Logo
Logo
×

সারাদেশ

ঋণে জর্জরিত সংসার, দুচোখে অন্ধকার দেখছেন শহীদ আলী হোসেনের স্ত্রী

Icon

কেন্দুয়া (নেত্রকোনা) প্রতিনিধি

প্রকাশ: ১৮ জুলাই ২০২৫, ০৫:০৭ পিএম

ঋণে জর্জরিত সংসার, দুচোখে অন্ধকার দেখছেন শহীদ আলী হোসেনের স্ত্রী

শহীদ আলী হোসেনের স্ত্রী ও তিন মেয়ে। ছবি: যুগান্তর

পরম স্নেহে কোলে নিয়ে বাবা ‘মা’ ডেকে আর কোনোদিন আদর করবে না। আর কোনো দিন ফিরে আসবে না।  আজও অবুঝ শিশুকন্যা তার বাবার কবরের পাশে বসে কাঁদে। অবুঝ সন্তানের বাবা শহীদ আলী হোসেন নিজ গ্রামের বাড়ির পেছনে চিরনিদ্রায় শুয়ে আছেন। 

কোটা সংস্কার আন্দোলন চলাকালে পানের বাক্স রেখে ছাত্রদের আন্দোলনে যোগ দিয়ে ১৮ জুলাই উত্তরা কুয়েত মৈত্রী হাসপাতাল এলাকায় পুলিশের গুলিতে শহীদ হন পান-সিগারেট বিক্রেতা আলী হোসেন (৪৪)। 

তিনি নেত্রকোনার কেন্দুয়া উপজেলার মোজাফরপুর ইউনিয়নের পশ্চিম মোজাফরপুর গ্রামের বাসিন্দা আসন আলীর ছেলে। 

১৪ বছরের বড় মেয়ে সাদিয়া আক্তার মোজাফরপুর কওমি মাদ্রাসায় পড়ে। সে বুঝতে পারছে তার বাবা আর কোনোদিন ফোন করবে না। বাড়ি এসে আদর করে পড়ার জন্য বলবে না। কিছুতেই বড় মেয়ে অবুঝ মনকে মানাতে পারছে না। বাবা হারানো কষ্ট ভুলতে পারছে না। প্রতিদিন শহীদ বাবার কবরে বাবার জন্য কেঁদে যাচ্ছে। কারো সান্ত্বনা মেনে নিতে পারছে না। 

কোটা সংস্কার আন্দোলন চলাকালে পানের বাক্স রেখে ছাত্রদের আন্দোলনে যোগ দিয়ে ১৮ জুলাই উত্তরা কুয়েত মৈত্রী হাসপাতাল এলাকায় পুলিশের গুলিতে শহীদ হন পান-সিগারেট বিক্রেতা আলী হোসেন।


এদিকে স্বামীকে হারিয়ে দিশেহারা হয়ে পড়েছেন তিন সন্তানের মা খায়রুন্নেছা আক্তার। একদিকে স্বামী হারানোর শোক, অপরদিকে দারিদ্র্য ও স্বামীর ঋণের বেড়াজাল তাকে তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে। তিন মেয়ে, অসুস্থ দেবর ও বৃদ্ধা শাশুড়ির যাবতীয় দায়িত্ব পালনে চোখে-মুখে শুধু অন্ধকার দেখছেন। বড় মেয়েটির পড়ার খরচ চালানো, অন্য দুটি সন্তানের ভবিষ্যৎ ও অসুস্থ দেবর-শাশুড়ির চিকিৎসাসহ দৈনন্দিন আর্থিক খরচ নিয়ে তিনি এখন দিশেহারা। 

স্ত্রী খায়রুন্নেছা আক্তার জানান, ২০২৩ সালে কাজের সন্ধানে বাড়ি থেকে আমরা স্বামী-স্ত্রী ঢাকায় আসি।  উত্তরা মুন্সী মার্কেট এলাকায় আমরা থাকতাম। স্বামী উত্তরা রেলগেটের কাছে রাস্তার পাশে বসে প্রতিদিন একটি বাক্সে রেখে পান সিগারেট বিক্রি করতেন, আর আমি বাসা-বাড়িতে ঝিয়ের কাজ করতাম। আমার ৩ শিশুসন্তানকে গ্রামের বাড়িতে বৃদ্ধা শাশুড়ি দেখাশোনা করতেন।

প্রতিদিনের মতো  আমার স্বামী  ১৮ জুলাই  সকাল সাড়ে ৮টার দিকে পান্তাভাত খেয়ে পান-সিগারেট বাক্স নিয়ে বের হয়ে যান। আর আমি বাসাবাড়িতে ঝিয়ের কাজ করতে চলে যাই। দুপুরে বাসায় এসে দেখি আমার স্বামী খেতে আসেনি। কোনো খোঁজখবর না পেয়ে রেলগেটে যাই। 

এক দোকানদার ভাই বলেন, বাক্সটি রেখে ছাত্রদের আন্দোলনে যাচ্ছে বলে উত্তরা কুয়েত মৈত্রী হাসপাতাল এলাকায় মিছিলে গেছেন। পরে জানতে পারলাম গোলাগুলিতে আহত হয়ে হাসপাতালে আছেন। সেখানে গিয়ে দেখি গুলিতে আমার স্বামীর নিথর দেহের বুকটা ঝাঁজরা হয়ে গেছে। পরে রাত ১২টার দিকে আমার স্বামীর লাশ হাসপাতাল থেকে গ্রহণ করে রাতেই গ্রামের বাড়ি নিয়ে শুক্রবার (১৯ জুলাই) সকালে দাফন করা হয়। 

আমার স্বামী খেটেখাওয়া মানুষ। তবে তিনি প্রতিবাদী ছিলেন। নিরপরাধ  ছাত্রদের পুলিশ নির্বিচারে গুলি করে মেরে ফেলছে। তা দেখে ছাত্রদের আন্দোলনে যোগ দেন। তারপর পুলিশের গুলিতে তাকে জীবন দিতে হলো। আমার তিনটি মেয়ে শিশু বাবার জন্য আজও কবরের পাশে গিয়ে কেঁদে যাচ্ছে। ওদের কান্না থামাতে পারছি না। এখনো বাবাকে খুঁজে। বাবা ফিরে আসবে না তা আমি অবুঝ সন্তানদের বুঝাতে পারছি না

শহীদ আলী হোসেনের স্ত্রী খায়রুন্নেছা


খায়রুন্নেছা আক্তার অভিযোগ করে  বলেন, আমার স্বামী খেটেখাওয়া মানুষ। তবে তিনি প্রতিবাদী ছিলেন। নিরপরাধ  ছাত্রদের পুলিশ নির্বিচারে গুলি করে মেরে ফেলছে। তা দেখে ছাত্রদের আন্দোলনে যোগ দেন। তারপর পুলিশের গুলিতে তাকে জীবন দিতে হলো। আমার তিনটি মেয়ে শিশু বাবার জন্য আজও কবরের পাশে গিয়ে কেঁদে যাচ্ছে। ওদের কান্না থামাতে পারছি না। এখনো বাবাকে খুঁজে। বাবা ফিরে আসবে না তা আমি অবুঝ সন্তানদের বুঝাতে পারছি না। 

ছোট ভাই আবু বক্কর বলেন, আমরা দুই ভাই। আমি দীর্ঘদিন ধরে অসুস্থ। আমার ভাই একমাত্র উপার্জনকারী ছিলেন। অভাব অনটন ও ঋণের মধ্যেই একমাত্র ভাই ও ভাবির আয়ের মাধ্যমে কোনোরকম পরিবারটি চলত। এরই মধ্যে বড় ভাই দুনিয়া ছেড়ে চলে গেল। তিন মেয়ে সন্তানের খরচ, আমার চিকিৎসা ও মায়ের ওষুধ-পথ্যসহ অনেক খরচ। 

বড় মেয়ে সাদিয়া আক্তার (১৪) জানায়, বাবা-মা আমাদের দাদুর কাছে রেখে ঢাকায় থাকতেন। আমার বাবা ঢাকার রাস্তায় বসে পান-সিগারেট বিক্রি করে যে টাকা আয় করতেন তা দিয়ে আমার পড়ার খরচসহ সংসারে দিতেন। 

আমার বাবার হত্যাকারী পুলিশের বিচার চাই। আমাদের পরিবারসহ ৩ বোনের লেখাপড়ার সুযোগ দেওয়ার জন্য সরকারের কাছে মিডিয়ার মাধ্যমে দাবি জানাচ্ছি।  বাবার স্বপ্ন ছিল আমি বড় হয়ে যেন আলেমা হই। আমি বাবার স্বপ্ন পূরণ করতে সরকারের সহযোগিতা চাই। জুলাই আন্দোলনে আমার বাবাসহ সব শহীদদের মাসিক ভাতাসহ রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি চাই। 

ঘটনাপ্রবাহ: জুলাই গণঅভ্যুত্থানের এক বছর


আরও পড়ুন

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম