Logo
Logo
×

সারাদেশ

বিশুদ্ধ পানির তীব্র সংকটে মেঘনার চরের মানুষ

Icon

রায়পুর (লক্ষ্মীপুর) প্রতিনিধি

প্রকাশ: ০৮ মে ২০২৫, ০৯:১৬ পিএম

বিশুদ্ধ পানির তীব্র সংকটে মেঘনার চরের মানুষ

‘জোয়ার-ভাটার সময় নোনা পানির মধ্যে খাল পাড়ে নাইম্মা (নেমে) জাল টাইন্না মাছ ধরি। নোনা পানিতে থাকতে, খেতে পুরো শরীরে চর্মরোগ দেহা দেছে (দেখা দিয়েছে)। কিচ্ছু করার নাই। স্ত্রীসহ সংসারে তিন মেয়ে খাউইন্না।’

এভাবেই সুপেয় পানির জন্য আক্ষেপ করে প্রতিবেদকের কাছে কথাগুলো বলেছেন লক্ষ্মীপুরের রায়পুর উপজেলার মেঘনা নদীর চরকাচিয়ার চরের বাসিন্দা শাহজালাল। 

তিনি বলেন, আমাগো এইহানে খাওয়ার পানির (সুপেয়) অভাব। বেশিরভাগ সময় কল নষ্ট হয়ে থাকে। এতে আমরা প্রয়োজন মত পানি পাই না। পানির তৃষ্ণা ধরলে যেখানে পানি পাই সেখান থেকেই খাই।

একই অভিযোগ করেছেন আরেক বাসিন্দা মোরশেদা বেগম। তিনি বলেন, কল অনেক দূরে, তাই ভাটার সময় নদী পাড় হয়ে ঘরে পানি নিয়ে ফিটকিরি দিয়ে ব্যবহার করছি। পানিতে ফিটকিরি দিলে পানি কিছুটা নিরাপদ হলেও নোনা তো আর যায় না। বাধ্য হয়েই পরিবারের সবারই এ পানি পান করতে হয়।

আরেক বাসিন্দা হযরত আলী মাঝি বলেন, ছেলে-মেয়েদের অসুখ যায় না। কয়দিন পর পরই অসুখ হয়। কি কারণে এতো ঘন ঘন অসুখ হয় জানি না। 

শুধু মিয়ারহাট এলাকার কাছিয়ার চর নয়, এই উপজেলার তিনটি ইউনিয়নের প্রায় ১২টি চরের চারদিকে পানি থাকলেও সংকট রয়েছে সুপেয় পানির। এসব চরে বসবাস করেন লক্ষাধিক নারী-পুরুষ ও শিশু। সেখানে অধিকাংশ পুরুষের পেশা কৃষি কাজ ও মাছ ধরা। এসব চরগুলো হলো- চর কাছিয়া, চরজালিয়া, চরইন্দ্রুরিয়া, চরঘাসিয়া, চরলক্ষি, চর পাঙ্গাসিয়া, কানিবগার চর ও মিয়ারহাট  ও পানিরঘাটসহ ১২টি চর।

সরেজমিনে উপজেলার দক্ষিন চরবংশী ইউপির কাছিয়ার চর ও মিয়ারহাটে গিয়ে দেখা গেছে, সেখানে নেই কোনো রাস্তা-ঘাট, কালভার্ট, সাঁকো। কৃষক ও জেলে পেশার মানুষের বাস সেখানে। খাল-বিল আর ক্ষেতের সরু আইল দিয়ে চলাচল করতে হয়। কখনও কখনও কাঁচা রাস্তা দেখা গেলেও বর্ষায় হাটু পরিমাণ পানি থাকে। চরে লক্ষাধিকের বেশি মানুষের বসবাস। তাদের সুপেয় পানির জন্য রয়েছে মাত্র ছয়টি গভীর নলকূপ (টিউবওয়েল)। তার মধ্যে চারটি নষ্ট হয়ে পড়ে আছে গত ১৫ বছর সময় ধরে। বাকিগুলো প্রায়ই নষ্ট।

চরের বাসিন্দা আজগর আলী বলেন, পরিবার লইয়া এ বিচ্ছিন্ন চরে থাহি (থাকি)। পানির চেয়েও বেশি সমস্যা চিকিৎসার, কোনো চিকিৎসা পাই না। অসুখ ওইলে (হলে) আমরা তো আর বুঝি না কোনডা কি রোগ, কেন ওইছে। চরে কারও অসুখ ওইলে যে দ্রুত তারে নদীর ওপার লইয়া যামু হেইডাও পারি না।

দক্ষিন চরবংশী ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আবু সালেহ মিন্টু ফরায়েজি বলেন, কাছিয়ার চরে প্রায় ২০ হাজার মানুষের বসবাস। এ ইউনিয়নের চারিদিকে মেঘনা নদী ও বঙ্গোপসাগরের লবণাক্ত পানিতে ঘেরা। গভীর নলকূপ ছাড়া নিরাপদ পানি পাওয়া যায় না। কাছিয়ার চরে জনসংখ্যার অনুপাতে টিউবওয়েলের সংখ্যা কম। বঙ্গোপসাগর মোহনা সংলগ্ন হওয়ায় প্রায়ই তলিয়ে যায় চর। এ সময় তীব্র সুপেয় পানির সংকট দেখা দেয়।

তিনি বলেন, পানিবাহিত রোগ ডায়রিয়া, টাইফয়েড ও জন্ডিস ও চর্মরোগ এসব চরাঞ্চলের মানুষের নিত্যদিনের সঙ্গী। চরবাসী যেকোনো অসুখে চিকিৎসার জন্য ছুটে যান কবিরাজ ও হাতুড়ে চিকিৎসকের কাছে। এতে হিতে বিপরীত হচ্ছে।

জানতে চাইলে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের ডা. বাহারুল আলম বলেন, চরাঞ্চলে বসবাসকারী অনেক রোগী পাই যারা পানিবাহিত রোগে আক্রান্ত হওয়ার পর তাদের ত্বক মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। চর থেকে ২০ কিলোমিটার পাড়ি দিয়ে সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসার আগে এসব রোগীরা স্থানীয় কবিরাজের কাছে চিকিৎসা নেন। কবিরাজ তাদেরকে নিজের বানানো বিভিন্ন ওষুধ দেন। এতে হিতে বিপরীত হয়।

লক্ষ্মীপুর পরিবেশ অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক হারুন অর রশিদ পাঠান বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে নদীর পানি প্রবাহ কমে প্রতিবছরই সাগরের লবণাক্ত পানি একটা হারে নদীতে আসছে। যার কারণে জনজীবন, কৃষি, মৎস্য ও জীববৈচিত্র্য গুরুতর সমস্যার দিকে যাচ্ছে।

লক্ষ্মীপুরের সিভিল সার্জন ডা. আবু হাসান শাহীন বলেন, চরাঞ্চলে জনসংখ্যার বিপরীতে খাবার পানির উৎস্য নলকূপের পরিমাণ খুবই নগন্য। ফলে সেখানকার বসবাসকারীরা নদী-খালের পানি ব্যবহার করছে। এ কারণে দিন দিন চরাঞ্চলে মানুষের ডায়রিয়া, পেটের পীড়াসহ বিভিন্ন রোগের রোগী বাড়ছে। বিশুদ্ধ পানি পান ও ব্যবহারের জন্য তাদেরকে কাউন্সিলিংয়ের মাধ্যমে সচেতন করা হবে।

লক্ষ্মীপুর জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের নির্বাহী প্রকৌশল বিলকিস আক্তার  বলেন, চরাঞ্চলের সুপেয় পানির সংকট কাটানোর জন্য চেষ্টা করছি। ২০২৪-২৫ অর্থবছরে আমাদের প্রকল্প চলমান। মেঘনার পাড়ের তিনটি ইউনিয়নে গভীর নলকূপ স্থাপন করলে চরাঞ্চলে সুপেয় পানির সংকট কেটে যাবে।

মেঘনা বিশুদ্ধ পানি সংকট

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম