Logo
Logo
×

সারাদেশ

ভাড়া বাসায় একসঙ্গে থাকতেন ২ শীর্ষ সন্ত্রাসী সুব্রত বাইন-মোল্লা মাসুদ

Icon

এএম জুবায়েদ রিপন, কুষ্টিয়া

প্রকাশ: ২৭ মে ২০২৫, ০৮:১১ পিএম

ভাড়া বাসায় একসঙ্গে থাকতেন ২ শীর্ষ সন্ত্রাসী সুব্রত বাইন-মোল্লা মাসুদ

আন্তর্জাতিক পুলিশ সংস্থা ইন্টারপোলের রেড নোটিশ জারি করা দেশের আন্ডারওয়ার্ল্ড কাঁপানো শীর্ষ সন্ত্রাসী সুব্রত বাইন ও পুরস্কার ঘোষিত শীর্ষ সন্ত্রাসী মোল্লা মাসুদ কুষ্টিয়া থেকে গ্রেফতার হয়েছেন। মঙ্গলবার সকাল ৭টার দিকে কুষ্টিয়া শহরের কালিশংকরপুর এলাকার একটি বাড়ি থেকে ঢাকা থেকে আসা সেনাবাহিনীর একটি টিম তাদের গ্রেফতার করে নিয়ে গেছে বলে প্রাথমিকভাবে নিশ্চিত হওয়া গেছে।

এলাকাবাসী ও প্রত্যক্ষদর্শী সূত্রে এ খবর নিশ্চিত হওয়া গেলেও কুষ্টিয়ার আইনশৃঙ্খলা বাহিনী উল্লেখযোগ্য কিছু জানাতে পারেনি। সুব্রত বাইন ও মোল্লা মাসুদের গ্রেফতারের বিষয়টি এখন পর্যন্ত সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকেও গণমাধ্যমকে নিশ্চিত করা হয়নি।

তবে স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, মঙ্গলবার ভোর ৫টার দিকে কুষ্টিয়া শহরের কালিশংকরপুর এলাকার সোনার বাংলা সড়কের পুরাতন তিনতলা একটি ভবন ঘিরে ফেলেন সেনা সদস্যরা। ওই সড়কে সেনাবাহিনীর ছয়টি গাড়ি দেখতে পান স্থানীয়রা। পরে সকাল ৭টার দিকে সেনা সদস্যরা বাড়ির ভেতরে অভিযান শুরু করেন। প্রায় এক ঘণ্টা অভিযান চালিয়ে দুইজন ব্যক্তিকে নিয়ে যেতে দেখেছেন স্থানীয় বাসিন্দারা। সুব্রত বাইন ও মোল্লা মাসুদের ছবি দেখে তারা নিশ্চিত করেছেন, ছবির মানুষ দুইজনকে ধরে নিয়ে গেছে সেনাবাহিনী।

কুষ্টিয়া মডেল থানার ওসি মোশাররফ হোসেন বলেন, দুইজনকে গ্রেফতারের বিষয়টি শুনেছি, কিন্তু নিশ্চিতভাবে সেনাবাহিনী থেকে আমাদের কিছু জানায়নি।

ওই বাড়ির প্রতিবেশী একজন জানান, প্রায় ৫ মাস আগে পুরাতন তিনতলা ভবনের নিচতলায় ভাড়া আসেন অপরিচিত এক ব্যক্তি। ওই বাড়ির মালিক চুয়াডাঙ্গা জেলা বিএনপির সাবেক সহ-সভাপতি ও আলমডাঙ্গা উপজেলা বিএনপির সাবেক সভাপতি এবং পৌরসভার সাবেক মেয়র মীর মহিউদ্দিন। দুই মাস আগে তিনি মারা যান। ওই বাসার দুই ও তিনতলায় মেস করে ভাড়া থাকেন শিক্ষার্থীরা।

স্থানীয় বাসিন্দা মাহাবুব জানান, সাদা দাড়িওয়ালা ওই ব্যক্তি সোনার বাংলা মসজিদে নামাজ পড়তেন। মাঝে মাঝে মসজিদে একসাথে দাঁড়িয়ে নামাজ আদায় করেছি; কিন্তু আজকে গ্রেফতারের পর জানতে পারলাম তিনি দেশের বড় সন্ত্রাসী। মাহাবুব বলেন, প্রায় ৪ থেকে ৫ মাস ধরে তিনি এই মসজিদে নামাজ পড়ছেন।

শেখ হাসিনা সরকারের আমলে ‘আয়নাঘর’ হিসেবে পরিচিত গোপন বন্দিশালায় বন্দি ছিলেন পুরস্কার ঘোষিত শীর্ষ সন্ত্রাসী সুব্রত বাইন। তাকে দুই বছর আয়নাঘরে আটকে রাখা হয়েছিল।

সুব্রত বাইনের এক সহযোগীর মাধ্যমে জানা গেছে, ৬ আগস্ট তাকে গোপন বন্দিশালা থেকে বের করে চোখ বেঁধে একটি গাড়িতে তোলা হয়। এরপর ঢাকার বাইরে গাজীপুরের একটি জঙ্গলের ভেতর ছেড়ে দেওয়া হয়। এরপর মুখে দাঁড়ি রেখে চেহারায় বড় পরিবর্তন করেন সুব্রত। যাতে কেউ তাকে চিনতে না পারেন। সেখান থেকে বরিশালে গ্রামের বাড়িতে কয়েক দিন থেকে ঢাকায় চলে আসেন। গত বছরের সেপ্টেম্বর মাসে ঢাকায় হঠাৎ দেখা মেলে আন্ডারওয়ার্ল্ড কাঁপানো শীর্ষ সন্ত্রাসী সুব্রত বাইনের।

আত্মগোপন থেকে তিনি বেশ কয়েকজন প্রভাবশালী ব্যক্তির সঙ্গে দেখা করেন। তারা সবাই তাকে নীরব থাকার পরামর্শ দেন। তাদের পরামর্শে ঢাকা থেকে কুষ্টিয়া শহরের কালিশংকরপুরে বাসা ভাড়া নিয়ে চলে আসেন সুব্রত বাইন ও মোল্লা মাসুদ। এরপর থেকে ওই ভাড়া বাসাতেই থাকতেন তারা।

একাধিক সূত্রে জানা গেছে, প্রায় আড়াই বছর আগে ভারতের জেলখানা থেকে ছাড়া পান শীর্ষ সন্ত্রাসী সুব্রত বাইন। এরপর ভারতীয় কর্তৃপক্ষ গোপনে পুশব্যাকের মাধ্যমে তাকে বাংলাদেশের আইন প্রয়োগকারী সংস্থার হাতে তুলে দেয়। বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে এ হস্তান্তর প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়; কিন্তু তাকে আদালতে না পাঠিয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সরাসরি গোপন বন্দিশালায় নিয়ে যায়।

অথচ এই শীর্ষ সন্ত্রাসীকে ধরতে তার মাথার ওপর ইন্টারপোলের রেড নোটিশ জারি ছিল। ২০০১ সালে বিএনপি-জামায়াত নেতৃত্বাধীন ৪ দলীয় জোট সরকারের আমলে তাকে ধরিয়ে দিতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় পুরস্কার ঘোষণা করেছিল। পুরস্কার ঘোষিত ২৩ শীর্ষ সন্ত্রাসীর অন্যতম এই সুব্রত বাইন।

নব্বইয়ের দশকে ঢাকায় সুব্রত বাইনের চাঁদাবাজি ও সন্ত্রাসের উত্থান ঘটে। চলে দখলবাজিও। তখন থাকতেন নয়াটোলা আমবাগানে। একপর্যায়ে তিনি হয়ে ওঠেন মূর্তিমান এক আতঙ্ক।

ঢাকার মগবাজার এলাকায় সুব্রত বাইন ছাড়াও মোল্লা মাসুদের পৃথক বাহিনী তৎপর ছিল। সুব্রতর নামে ৩০টিরও অধিক খুনের মামলা রয়েছে। যার প্রায় সবটিতেই সাজাপ্রাপ্ত। এছাড়া অবৈধ অস্ত্র এবং চাঁদাবাজিসহ প্রায় ১০০ মামলার আসামি তিনি।

শীর্ষ এই সন্ত্রাসী আন্তর্জাতিক পুলিশ সংস্থা ইন্টারপোলের মোস্ট ওয়ান্টেড তালিকার রেড কর্নার নোটিশপ্রাপ্ত। ২০০১ সালে ঢাকার ২৩ শীর্ষ সন্ত্রাসীকে ধরতে পুরস্কার ঘোষণা করা হলে সুব্রত বাইন ও মোল্লা মাসুদ ভারতে পালিয়ে যান। পরবর্তীকালে দুজনই গ্রেফতার হন।

সুব্রত বাইন কলকাতার কারাগার থেকে ছাড়া পাওয়ার পর পালিয়ে চলে যান নেপালে। সেখানে গিয়ে আবারও ধরা পড়েন। এরপর সুড়ঙ্গ করে নেপালেন কারাগার থেকে পালিয়ে সুব্রত বাইন আবার কলকাতায় চলে আসেন। সেখানে আবারও ধরা পড়েন। সেই থেকে কলকাতার কারাগারেই ছিলেন।

আওয়ামী লীগ আমলে সুব্রত বাইন ও মোল্লা মাসুদকে ফেরত আনতে কূটনৈতিক চ্যানেলে একাধিকবার যোগাযোগ করে সরকার। এরপর দুই বছর আগে সুব্রত বাইনকে গোপনে ফেরত পাঠানো হয়।

একটি সূত্র জানায়, ৫ আগস্টের পর গোপন বন্দিশালা থেকে সুব্রত বাইন ছাড়া পেয়ে ফের চাঁদাবাজি শুরু করেন। মগবাজারের বিশাল সেন্টার ঘিরে আবারও গড়ে তোলেন বিশাল বাহিনী। শীর্ষ সন্ত্রাসী মতিঝিলের ইখতিয়ারের (মালিবাগ সানরাইজ হোটেলে ডিবি পুলিশ হত্যা মামলার আসামি) মাধ্যমে বেশ কিছু অত্যাধুনিক অস্ত্র ক্রয় করেছেন সুব্রত বাইন। বর্তমানে থানা থেকে লুট হওয়া প্রায় ১৭টি অস্ত্র রয়েছে তার কাছে।

সুব্রত বাইনের ডান হাত খ্যাত পুরস্কার ঘোষিত আরেক সন্ত্রাসী মোল্লা মাসুদের মাধ্যমে মতিঝিল গোপীবাগের একটি ক্রীড়া প্রতিষ্ঠানের নিয়ন্ত্রণ নিয়েছিলেন সুব্রত। এছাড়া সুব্রত বাইন সুইডেন আসলামের সঙ্গে দেখা করে কারওয়ানবাজারে একসঙ্গে নিয়ন্ত্রণ করার ব্যাপারেও সমঝোতা করেছেন। এরপর থেকে তাকে ধরতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তৎপরতা শুরু করেন।

শীর্ষ সন্ত্রাসী মোল্লা মাসুদ সম্পর্কে পুলিশ সূত্র জানায়, মোল্লা মাসুদের বিরুদ্ধে সাংসদ কামাল মজুমদারের ভাগ্নে মামুন হত্যা, পুরান ঢাকায় মুরগি মিলন হত্যা, খিলগাঁওয়ের তিলপাপাড়ায় ট্রিপল মার্ডার উল্লেখযোগ্য। এছাড়া রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় তার বিরুদ্ধে চাঁদাবাজির অসংখ্য জিডি রয়েছে। ২০০১ সালে তৎকালীন সরকারের ২৩ শীর্ষ সন্ত্রাসীর তালিকার মধ্যে মোল্লা মাসুদেরও নাম ছিল।

মোল্লা মাসুদ রাজধানীর মতিঝিল ও গোপীবাগ এলাকায় সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড করতেন। শীর্ষ সন্ত্রাসী সুব্রত বাইনের হাত ধরেই মোল্লা মাসুদ অপরাধ জগতে জড়িয়ে পড়েন। তবে চারদলীয় জোট সরকারের আমলেই তিনি ভারতে পালিয়ে যান। ২০০৩ সালের পরে তাকে আর বাংলাদেশে দেখা যায়নি। ভারতে তিনি আবু রাসেল মো. মাসুদ নামে পরিচিত হন। ভারতীয় নাগরিক রিজিয়া সুলতানাকে বিয়ে করে সেখানে বসবাস করছিলেন।

কুষ্টিয়া

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম