Logo
Logo
×

সারাদেশ

ঘুস চেয়ে আবারও বিতর্কে জড়ালেন গাজীপুরের প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা

Icon

মোহাম্মদ মোরশেদ আলম, গাজীপুর

প্রকাশ: ০১ জুলাই ২০২৫, ১০:৪৯ পিএম

ঘুস চেয়ে আবারও বিতর্কে জড়ালেন গাজীপুরের প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা

বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় নিবন্ধন, সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বরাদ্দ, শিক্ষক বদলি কিংবা বিদ্যালয় পরিদর্শন, সব ক্ষেত্রেই বড় অঙ্কের টাকা ঘুস হিসেবে নেওয়ার অভিযোগ উঠেছে গাজীপুর সদর উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা আব্দুস সালামের বিরুদ্ধে।

কথায় কথায় শিক্ষকদের দেন বাধ্যতামূলক বদলির হুমকি; বিতর্কিত কর্মকাণ্ডের কারণে হওয়া তিনটি বিভাগীয় মামলাও হয়েছে তার বিরুদ্ধে। সেগুলো তদন্ত চলমান রয়েছে।

ঘুস নেওয়ার অভিযোগ অস্বীকার করে প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা আব্দুস সালাম বলেন, বিগত সময়ে আমাকে ২২ বার বদলি করা হয়েছে। দুদকে তিনটি মামলা হয়েছে। আমাকে শাস্তিও দিয়েছে। আমার বিরুদ্ধে কেন এমনটা হচ্ছে আমি নিজেও জানি না।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, আব্দুস সালাম গত ১২ জানুয়ারি গাজীপুর সদর উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা হিসেবে যোগ দিয়েছেন। এর আগে তিনি সুনামগঞ্জের শাল্লা উপজেলা, রংপুরের গাইবান্ধা জেলা সদর, রাঙামাটির জেলার বরকল উপজেলাসহ কয়েকটি উপজেলায় প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। আগের প্রতিটি স্টেশনে তিনি দুর্নীতির সম্পৃক্ততার অভিযোগে কোথাও গ্রেড অবনমন আবার কোথাও শাস্তিমূলক বদলি হয়েছেন। কোথাও আবার দুর্নীতির অভিযোগে শিক্ষক ও এলাকাবাসী তার কার্যালয় ঘেরাও করে বিক্ষোভ করেছে। তার বিরুদ্ধে অন্তত ৩টি বিভাগীয় মামলা রয়েছে।

এছাড়া গাজীপুর সদরে যোগ দিয়ে বিভিন্ন অনিয়মের কারণে তার বিরুদ্ধে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরে অভিযোগ দিয়েছেন মো. মেহেদী হাসান নামের এক ব্যক্তি। অভিযোগের বিষয়ে কয়েক দিনের মধ্যেই তদন্ত করবে অধিদপ্তর। 

অপরদিকে গাজীপুর কেজি স্কুল অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মোছাদ্দিকুর রহমান ওই কর্মকর্তার বিরুদ্ধে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়, প্রাথমিক ও গণশিক্ষা অধিদপ্তরসহ বিভিন্ন দপ্তরে লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন। অভিযোগে বলা হয়, বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পরিদর্শনের সময় নিবন্ধনের জন্য আব্দুস সালাম ৩ লাখ টাকা করে ঘুস দাবি করেছেন। গত ২ জুন তিনি অভিযোগটি দায়ে করেন। 

কয়েকজন শিক্ষকের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় নিবন্ধন কার্যক্রমে জেলার অন্যান্য এলাকায় নিবন্ধন করতে পারলেও গাজীপুর সদর উপজেলায় তা ব্যতিক্রম। প্রয়োজনীয় তথ্য-উপাত্ত ঠিক থাকলেও নিবন্ধনের জন্য কয়েকটি স্কুল কর্তৃপক্ষের কাছে ২ থেকে ৩ লাখ টাকা ঘুস দাবি করেছেন তিনি। অনেকেই দেন-দরবার করে ৫০ হাজার থেকে দেড় লাখ টাকার মধ্যে স্কুল নিবন্ধন করেছেন। আবার অনেকেই টাকা না দেওয়ায় আটকে রাখা হয়েছে তাদের নিবন্ধন প্রক্রিয়া। 

জেলার ভাওয়াল মডেল একাডেমির পরিচালক লুৎফর রহমান বলেন, গত ৬ মে প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা মো. আব্দুস সালাম তার স্কুল পরিদর্শনে আসেন। নিবন্ধনের জন্য প্রয়োজনীয় কাগজপত্র নিয়ে তার কার্যালয়ে যেতে বলেন। এরপর তিনি সব কাগজপত্রসহ একটি ফাইল নিয়ে তার সঙ্গে দেখা করেন।

মো. লুৎফর রহমান বলেন, আমি উনার হাতে ফাইল দিলে তিনি বলেন- ফাইল ঠিক থাকলে এটা ধুইয়া পানি খান। ফাইল দরকার নাই। আমাকে টাকা দেওয়া লাগবে। অনেক দিন যাবত ব্যবসা করতেছেন।

সদর উপজেলার ভবানীপুর এলাকার মা একাডেমি স্কুলের প্রধান শিক্ষক মুসলিমা খাতুন। তিনি বলেন, নিয়ম অনুযায়ী তার স্কুলের নিবন্ধনের জন্য সব কাগজপত্র জমা দেওয়া হয়। এরপরও নিবন্ধন বাবদ ৩ লাখ টাকা দাবি করেছেন প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা আব্দুস সালাম।

সম্প্রতি আব্দুস সালামের বিরুদ্ধে উঠা অভিযোগ সম্পর্কে খোঁজ নিতে তার কার্যালয়ে গেলে সেখানে দেখা হয় গাজীপুর সদর উপজেলার বানিয়ারচালা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক শিখা আক্তারের সঙ্গে। তিনি জানান, স্কুলের মাইনর মেরামতের জন্য সম্প্রতি সদর উপজেলার তিনটি স্কুলে ২ লাখ টাকা করে বরাদ্দ আসে। বরাদ্দের টাকা ছাড় করতে আব্দুস সালাম তার অফিসের এক কর্মচারীর মাধ্যমে প্রতিটি স্কুল প্রধানের কাছে ৪০ হাজার টাকা চেয়েছেন; কিন্তু তিনি টাকা দিতে রাজি হননি।

সোমবার ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক শিখা জানিয়েছেন, বিষয়টি গণমাধ্যম কর্মীরা জেনে ফেলায় আব্দুস সালাম ৪০ হাজার টাকা ছাড়াই তার বরাদ্দের টাকা ছাড় করেছেন। তবে গণমাধ্যম কর্মীদের তথ্য দেওয়ায় তাকে দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দেওয়ার হুমকি দিয়েছেন তিনি। এছাড়া বরাদ্দ পাওয়া অন্য স্কুলের কাছ থেকে ৪০ হাজার টাকা করে নেওয়ার বিষয়ে তাকে হস্তক্ষেপ করতে নিষেধ করেছেন। 

আরও কয়েকটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের একাধিক শিক্ষক ও আব্দুস সালামের নিজ কার্যালয় গাজীপুর সদর উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসের একাধিক কর্মকর্তা-কর্মচারীর সঙ্গে কথা হয় প্রতিবেদকের। তারা আব্দুস সালামের ঘুস বাণিজ্য সম্পর্কে জানালেও গণমাধ্যমে কথা বলতে নারাজ। কয়েকজন কর্মচারী রীতিমতো ভয়ে আছেন। তাদের ধারণা, কোনো একদিন এই দুর্নীতির কারণে আব্দুস সালামের শাস্তি হলে তারাও বিপদে পড়তে পারেন। 

জেলা শিক্ষা অফিস সূত্রে জানা গেছে, আব্দুস সালামের বিরুদ্ধে শিক্ষকদের কটূক্তি, শিক্ষক বদলিতে অনিয়ম, বেসরকারি বিদ্যালয় নিবন্ধন বাণিজ্য, বই বিতরণে বৈষম্যসহ নানান অভিযোগে কয়েক দফা সংবাদ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছে। তারা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে অভিযোগও দায়ের করেন। সেই অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর গত ২১ জানুয়ারি উপ-পরিচালক তৌহিদুল ইসলামকে আহবায়ক করে তিন সদস্যবিশিষ্ট তদন্ত কমিটি গঠন করে। 

প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, মো. আব্দুস সালামের বিরুদ্ধে সরকারি কর্মচারী (শৃঙ্খলা ও আপিল) বিধিমালা, ২০১৮ এর বিধি ৩ (খ), ও ৩ (ঘ) মোতাবেক অসদাচরণ ও দুর্নীতির অভিযোগে বিভাগীয় মামলা করা হয় ২০১৮ সালে। ২০১৯ সালে এ বিষয়ে অভিযোগনামা প্রেরণ করে তার জবাব চাইলে ব্যক্তিগত শুনানিতে অংশও নেন তিনি। জবাব সন্তোষজনক না হওয়ায় মন্ত্রণালয়ের সাবেক উপসচিব নাজমা শেখকে তদন্তকারী কর্মকর্তা নিয়োগ করা হয়।

তদন্তে তার দুর্নীতি ও অনিয়মের দালিলিক প্রমাণ পেয়ে প্রতিবেদন জমা দেন তদন্তকারী ওই কর্মকর্তা। তদন্ত প্রতিবেদনের আলোকে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ সালামকে দুর্নীতির অভিযোগে বিধি ৪(৩)খ অনুযায়ী বাধ্যতামূলক অবসরের প্রাথমিক সিদ্ধান্ত নেয়। এ বিষয়ে ফের তার বক্তব্যের জন্য জবাব চায় কর্তৃপক্ষ।

মন্ত্রণালয়ের তদন্তে ‘দুর্নীতিবাজ’ হিসেবে প্রমাণিত কর্মকর্তা আব্দুস সালাম দ্বিতীয়বারও জবাব দেন। মামলায় আনিত সবগুলো অভিযোগ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয়; কিন্তু মানবিক কারণে চাকরিচ্যুতির পরিবর্তে একই বিধিমালায় বিধি ৪(৩)(ক) অনুযায়ী ৬ষ্ঠ গ্রেড থেকে নামিয়ে তাকে নবম গ্রেডে অবনমিত করা হয়।

৫ বছর পর্যন্ত এ আদেশ বলবৎ থাকার কথা বলা হয় এ সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপনে। প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সচিব ফরিদ আহাম্মদ স্বাক্ষরিত আদেশে দুর্নীতি ও অনিয়ম প্রমাণিত হওয়ায় এই শাস্তি দেওয়া হয় আব্দুস সালামকে।

প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা আব্দুস সালাম বলেন, একটি উপজেলায় এত বিদ্যালয়ের প্রয়োজন নেই। তাই তাদের স্কুলগুলো নিবন্ধন করতে চাপ দেওয়া হচ্ছে। তারা ইচ্ছামতো ব্যবসা করছেন। এখন নিবন্ধন করতে বলায় ঘুস চাওয়ার মিথ্যা অভিযোগ করছেন।

বিগত সময়ের অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, রাজনৈতিক কারণে বিগত সরকারের লোকজন তার বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছিল। সেগুলোতে শাস্তিও দিয়েছে বলে তিনি স্বীকার করেন।

জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা মাসুদ ভূঁইয়া বলেন, তার বিরুদ্ধে করা অভিযোগ মন্ত্রণালয় তদন্ত করে দেখছে। আমিও বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে দেখছি।

গাজীপুর সদর উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা শেখ মামুনুর রশিদ বলেন, তার বিরুদ্ধে আমার কাছেও অভিযোগ এসেছে। অভিযোগের বিষয়টি খতিয়ে দেখা হচ্ছে।

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম