রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে নিহত সোহানকে ফেরত চায় পরিবার
পলাশ (নরসিংদী) প্রতিনিধি
প্রকাশ: ২৬ জুন ২০২৫, ০১:১৩ পিএম
ছবি: সংগৃহীত
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
রাশিয়ায় চাকরির জন্য গিয়েছিলেন সোহান মিয়া। কিন্তু দালালের খ্প্পরে নাম লেখাতে হয় রুশবাহিনীতে। নরসিংদীর পলাশ উপজেলার ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধে অংশ নেন। প্রাণও হারান। গত ২১ জুন বিকাল সাড়ে তিনটায় সোহানের বন্ধু সহযোদ্ধা জাফর ফোন করে সোহানের মাকে জানান সোহান আর নেই। পরে ফোনে সোহানের মরদেহের ছবিও পাঠায় জাফর।
মৃত্যুর খবরে সোহানের বাড়িতে শোকের ছায়া নেমে আসে। সরেজমিনে সোহানের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায় তার বাড়িসহ গোটা গ্রামে চলছে শোকের মাতম। চাকরির আশায় বিদেশ পাড়ি জমিয়ে ছিলেন উপজেলার গজারিয়া ইউনিয়নের ইছাখালী গ্রামের সোহান মিয়া ও তাঁর বোনের জামাই আকরাম মিয়া।
ইচ্ছা ছিল ইউরোপে গিয়ে নিজেদের ভাগ্য বদল করবে। সেজন্য ধারদেনা করে ১৪ লাখ টাকার বিনিময়ে দেশ ছাড়েন তারা। কিন্তু বিধি বাম! দালালচক্র তাদের রাশিয়া নিয়ে গেলেও তাদের কথামতো চকলেট কারখানায় কাজ না দিয়ে রাশিয়ার কাছে বিক্রি করে দেয়। ফলে সেদেশে গিয়ে সোহানকে ইউক্রেনের বিরুদ্ধে যুদ্ধের ময়দানে যাওয়ার জন্য অস্ত্রের প্রশিক্ষণে নামতে হয়েছে। তবে তার বোন জামাই আকরাম মিয়া কৌশলে পালিয়ে বিভিন্ন স্থানে আত্মগোপনে থেকে বাড়ি ফিরে আসেন।
সোহান মিয়া পলাশ উপজেলার গজারিয়া ইউনিয়নের ইছাখালী গ্রামের মৃত সোহরাব মিয়ার ছেলে। পরিবারে তার মা নূরুন্নাহার ও স্ত্রী হাবিবা আক্তার এবং তার ১৬ মাসের ছেলে ফারহান রয়েছে।
রাশিয়া থেকে পালিয়ে আসা সোহানের বোন জামাই সরকারচর গ্রামের কাজল মিয়ার ছেলে আকরাম মিয়া। সোহানের বড় চাচা রেজাউল আল মরিন বলেন, ঢাকার বনানীর ড্রিম হোম ট্রাভেলস থেকে জেরিন নামে এক দালালের মাধমে সাইপ্রাস যাওয়ার জন্য কাগজপত্র জমা দেন তারা। কিন্তু দীর্ঘদিন পর দালাল চক্র তাদের রাশিয়ার ভিসা করে দেন। পরে ২০২৫ সালের ২২ ডিসেম্বর ১০ জনের একটি দল রাশিয়ার উদ্দেশে রওনা হয়।
রাশিয়ার সেন্টপিটার্সবার্গ বিমানবন্দরে পৌঁছানোর পর সেখানে তাদের ৪ দিন রাখে। কিন্তু সোহানসহ আরও দুজনকে একদিন পরই সেখান থেকে নিয়ে যায় রাশিয়ার সেনাক্যাম্পে। নিয়েই শুরু হয় দালাল চক্রের অত্যাচার। যুদ্ধের প্রশিক্ষণে যেতে সামরিক পোশাক দেওয়া হয়।
প্রশিক্ষণ নিতে না চাইলে দেওয়া হয় হত্যার হুঁমকি। করা হয় মারধর, দেওয়া হত না খাবার। পরে সোহান আকরামকে এগুলো জানায় এবং সেখান থেকে পালিয়ে যেতে বলে। সোহানের দুদিন পরে আকরামেরও যাওয়ার কথা ছিল। পরে সেখান থেকে আকরাম পালিয়ে গিয়ে বাড়ির সঙ্গে যোগাযোগ করে দেড় লাখ টাকা নিয়ে টিকিট কেটে গত ১৬ জানুয়ারি ২০২৫ ফিরে আসে।
এদিকে ছেলের মৃত্যুতে সোহানের মা নূরুন্নাহারের কান্নায় আকাশ বাতাস বাড়ি হয়ে উঠছে। কতক্ষণ পরপরই জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন তিনি। কান্নাজড়িত কণ্ঠে তিনি জানান, ধারদেনা করে ৭ লাখ টাকা দিয়ে তার একমাত্র ছেলেকে বিদেশে পাঠানো হয়। সংসারের একমাত্র উপার্জনশীল ছিলেন সোহান। তিনি বলেন, এখন আমি কি করবো। যুদ্ধ চলাকালে মাঝে মধ্যে তার সঙ্গে কথা হতো। সে সারাক্ষণ কান্না করতো দেশে আসার জন্য। কাল তার বন্ধু জাফর আমাকে জানায়, সোহানের শরীরে বোমা বিস্ফোরণ হলে সে মারা যায়।
তার মা আরও বলেন, আমি দালালদের গ্রেপ্তার সহ বিচার চাই। আর যেন তাদের খপ্পরে পড়ে কোন মার বুক যেন আর খালি না হয়। সরকারের কাছে তার ছেলের লাশ ফিরে পাওয়ার আকুতি জানিয়েছেন তিনি।
সোহানের স্ত্রী হাবিবা আক্তার জানান, উৎকণ্ঠার মধ্যে দিন কাটছিল তাদের। সোহানকে ফিরিয়ে আনতে ড্রিম হোম ট্রাভেলসে যোগাযোগ করা হয়েছে অনেকবার। পুনরায় আড়াই লাখ টাকা নিয়ে বলেছিল জানুয়ারির ২৬ তারিখে এনে দেবে। কিন্তু আনা তো দুরের কথা এখন সে লাশ হয়ে গেলো।
হাবিবা আক্তার বিলাপ করে বলেন, আমরা প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়েও যোগাযোগ করেছি। তারাও কিছুই করলো না। এখন আমার ১৬ মাসের সন্তানকে নিয়ে কিভাবে বাঁচবো। আমি দালালদের বিচার চাই, শাস্তি চাই আর আমার স্বামীর লাশ যাতে দেশে আনার ব্যবস্থা সরকার করে। সরকারের যথাযথ কর্তৃপক্ষকে ব্যবস্থা নেওয়ার দাবী জানাচ্ছি।
পলাশ উপজেলা নির্বাহী অফিসার মো. আবুবক্কর সিদ্দিকী বলেন, পরিবারের পক্ষ থেকে আবেদন করলে আমরা প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে সোহানের মরদেহ দেশে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করব। তার পরিবারের জন্য উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে সব ধরনের সহযোগিতা করার ও আশ্বাস দেন তিনি।
