রাজশাহী বিএনপিতে বাড়ছে অভ্যন্তরীণ সংঘাত, এক মাসে নিহত ৩

রাজশাহী ব্যুরো
প্রকাশ: ২১ মে ২০২৫, ০৩:৩৮ পিএম

ফাইল ছবি
ছাত্র-জনতার রক্তক্ষয়ী গণঅভ্যুত্থানে ফ্যাসিবাদী আওয়ামী লীগ সরকারের পতনে বিএনপির মাঠের রাজনীতি চাঙা হয়। দীর্ঘ ১৭ বছর গণতান্ত্রিক আন্দোলন লড়াইয়ে ক্লান্ত বিএনপি এখন সবচেয়ে বেশি মনোযোগী আসন্ন ত্রয়োদশ জাতীয় নির্বাচনকে নিয়ে। এটিকে সামনে রেখেই দল গুছানোসহ বিভিন্ন ধরনের সাংগঠনিক কার্যক্রম পুরোদমে চালিয়ে যাচ্ছে বিএনপির নেতারা।
যদিও এর উল্টো চিত্র দেখা যায়, সারা দেশের কাছে বিএনপির ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত রাজশাহীতে। এখানে দলটির জেলা ও মহানগর বিএনপিতে বিভিন্ন গ্রুপের অভ্যন্তরীণ রেষারেষিতে চরম অস্থিরতা বিরাজ করছে। সাংগঠনিক দ্বন্দ্ব ও আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে ইতোমধ্যে বেশকিছু সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে।
শুধু মার্চে পালটাপালটি হামলা-ভাঙচুর ও সংঘর্ষে তিনজন নিহত ও বেশ কয়েকজন আহত হয়েছেন। এসব ঘটনায় প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে মামলাও হয়েছে। কমিটির বাইরে থাকা নেতাকর্মীদের অভিযোগ, দলীয় পদে থাকা বিএনপির কতিপয় নেতা পদ-পদবি ভাঙিয়ে বিভিন্ন ধরনের অনিয়মে জড়িয়েছেন।
তারা আওয়ামী লীগের দোসরদের আশ্রয়-প্রশ্রয় দিচ্ছেন। করছেন মামলা বাণিজ্য। এতে দলের ভাবমূর্তি নষ্ট হচ্ছে। ক্ষুব্ধ হচ্ছেন দলের নিবেদিতপ্রাণ নেতাকর্মীরা, যারা গত ১৬ বছর জেলজুলুমসহ স্বৈরাচারী সরকারের অবর্ণনীয় নির্যাতন-নিপীড়নের শিকার হয়েছেন।
অপর পক্ষের নেতাকর্মীদের পালটা অভিযোগ, যারা বিগত ১৬ বছর আন্দোলন-সংগ্রামে রাজনীতির মাঠে অনুপস্থিত থেকেছেন। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে তারাই এখন মাঠে-ঘাটে, পথে-প্রান্তরে বিভিন্ন ক্ষেত্রে দখলবাজিসহ নানা অপকর্মে জড়াচ্ছেন। এতে বিএনপির ভাবমূর্তি চরমভাবে ক্ষুণ্ন হচ্ছে। দলের কোনো পদে না থেকেও তারা দলের নাম ভাঙিয়ে সব অপকর্ম করে যাচ্ছেন। কেন্দ্র থেকে একাধিকবার সতর্ক করার পরও তাদের থামানো যাচ্ছে না।
জানা গেছে, ১৪ মে সন্ধ্যার পর একটি সরকারি জলাশয়ের ইজারাকে কেন্দ্র করে রাজশাহীর পুঠিয়ায় বিএনপির সক্রিয় দুই গ্রুপের মধ্যে সংঘর্ষ হয়। এ সময় বিএনপির একটি কার্যালয়ে ব্যাপক ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করা হয়। আগুন দেওয়া হয় চারটি মোটরসাইকেলে। সংঘর্ষে বিএনপির দুই গ্রুপের ১২ নেতাকর্মী আহত হন। পরে পুলিশ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে। পুঠিয়া থানার ওসি কবির হোসেন জানান, সংঘর্ষের ঘটনায় সোহাগ নামে এক বিএনপি কর্মী থানায় মামলা করেছেন। আসামিরা বিএনপির নেতাকর্মী।
উপজেলা বিএনপির সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও পৌর মেয়র আল মামুন খান ও জেলা বিএনপির সদস্য নজরুল ইসলামের অনুসারী নেতাকর্মীদের মধ্যে কোন্দল চরমে উঠেছে। এলাকায় আধিপত্য বিস্তার থেকেই এই দ্বন্দ্বের সূচনা হয় গত ৫ আগস্ট সরকার পতনের পর। মামুন খান জেলা বিএনপির আহ্বায়ক আবু সাঈদ চাঁদের অনুসারী। ফলে মামুন খানের অনুসারীরা এলাকার ফসলি জমিতে পুকুর খনন, হাটবাজার দখল থেকে সব কিছু নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিয়েছে। প্রতিদ্বন্দ্বী নজরুলের অনুসারীরা ভাগ বসাতে গেলেই সংঘর্ষের মতো ঘটনা ঘটছে। ওই ঘটনার বিষয়ে উপজেলা বিএনপির সাবেক সাধারণ সম্পাদক আল মামুন খান বলেন, যারা গত ১৬ বছর আন্দোলন-সংগ্রামে মাঠে ছিলেন না তারাই এখন দলের নাম ভাঙিয়ে নানা অপকর্ম করছেন। আমরা প্রতিবাদ করতে গেলে তারা আমার অনুসারী নেতাকর্মীদের ওপর হামলা করছে।
এদিকে তানোরে দলের অভ্যন্তরীণ কোন্দলে গত ৯ মাসে প্রতিপক্ষ গ্রুপের হামলায় বিএনপির দুই নেতা খুন হয়েছেন। ১১ মার্চ তানোরের পাঁচন্দরে দলীয় ইফতার মাহফিলের আয়োজনকে কেন্দ্র করে সংঘর্ষে গানিউল ইসলাম (৫৫) নামের এক বিএনপি কর্মী প্রতিপক্ষের হামলায় নিহত হন। ২৭ মার্চ চাঁন্দুড়িয়ায় ইফতার মাহফিল শেষে বিএনপির দুই গ্রুপের সংঘর্ষে ৭নং ওয়ার্ড কৃষক দলের সাধারণ সম্পাদক নেকশার আলী (৩৫) গুরুতর জখম হয়ে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান। দুটি হত্যা মামলাতেই আসামি করা হয়েছে তানোর পৌরসভার সাবেক মেয়র ও জেলা বিএনপির সদস্য মিজানুর রহমান মিজানকে। অপর ৪৩ আসামির সবাই স্থানীয় বিএনপি ও অঙ্গ সংগঠনের নেতাকর্মী। এ ঘটনায় মিজানসহ দুই নেতাকে দল থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে।
দলীয় নেতাকর্মীরা জানান, গোদাগাড়ী, দুর্গাপুর ও পবায়ও বিএনপির দুই গ্রুপের মধ্যে একাধিকবার সংঘর্ষ হয়েছে। এসব ঘটনায় স্থানীয় থানায় বিএনপির নেতাকর্মীরা পরস্পরের বিরুদ্ধে একাধিক মামলা করেছেন। এসব মামলা-মোকদ্দমার ফলে বিএনপিতে অস্থিরতা বিরাজ করছে। রাজশাহী মহানগর বিএনপিতেও আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে চরম অস্থিরতা বিরাজ করছে। মহানগরীতে বিএনপির এক গ্রুপ আরেক গ্রুপের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে পরস্পরের বিরুদ্ধে নানা গুরুতর অভিযোগ তুলছে। বিএনপি নেতাদের বাড়িঘরে ঘটছে হামলা-পালটাহামলা, অগ্নিসংযোগ ও লুটপাটের ঘটনা।
১০ মার্চ নগরীর দড়িখড়বনা রেলগেট এলাকায় বিএনপির দুই গ্রুপের মধ্যে ব্যাপক বোমাবাজি ও সংঘর্ষের সময় গোলাম হোসেন রকি (৪৪) নামের একজন অটোচালক নিহত হন। এ ঘটনায় শাহমখদুম থানা বিএনপির আহ্বায়ক সুমন সরদারসহ কয়েকজনকে আসামি করে হত্যা মামলা করা হয়।
নগরীর রাজপাড়া থানা বিএনপির কমিটি গঠনকে কেন্দ্র করে ২৩ জানুয়ারি যুগ্ম আহ্বায়ক রুহুল আমিন বাবলুর বাড়িতে হামলা, গুলিবর্ষণ, অগ্নিসংযোগ ও লুটপাটের ঘটনা ঘটে। প্রতিপক্ষের হামলায় বিএনপি নেতার পরিবারের নারী ও শিশুরাও সহিংস নির্যাতনের শিকার হন। এ ঘটনায় রাজপাড়া থানা বিএনপির সভাপতি মিজানুর রহমান ও সাধারণ সম্পাদক আমিনুল ইসলাম এবং সাংগঠনিক সম্পাদক মুরাদ পারভেজ পিন্টুসহ ৩১ জন বিএনপি নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে রাজশাহী মহানগর বিএনপির আহ্বায়ক এরশাদ আলী ঈশা বলেন, আমাদের কমিটি দিয়েছেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। আমরা দলীয় নির্দেশনা অনুযায়ী মাঠে কাজ করছি। কিন্তু যারা ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগের সঙ্গে আঁতাত করে আন্দোলনে নিষ্ক্রিয় ছিলেন এখন তারা দলের মধ্যে বিভ্রান্তি ও বিভাজন ছড়াচ্ছে। এতে দলের নেতার্মীদের ঐক্য নষ্ট হচ্ছে। আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের আশ্রয়-প্রশ্রয় দেওয়ার অভিযোগ অস্বীকার করেন তিনি।