পায়ে লিখে উচ্চশিক্ষা, রাজিয়ার আশা পূরণ হবে?
ঠাকুরগাঁও প্রতিনিধি
প্রকাশ: ১৯ মে ২০২৫, ০৫:৪৯ পিএম
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
দুই হাতই প্রায় অকার্যকর। আঙুলগুলো খাটো, বাঁকা—নড়াচড়ার ক্ষমতাও নেই তেমন; কিন্তু দমে যাননি রাজিয়া খাতুন। পায়ের আঙুলে কলম ধরে একে একে পেরিয়ে এসেছেন এসএসসি, এইচএসসি, স্নাতক। মাস্টার্স পরীক্ষাও দিয়েছেন।
বৃহস্পতিবার ঠাকুরগাঁও শহরের আইনজীবী সমিতির পাশের একটি টেবিলে বসে পায়ে কলম ধরে চাকরির আবেদন লিখছিলেন রাজিয়া। একটি চাকরি- এটাই এখন তার একমাত্র চাওয়া।
রাজিয়ার বাড়ি ঠাকুরগাঁও জেলার বালিয়াডাঙ্গী উপজেলার মিস্ত্রিপাড়া গ্রামে। বাবা ফয়জুল হক দিনমজুর, মা রহিমা বেগম গৃহিণী। পাঁচ ভাইবোনের মধ্যে সবার ছোট রাজিয়া জন্ম থেকেই শারীরিক প্রতিবন্ধী। দুই হাতই প্রায় অকেজো, কিন্তু তিনি দারিদ্র্য আর শারীরিক প্রতিবন্ধকতার কাছে হার মানেননি। পায়ে লিখে চালিয়ে গেছেন পড়াশোনা।
চার ভাই কেউই প্রাথমিকের গণ্ডি পেরোতে পারেননি, অথচ রাজিয়া একাই ঠাকুরগাঁও সরকারি কলেজ থেকে ইতিহাসে স্নাতক পাশ করেছেন। ২০২১ সালে মাস্টার্স পরীক্ষায় অংশ নেন, একটি বিষয়ে অকৃতকার্য হন।
২০২৩ সালে রাজিয়া বিয়ে করেন একই এলাকার দিনমজুর আবু সুফিয়ানকে। সংসারে আসে এক কন্যাসন্তান। এখন তার বয়স তিন বছর। অভাবের সংসার হলেও ভালোবাসায় গড়ে উঠেছিল একটি ঘর; কিন্তু কয়েক মাস আগে হঠাৎ ছন্দপতন ঘটে; কাজ করতে গিয়ে দুর্ঘটনায় পড়ে আহত হন সুফিয়ান। এখন আর আগের মতো শ্রম দিতে পারেন না।
এই পরিস্থিতিতে জেলা প্রশাসকের কাছে একটি চাকরির আবেদন নিয়ে গিয়েছিলেন রাজিয়া। তিনি বললেন- ‘আমি হাত দিয়ে কিছু করতে পারি না, কিন্তু মন দিয়ে সবকিছু করতে পারি। শুধু একটি চাকরি চাই, যাতে পরিবারটা বাঁচে।’
জেলা প্রশাসক তাকে স্বামীর জন্য একটি ভ্যান বা দোকানের ব্যবস্থা করার আশ্বাস দিলেও রাজিয়া চান নিজের যোগ্যতা অনুযায়ী একটি চাকরি। তিনি বলেন, ‘কয়েকটি কোম্পানিতে ইন্টারভিউ দিয়েছিলাম। লিখিত ভালো হয়েছিল; কিন্তু সামনাসামনি গিয়ে আমার শারীরিক অবস্থা দেখে আর ডাকে না। খুব অপমান বোধ হয়। শুধু একটু সুযোগ চাই, যাতে প্রমাণ করতে পারি, আমিও পারি।’
স্বামী আবু সুফিয়ান বলেন, ‘রাজিয়া শুধু আমার স্ত্রী না, আমার অনুপ্রেরণা। সে পায়ে রান্না করে, ঘর সামলায়, সন্তানকে দেখাশোনা করে। সরকারের কাছে অনুরোধ, রাজিয়ার জন্য একটি চাকরি দেওয়া হোক।’
প্রতিবেশী সালেহা বেগম বলেন, ‘মেয়েটি অসম্ভব মেধাবী ও পরিশ্রমী। ওর মতো মানুষকে সহায়তা করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব।’
ঠাকুরগাঁও সরকারি কলেজের বাংলা বিভাগের সাবেক শিক্ষক অধ্যাপক মনোতোষ কুমার দে বলেন, ‘রাজিয়া ব্যতিক্রমী এক উদাহরণ। সে যে সাহস আর অধ্যবসায় নিয়ে পায়ে লিখে উচ্চশিক্ষা সম্পন্ন করেছে, তা সমাজে বিরল। এমন শিক্ষিত প্রতিবন্ধী নারীর জন্য চাকরির সুযোগ তৈরি করা সরকারের নৈতিক দায়িত্ব।’
