-বাছাই করে ৩০ জন কৃষকের নাম পকল্প পরিচালকের কাছে পাঠানো হয়। কিন্তু এই তালিকা থেকে কাউকেই ঘর বরাদ্দ দেওয়া হয়নি।
কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের মাঠ কর্মকর্তা শাহজাহান আলী ও আধুনিক পদ্ধতিতে পেঁয়াজ ও রসুন সংরক্ষণাগার নির্মাণ প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক হেলাল উদ্দিনের যোগসাজশে কৃষি বিভাগের তালিকার কৃষকেরা ঘর না পাওয়ায় তাদের মধ্যে ক্ষোভ দেখা দিয়েছে।
এ ছাড়া কৃষকদের দাবি, সালথায় যেন পেঁয়াজ সংরক্ষণের জন্য সরকার আরো ঘর বা পেঁয়াজ সংরক্ষণের বিকল্প পদ্ধতি তৈরি করে।
সালথা উপজেলা কৃষি অফিসের মাঠ কর্মীরা জানান, ৪৫টি মডেল ঘরের আওতায় ৪৫০ জন কৃষককে প্রশিক্ষণ দেওয়া কথা। প্রশিক্ষণ বাবদ প্রত্যেক কৃষকের জন্য এক হাজার করে টাকা বরাদ্দ রয়েছে।
সেই হিসেবে চার লাখ ৫০ হাজার টাকা বরাদ্দ পেয়েছে। কিন্তু মাত্র ৪০ থেকে ৫০ জনকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। এতে কৃষকদের প্রশিক্ষণ বরাদ্দ থেকে অন্তত চার লাখ টাকা হাতিয়ে নেওয়া হয়েছে। তা ছাড়া প্রতিটি ঘরই মোটা অঙ্কের টাকার বিনিময় দেওয়া হয়েছে।
অন্যদিকে ঘর নির্মাণ কাজে নিম্নমানের সামগ্রী ব্যবহার ও ডিজাইন পরিবর্তন করে খরচ কমিয়ে টাকা হাতিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে।
সালথা উপজেলার যদুনন্দি ইউনিয়নের কাজীপাড়ার শাখাওয়াত হোসেন বলেন, আমি এই বছর ৬শ’ থেকে ৭শ’ মন পেঁয়াজ পেয়েছি। পেঁয়াজ ও রসুন সংরক্ষণের দেশীয় মডেল ঘরের আশায় আমি পেঁয়াজ সংরক্ষণের জন্য বিকল্প ব্যবস্থা করিনি। ঘরের ঠিকাদারের চাহিদামতো টাকা না দেওয়ায় আমার ঘরের কাজ এখনো শুরু করা হয়নি। বাধ্য হয়ে কম দামে পিঁয়াজ বিক্রি করে দিয়েছি। এতে আমার কয়েক লাখ টাকার ক্ষতি হয়েছে।
স্থানীয় গট্টি ইউনিয়নের কানাইড় গ্রামের এক বাসিন্দা বলেন, আমি ১০ হাজার টাকা খুশি হয়ে শাহজাহান স্যারকে দিয়েছি। অন্যরা ৫০ হাজার থেকে এক লাখ টাকা পর্যন্ত দিয়ে ঘর পেয়েছে।
রামকান্তুপুর ইউনিয়নের নারানদিয়া গ্রামের শাহিদ মিয়া বলেন, টাকা ছাড়া কি ঘর পাওয়া যায়? ঘর পেতে ৫০ হাজার টাকা লাগে।
বল্লভদী ইউনিয়নের পিশনাইল গ্রামের নান্নু মোল্যা বলেন, ঘরের সব খরচ সরকার বহন করার কথা থাকলেও মিস্ত্রি খাবারের খরচ আমাদের বহন করা লাগছে। এ ছাড়া আমরা ঘরের ফ্লোরে বালু না দেওয়া পর্যন্ত ঠিকাদারের লোক কাজে আসবে না বলে জানিয়ে দিয়েছে। তাই ঘরের ফ্লোরের বালুও আমরা দিয়েছি।
ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান মেসার্স জাকির এন্ড ব্রাদার্সের স্বত্বাধিকারী মো. জাকির হোসেন বলেন, আমরা কোনো অতিরিক্ত টাকা পয়সা নিচ্ছি না। ঘর তৈরির কারিগরদের স্বেচ্ছায় খাওয়াচ্ছে কৃষক নিজেরাই। আর যে সব ঘরে বেশি বালু লাগছে সেই ঘরে কৃষকই বালু ফেলে দিচ্ছে। যে ঘরগুলোতে বেশি মেটেরিয়ালস খরচ হচ্ছে সেই বেশি মেটেরিয়ালসের টাকাগুলো কৃষকদের দেওয়ার জন্য বলা হচ্ছে। কারণ সমতল জায়গায় ঘরগুলো করার কথা ছিল। অনেক কৃষক সেই সমতল জায়গায় ঘরগুলো করছেন না বিধায় এই সমস্যাটা তৈরি হচ্ছে।
কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের মাঠ কর্মকর্তা শাহজাহান আলী টাকা নেওয়ার বিষয়টি অস্বীকার করে বলেন, সালথায় সরকারি ঘর বরাদ্দের চেয়ে চাহিদা বেশি থাকায় আমরা সবাইকে ঘর দিতে দিতে পারিনি। তাই আমার নামে নানা কথা বার্তা বলছে।
সালথা উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা সুদর্শন শিকদার বলেন, মডেল ঘর পাওয়ার জন্য সালথা উপজেলা কৃষি অফিসে ৭০ জন কৃষক আবেদন করেন। কৃষি অফিস যাচাই-বাছাই করে ৩০ কৃষকের নাম প্রকল্প পরিচালকের কাছে পাঠানো হয়। কিন্তু এই তালিকা থেকে কাউকেই ঘর বরাদ্দ দেওয়া হয়নি। এ ছাড়া কারা এসব ঘর পেয়েছে সেই বিষয়েও আমাদেরকে অবগত করা হয়নি।
সালথা উপজেলা ইউএনও আনিছুর রহমান বালী বলেন, ঘর বিতরণ, নির্মাণ ও টাকা নেওয়ার বিষয়ে আমাদের কাছে কেউ লিখিত অভিযোগ দিলে তদন্ত করে দোষীদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেব।
আধুনিক পদ্ধতিতে পেঁয়াজ ও রসুন সংরক্ষণাগার নির্মাণ প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক হেলাল উদ্দিন বলেন, এই মডেল ঘরগুলো পাওয়ার জন্য গণবিজ্ঞপ্তি দেওয়া হয়েছিল। কৃষকদের আবেদনের প্রেক্ষিতে যাচাই-বাছাই করে ঘরগুলো কৃষকদের সুবিধার্থে বিনামূল্যে দেওয়া হয়েছে। টাকা পয়সা নিয়ে ঘর দেওয়ার ব্যাপারে আমরা অবগত নই। আর আমাদের ডিজাইনের বাহিরে ঘর করা বা বাড়তি টাকা নিয়ে ঠিকাদার ঘর করে দিবে এই ধরনের কোনো সুযোগ রাখা হয়নি। টাকা পয়সা লেনদেনের বিষয়ে যদি কোনো কৃষক আমাদের কাছে লিখিত অভিযোগ দেয় তাহলে তদন্ত করে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করব।
তিনি বলেন, নিয়ম অনুযায়ী এই ঘরের কাজ ৩০ মার্চ শেষ হওয়ার কথা থাকলেও বিভিন্ন কারণে সংশ্লিষ্ট ঠিকাদার ৩০ এপ্রিল পর্যন্ত সময় বাড়িয়ে নিয়েছেন। আমাদের জানা মতে প্রায় ৭০ শতাংশ ঘরের কাজ সম্পন্ন হয়েছে।
