Logo
Logo
×

সারাদেশ

কুড়িগ্রামে ভিজিএফ চাল বিতরণে অনিয়ম, তালিকায় স্বচ্ছল ও চাকরিজীবী ২ হাজার

Icon

কুড়িগ্রাম প্রতিনিধি

প্রকাশ: ১৪ জুন ২০২৫, ০৯:৪৪ পিএম

কুড়িগ্রামে ভিজিএফ চাল বিতরণে অনিয়ম, তালিকায় স্বচ্ছল ও চাকরিজীবী ২ হাজার

কুড়িগ্রামের ভূরুঙ্গামারী উপজেলার বলদিয়া ইউনিয়নে ঈদুল আযহা উপলক্ষে হতদরিদ্র জনগোষ্ঠীর জন্য বরাদ্দ দেওয়া ভিজিএফ চাল বিতরণে ব্যাপক অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে। তালিকায় দরিদ্রদের নামের পরিবর্তে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে সরকারি-বেসরকারি শিক্ষকসহ প্রায় দুই হাজার স্বচ্ছল ব্যক্তির নাম।

অভিযোগ রয়েছে এসব নামের বিপরীতে বরাদ্দ দেওয়া ১০ কেজি চালের  স্লিপ চেয়ারম্যান-মেম্বাররা ব্যবসায়ীদের নিকট বিক্রি করে দিয়েছিলেন আগেই। তবে বিতরণের সময় স্থানীয় সচেতন জনতা বাঁধা দেওয়ায় এসব বেনামী স্লিপের চাল উত্তোলন করতে পারেননি ব্যবসায়ীরা।  ৬ জুন ঈদুল আযহার আগের দিন বিতরণ শেষে গুদামে থেকে যায় প্রায় সাড়ে ১৮ মেট্রিক টন চাল।

ভিজিএফের তালিকায় অনিয়ম রয়েছে বলে এসব চাল পরবর্তীতে নির্ভুল তালিকা প্রস্তুত করে বিতরণের কথা বলেছে উপজেলা প্রশাসন। তবে এই তালিকা প্রস্তুতেও অনিয়মের আভাস পাওয়া গেছে।

সরেজমিনে গিয়ে জানা যায়, ভূরুঙ্গামারী উপজেলার ৮নং বলদিয়া ইউনিয়নে ঈদুল আযহা উপলক্ষে পাঁচ হাজার ৭৪৫ জন হতদরিদ্র মানুষের জন্য ৫৭ দশমিক ৪৫ মেট্রিক টন চল বরাদ্দ দেয়া হয়। জনপ্রতি হতদরিদ্র মানুষ পাবেন ১০ কেজি করে চাল। এসব হতদরিদ্র মানুষের তালিকা চেয়ারম্যান-মেম্বাররা প্রস্তুত করেন। পরে উপজেলা কমিটি যাচাই-বাছাই করে তালিকা অনুমোদন দেয়। 

তবে ৮নং বলদিয়া ইউনিয়নের হতদরিদ্র মানুষের নাম বাদ দিয়ে প্রায় দুই হাজার স্বচ্ছল ও চাকরিজীবীদের নাম অন্তুর্ভুক্ত করা হয়। অভিযোগ উঠে গত ঈদুল ফিতরের সময়ও এই তালিকা অনুযায়ী ভিজিএফ চাল বিতরণ করা হয়েছিল। তালিকায় থাকায় প্রায় দুই হাজার স্বচ্ছল ও চাকরিজীবীদের নামে বরাদ্দকৃত চাল আত্মসাৎ করেছেন স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা।

গত ঈদুল ফিতরে এই অনিয়মের কাণ্ড প্রকাশ হলে এবার ঈদুল আযহার বরাদ্দকৃত চাল বিতরণে অভিযোগ তোলেন স্থানীয় সচেতন মহল। 

পরে তালিকায় অন্তর্ভুক্ত নামের সাথে স্লিপ প্রাপ্ত মানুষকে মিলিয়ে চাল বিতরণ করে প্রশাসন। এতে বেরিয়ে আসে তালিকায় প্রায় দুই হাজার স্লিপপ্রাপ্ত বেনামী মানুষের নাম। পরে অ-বিলিকৃত সাড়ে ১৮ মেট্রিক টন চাল নেয়ার মানুষ না পাওয়া গেলে সেগুলো ইউনিয়ন পরিষদ গুদামে সিলগালা করে রাখা হয়।

অনুসন্ধানে তালিকায় দেখা যায়, ১১৩৮ নম্বর নামের ঘরে রয়েছেন শ্রী স্বপন কুমার সরকার। তিনি বলদিয়া আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক। ২৫৭ নম্বরে রয়েছেন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক আশরাফুজ্জামান।  ২৫৮ নম্বর তালিকায় রয়েছেন প্রাথমিক বিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত সহকারি শিক্ষক আরমান আলীর নাম। ২৯২১ নম্বরে রয়েছেন রফিকুল ইসলাম নামের একজন ব্যবসায়ী। ২৯৩৯ নম্বরে রয়েছেন সেচ্ছাবেক দলের নেতা লুৎফর রহমান। ২৯৪৯ নম্বর তালিকায় রয়েছেন স্বচ্ছল ব্যক্তি আইনুল হক।

অবসরপ্রাপ্ত সহকারি শিক্ষক আরমান আলী বলেন, ভিজিএফ চাল পাওয়ার মতো ব্যক্তি আমি না। আমি কখনই ভিজিএফ চাল পাইনি। কীভাবে তালিকায় নাম আসল তা বলতে পারি না।

শিক্ষক আশরাফুজ্জামান জানান, কীভাবে ভিজিএফের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে সেটা তিনি জানেন না। ভিজিএফ তালিকায় নাম থাকায় এখন তিনি সামাজিকভাবে হেয় প্রতিপন্ন হচ্ছেন। অথচ তিনি কখনই ভিজিএফ চাল উত্তোলন করেননি বলেও নিশ্চিত করেন।

ইউনিয়নের সেচ্ছাসেবক দলের নেতা লুৎফর রহমান জানান, তার নাম ভিজিএফের তালিকায় দেখে তিনি হতভম্ব হয়েছেন। কারা তার নাম তালিকাভূক্ত করেছেন সেটা তার জানা নেই। তিনি জানান, এসব নাম দিয়ে চেয়ারম্যান-মেম্বাররা চাল বিক্রি করে দেন। তিনি তদন্ত করে বিচার দাবি করেন।

গত ৬ জুন ঈদুল আযহার আগের দিন ইউনিয়ন পরিষদের হাজারো  হতদরিদ্র নারী-পুরুষ চাল নিতে এসে সারাদিন থেকে সন্ধ্যায় খালি হাতে ফেরত যান। তারা জানান, তাদের নাম তালিকায় নাই বলে তাদের চাল দেয়া হয়নি। অথচ তারাই হতদরিদ্র। এদের মধ্যে অনেকে ঈদুল ফিতরে চাল পেলেও এবার পাননি। আব্দুল করিম, বাদশা, কাচুয়া ও রহমানসহ কয়েকজন অভিযোগ করেন তাদের স্লিপ চেয়াম্যান মেম্বাররা বিক্রি করে দিয়েছেন।

বলদিয়া ইউপি চেয়াম্যান মোজাম্মেল হক বলেন, এই তালিকা দিয়ে ঈদুল ফিতরে চাল বিতরণ করেছেন তিনি। এবারও এই তালিকা দিয়েই বিতরণ করা হয়েছে। তালিকায় ভূলক্রমে কিছু স্বচ্ছল ব্যক্তির নাম অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। তবে স্লিপ বিক্রির অভিযোগ সত্য নয় বলে দাবি করেন তিনি।

ইউনিয়নটিতে চাল বিতরণে দায়িত্বে থাকা ট্যাগ কর্মকর্তা রবিউল ইসলাম জানান, বিতরণের শেষ দিনে ১৮৪০ জন তালিকাভুক্ত ব্যক্তি চাল নিতে আসেন নাই। এসব ব্যক্তির বিপরিতে প্রায় সাড়ে ১৮ মেট্রিক টন চাল গুদামে রেখে সীলগালা করে রাখা হয়েছে।

উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা গোলাম ফেরদৌস জানান, তালিকা ত্রুটিপূর্ণ হওয়ায় চাল বিতরণ বন্ধ রাখা হয়েছে। পরবর্তীতে তালিকা নির্ভুল করে বাকি চাল বিতরণ করা হবে।

অপরদিকে, গত ৪ জুন জেলার নাগেশ্বরী উপজেলার সন্তোষপুর ইউনিয়নে গোপন সংবাদের ভিত্তিতে সেনাবাহিনী অভিযান চালিয়ে সাড়ে ৭ মেট্রিক টন ভিজিএফ চাল উদ্ধার করেছে। ইউনিয়নের আশে পাশে বিভিন্ন গুদাম থেকে বিকেল থেকে রাত পর্যন্ত অভিযান চালিয়ে এসব ভিজিএফ চাল উদ্ধার করা হয়।

উপজেলা প্রশাসন সূত্রে জানাযায়, ঈদুল আযহা উপলক্ষে ওই ইউনিয়নের ৭ হাজার ৯৬৯ দুস্থ মানুষের মাঝে ১০ কেজি করে বিতরণের জন্য ভিজিএফ প্রকল্পের প্রায় ৮০ টন চাল বরাদ্দ দেয়া হয়। কিন্তু অতি দরিদ্রদের জন্য বরাদ্দকৃত এসব চালের ১০ কেজি করে স্লিপ ব্যবসায়ীদের কাছে বিক্রি করেন ইউনিয়নের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান ও ইউপি সদস্যরা। ব্যবসায়ীরা সে সব স্লিপ চাল উত্তোলন করে পরিষদের আশপাশের বিভিন্ন গুদামে মজুদ করেন।

স্থানীয়রা বিষয়টি প্রশাসন ও সেনাবাহিনী জানার পর অভিযান চালিয়ে ইউনিয়ন পরিষদের পার্শ্ববর্তী বাজারের বিভিন্ন দোকানের গোডাউন থেকে দুস্থ মানুষের মধ্যে বিতরণকৃত খাদ্য অধিদপ্তরের সিল সম্বলিত কিছু বস্তাসহ প্রায় দুইশ বস্তা চাল জব্দ করা হয়।

এই বিষয়ে সন্তোষপুর ইউনিয়নের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান খাদিজা বেগম বলেন, পরিষদে ঠিক মতো চাল বিতরণ করা হয়েছে। বাইরে ইউপি সদস্যরা কি করেছেন আমি তা জানি না।

নাগেশ্বরী উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা সিব্বির আহমেদ চাল উদ্ধারের কথা স্বীকার করে বলেন, মামলা হবে। আদালতে প্রমাণ হবে কে দোষী।

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম