ছাত্রীদের দিয়ে প্রেমের ফাঁদ পাতাচ্ছে ‘মধু চক্রটি’
পবিত্র তালুকদার, চাটমোহর (পাবনা)
প্রকাশ: ২২ জুলাই ২০২৫, ০১:৫৯ পিএম
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
পাবনার চাটমোহরে গড়ে উঠেছে একটি সংঘবব্ধ চক্র। মাদক, ব্ল্যাকমেইল আর প্রেমের অভিনয়ের মাধ্যমে চক্রটি নিঃস্ব করে দিচ্ছে স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীদের। চক্রটি দীর্ঘদিন ধরে চাটমোহর পৌর এলাকা ও আশপাশে গড়ে তুলেছে এক ভয়ংকর অপরাধ সাম্রাজ্য, যেখানে শিক্ষার্থীরাই ব্যবহার হচ্ছে প্রধান অস্ত্র হিসেবে। স্থানীয়রা চক্রটিকে ‘মধু চক্র’ নামেই চিনে। যুগান্তরের দীর্ঘ অনুসন্ধানে উঠে এসেছে এমন সব ভয়াবহ তথ্য।
জানা গেছে, চক্রটি মূলত উঠতি বয়সি নারী শিক্ষার্থীদের মাধ্যমে গড়ে তোলে
প্রেমের সম্পর্ক। সোশ্যাল মিডিয়ার ফাঁদে ফেলে কথিত প্রেমিককে ডেকে নেওয়া হয় নির্জন
কোনো স্থানে বা রেস্টুরেন্টের ‘কাপল রুমে’। সেখানে চক্রের অন্য সদস্যরা হঠাৎ উপস্থিত
হয়ে শুরু করে ভয় দেখানো। করে মারধর। হাতিয়ে নেয় অর্থ ও মোবাইল।
সবচেয়ে উদ্বেগজনক বিষয় হচ্ছে, চক্রটিতে যুক্ত রয়েছে ষষ্ঠ শ্রেণি থেকে
শুরু করে দশম শ্রেণি, এমনকি কলেজ পড়ুয়া ছাত্রীরাও। তারা কেবল প্রেমের অভিনয়েই সীমাবদ্ধ
নয় বরং অনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করে গোপনে ভিডিও ধারণ করছে। পরে এসব ভিডিও ব্যবহার করে
ব্ল্যাকমেইল করে আদায় করা হচ্ছে লাখ লাখ টাকা। কেউ টাকা দিতে ব্যর্থ হলে তাকে মারধর
করা হচ্ছে, এমনকি প্রাণনাশের হুমকিও দেওয়া হচ্ছে।
চাটমোহর পৌর শহরের নতুন বাজার এলাকার একটি স্কুলের দশম শ্রেণির শিক্ষার্থী
‘রুহানা’ (ছদ্মনাম) এবং ‘রোশনী’ নামের আরেক শিক্ষার্থীকে এই চক্রের অন্যতম চালক হিসেবে
শনাক্ত করা গেছে। স্থানীয় বখাটে যুবকদের সঙ্গে মিলে তারা প্রেমের অভিনয়ের মাধ্যমে যুবকদের
টেনে আনছে অপরাধজগতে। একইসঙ্গে মাদক সেবন, নগ্ন ভিডিও ধারণ এবং সমকামিতার মতো অপরাধও
চালানো হচ্ছে তাদের মাধ্যমেই।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, ফেসবুক, মেসেঞ্জার, হোয়াটসঅ্যাপ, ইনস্টাগ্রামসহ
বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার করে প্রথমে বন্ধুত্ব গড়ে তোলা হচ্ছে। এরপর ধাপে
ধাপে চাপে ফেলে সংগ্রহ করা হচ্ছে নগ্ন ছবি ও ভিডিও। এসব উপাদান দিয়েই শুরু হয় ব্ল্যাকমেইল।
বলা হচ্ছে, ‘যদি চাহিদা না মানো, ভিডিও ছড়িয়ে দেওয়া হবে।’ ভয়ে পড়ে অনেক শিক্ষার্থী
বাধ্য হচ্ছে তাদের সঙ্গে কাজ করতে।
চাটমোহরের চৌধুরীপাড়া, হারানমোড়, পুরাতন বাজার, নতুন বাজার, বালুচর মহল্লাসহ
বিভিন্ন এলাকায় গড়ে উঠেছে এ চক্রের ঘাঁটি। এসব এলাকার বিভিন্ন রেস্টুরেন্টের ‘কাপল
রুম’ এখন আর শুধু প্রেমিক-প্রেমিকাদের সময় কাটানোর জায়গা নয়, বরং এটি হয়ে উঠেছে অপরাধের
সূতিকাগার।
অভিযুক্ত শিক্ষার্থীদের কেউ কেউ শহরের বিভিন্ন বাসাবাড়িতে গোপন মাদক
সেবন ও যৌনাচার চালিয়ে যাচ্ছে বলেও তথ্য মিলেছে। সবচেয়ে ভীতিকর তথ্য হলো, এ চক্র থেকে
কেউ বেরিয়ে আসতে চাইলেও পারছে না। কারণ, তাদের গোপন ছবি ও ভিডিও দিয়ে করা হচ্ছে চিরস্থায়ী
ব্ল্যাকমেইল। অনেক নারী শিক্ষার্থী মানসিক বিষণ্নতায় ভুগছেন। কেউ কেউ আত্মহত্যার পথও
বেছে নিচ্ছেন বলে জানিয়েছেন স্থানীয়রা।
চাটমোহরের এক ভুক্তভোগী যুবক ইমরান হোসেন (ছদ্মনাম) যুগান্তরকে বলেন,
‘আমার কথিত প্রেমিকা আমাকে শহরের এক রেস্টুরেন্টে ডেকে নেয়। সেখানে একান্তে সময় কাটানোর
সময় হঠাৎ কয়েকজন যুবক ঢুকে আমাকে মারধর করে এবং মোবাইল কেড়ে নিতে চায়। এমনকি কথিত প্রেমিকাও
টাকা দাবি করে। আমি কোনোমতে পালিয়ে এসে প্রাণে বাঁচি।’
এদিকে, ব্ল্যাকমেইল করার একাধিক ভিডিও এবং ছবি যুগান্তরের এ প্রতিবেদকের
কাছে রয়েছে। যেখানে দেখা গেছে, দুই নারী শিক্ষার্থী
অর্ধনগ্ন অবস্থায় গাঁজা ও মদ সেবন করছেন। আরেকটি ভিডিওতে দেখা গেছে, দুই নারী শিক্ষার্থী
সমকামিতায় লিপ্ত। এসব ভিডিও ধারণ করে রাখছে কথিত প্রেমিকরা, যাতে প্রয়োজনে আবারও ব্যবহার
করতে পারে ব্ল্যাকমেইলের অস্ত্র হিসেবে।
চাটমোহর সরকারি কলেজের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের প্রভাষক মাহবুবুর রহমান বলেন,
‘বিষয়টি খুবই ভয়ংকর। যদি এখনই প্রতিরোধে ব্যবস্থা না নেওয়া হয়, তবে অচিরেই পুরোসমাজ
ব্যবস্থায় বিশৃঙ্খলা দেখা দেবে। শিক্ষার্থী, অভিভাবক, শিক্ষক এবং প্রশাসনকে একযোগে
এই অপরাধ চক্রের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে হবে।’ ওসি সনজুরুল আলম বলেন, ‘এমন কোনো অভিযোগ
পাইনি। তবে এখন যদি কেউ অভিযোগ করে, তাহলে অবশ্যই তদন্ত করে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মুসা নাসের চৌধুরী বলেন, ‘প্রতিটি স্কুলে
অভিভাবক সমাবেশ ও কাউন্সেলিংয়ের ব্যবস্থা করছি। মাদকবিরোধী অভিযানও প্রতিদিনই পরিচালনা
করা হচ্ছে। তবে এই নতুন তথ্য যাচাই করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
