Logo
Logo
×

সারাদেশ

রেললাইনের ধারে ‘লালগালিচা’

Icon

এটিএম সামসুজ্জোহা, ঠাকুরগাঁও

প্রকাশ: ২২ মে ২০২৫, ০৭:১২ পিএম

রেললাইনের ধারে ‘লালগালিচা’

রেলস্টেশনের চেনা দৃশ্য কেমন হয়? ট্রেন আসবে, হুইসেল বাজবে, যাত্রীদের ব্যস্ততা থাকবে এই তো? কিন্তু ঠাকুরগাঁওয়ের রুহিয়া রেলস্টেশনে দাঁড়ালে সেই দৃশ্য মিলবে না। বরং মনে হবে, লালগালিচা বিছানো কোনো প্রান্তরে এসে পড়েছেন আপনি। সূর্যের আলোয় চকচক করছে রেললাইন, আর দুই পাশে সারি সারি লাল রঙে রাঙানো মরিচ।

প্রথম দেখায় মনে হবে- রেললাইনের দুপাশে কারা যেন লালগালিচা বিছিয়ে দিয়েছেন। একটু কাছে গেলেই বোঝা যায়- এ গালিচা আসলে গালিচা নয়, পাকা মরিচ। শুকাতে দেওয়া হয়েছে সারি সারি লাল মরিচ। পাকা মরিচের টুকরো টুকরো রং রেললাইনের পাশে যেন মিশে গেছে প্রকৃতির ক্যানভাসে।

মরিচ চাষে এ বছর ঠাকুরগাঁওয়ে বেশ ভালো ফলন হয়েছে। কিন্তু এত মরিচ শুকানো যাবে কোথায়? কৃষকেরা খুঁজে নিয়েছেন বিকল্প। স্টেশনের আশপাশ, এমনকি লাইনের মাঝেও মাদুর পেতে সাজিয়ে দিচ্ছেন লাল মরিচ। সূর্য যখন মাথার ওপর, তখন রেললাইনই হয়ে উঠছে তাদের রোদ-মাঠ।

রুহিয়া ইউনিয়নের ঘনী মহেশপুর গ্রামের চাষি রফিকুল ইসলাম বলেন, দুই বিঘা জমিতে মরিচ করেছি। ২০ মণ শুকনা মরিচ বিক্রি করেছি ১ লাখ ৪০ হাজার টাকায়। প্রতি মণ বিক্রি হচ্ছে ৬ হাজার ৫০০ থেকে ৭ হাজার টাকায়। কাঁচা বিক্রি করলে এই দাম পেতাম না।

একই কথা সামছুল ইসলামের মুখেও। গত বছর কাঁচামরিচ বিক্রি করেছিলাম ৯০০ থেকে ১ হাজার টাকায়। এবার শুকিয়ে পাচ্ছি ৭ হাজার। লাভই লাভ।

মরিচ শুকানোর জায়গা বটে! তবে রুহিয়া স্টেশন এখন আর শুধু শুকানোর জায়গা নয়। মনে হয় যেন অস্থায়ী মরিচের আড়ত। একদিকে মরিচ ছড়ানো, অন্যদিকে মাপা, বস্তায় ভরা, ট্রাকে তোলা। স্টেশনে এসে নামছেন বিভিন্ন জেলার পাইকারেরা। দরদাম করছেন, চুক্তি করে ফিরে যাচ্ছেন।

রংপুর থেকে আসা ব্যবসায়ী ইদ্রিস আলী বললেন, এই এলাকার মরিচ রঙে ঘন, ঝাঁজে তীব্র। বাজারে কদর অনেক। প্রতিদিন এখানে ২০-২৫ লাখ টাকার মরিচ কেনাবেচা হয়।

এই লাল মরিচের ক্যানভাস দেখতে এখন ভিড় করছেন সাধারণ মানুষও। কেউ ছবি তুলছেন, কেউ ভিডিও করছেন।

ঢাকার উত্তরার বাসিন্দা সায়মা রহমান, এসেছেন ঠাকুরগাঁও ঘুরতে। বললেন, অনলাইনে ছবি দেখেই ছুটে এলাম। ভেবেছিলাম সত্যি কি এমন হয়! এসে দেখি, পুরো রেললাইনজুড়ে লাল মরিচ বিছানো। একেবারে পেইন্টিংয়ের মতো লাগছে।

রাজশাহী থেকে আসা পর্যটক রেদোয়ানুল হক, বললেন, এমন একটা রঙিন দৃশ্য দেখে অভিভূত। শহুরে জীবনে এত প্রাণবন্ত কৃষিকাজ আর দেখা যায় না। রঙ আর ঘ্রাণে মিশে আছে পরিশ্রমের সৌন্দর্য।

রুহিয়া  মহাবিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যক্ষ মামুনুর রশিদ বলেন, রেললাইন মানেই গন্তব্যের পথ। কিন্তু রুহিয়ার এই লাইন বয়ে আনছে অন্য গল্প—জীবনের গল্প। যেখানে চাষিরা রেলপথে বিছিয়ে দিচ্ছেন লাল মরিচ, আর সেই লালচে রঙে রাঙিয়ে তুলছেন নিজেদের স্বপ্ন। ট্রেন এলেও এখানে ছুটছে কাজ, ঘাম আর প্রাণের গতিরেখা।

স্থানীয় স্কুল শিক্ষক আতিকুর রহমান বলেন, পশ্চিম থেকে সূর্য ডুবছে। ট্রেন আসে, ট্রেন যায়। কিন্তু রেললাইনের পাশে লাল গালিচা বিছানো থাকে ঠিকই। আগামীকাল নতুন সকাল হলে, আবার শুরু হবে এই মরিচ উৎসবের আরেক অধ্যায়।

জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, চলতি মৌসুমে ঠাকুরগাঁওয়ের পাঁচটি উপজেলায় মোট ১ হাজার ৯৭০ হেক্টর জমিতে মরিচ চাষ হয়েছে। এর মধ্যে ১ হাজার ৩২২ হেক্টরের মরিচ ইতিমধ্যে কাটা হয়েছে। হেক্টর প্রতি গড় উৎপাদন ১ দশমিক ৯২ মেট্রিক টন।

জেলার কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের অতিরিক্ত উপপরিচালক আলমগীর কবীর বললেন, ঠাকুরগাঁওয়ের মাটি ও জলবায়ু মরিচ চাষের জন্য খুবই উপযোগী। এখানকার মরিচের রঙ গাঢ়, ঝাঁজ বেশি—যা বাজারে দারুণ কদর পাচ্ছে। এ বছর দাম ভালো, চাষিরাও খুশি।

ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলার রুহিয়া রেলস্টেশন এলাকায় কৃষকরা মাঠের জায়গার অভাবে রেললাইনের পাশে শুকচ্ছেন মরিচ। দূর থেকে দেখলে মনে হয় যেন রেলপথের দুই পাশে লাল গালিচা বিছানো। ছবি তুলেছেন বিপুল আহমেদ।

ঠাকুরগাঁও লালগালিচা রেললাইন

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম