Logo
Logo
×

সারাদেশ

মাইলস্টোন ট্র্যাজেডি

দুই সন্তান হারিয়ে শোকে বিহ্বল আশরাফুল-তাহমিনা দম্পতি

Icon

তুরাগ (ঢাকা) প্রতিনিধি

প্রকাশ: ২৪ জুলাই ২০২৫, ১০:৫৮ পিএম

দুই সন্তান হারিয়ে শোকে বিহ্বল আশরাফুল-তাহমিনা দম্পতি

প্রতিদিনের মতো স্ত্রী তাহমিনা আশরাফ দিয়াবাড়ির মাইলস্টোন স্কুলে গিয়েছিল ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ুয়া মেয়ে তাহিয়া আশরাফ নাজিয়া ও একই স্কুলে অধ্যয়নরত দ্বিতীয় শ্রেণির ছাত্র ছেলে আরিয়ান আশরাফ নাফিকে আনতে। দুপুরে শ্যামলী থেকে কাজ শেষে মেট্রোরেলে চড়ে নিজেও এসে পৌঁছান দিয়াবাড়ি মেট্রোরেল স্টেশনে। উদ্দেশ্য স্ত্রী ও সন্তানদের নিয়ে সবাই একসঙ্গে বাসায় ফিরবেন। তা আর হলো না।

সোমবারের ভয়াল সেই যুদ্ধবিমান বিধ্বস্তের ঘটনায় আদরের দুই সন্তান তাহিয়া আশরাফ নাজিয়া (১৩) ও আরিয়ান আশরাফ নাফি (৯) উভয়কেই হারান তুরাগের রাজাবাড়ি এলাকার বাসিন্দা সার্জেন্ট (অব.) আশরাফুল ইসলাম ও তাহমিনা আশরাফ দম্পতি। 

জাতীয় বার্ন ইউনিটে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ২৪ ঘণ্টার ব্যবধানে ২২ ও ২৩ জুলাই রাতে কলিজার টুকরা সন্তানদের হারিয়ে এখন শোকে বিহ্বল পুরো পরিবার।

দুপুরে তুরাগের রাজাবাড়ি দক্ষিণপাড়া জামে মসজিদের পাশের ব্লক বি-এর বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, মোবাইলে থাকা সন্তানদের ছবি ঘুরে ঘুরে দেখছেন বাবা আশরাফুল ইসলাম। নাড়িছেঁড়া ধন হারিয়ে মা তাহমিনা আশরাফ এখনো ঠিকমতো কথা বলতে পারছেন না।

জানা গেছে, মাইলস্টোন ট্র্যাজিডিতে নিহত তাহিয়া আশরাফ নাজিয়া (১৩) ইংরেজি ভার্সনের ৬ষ্ঠ শ্রেণির শিক্ষার্থী ছিল এবং ভাই আরিয়ান আশরাফ নাফি (৯) দ্বিতীয় শ্রেণিতে পড়ত। সেদিন মা অসুস্থ হওয়ায় মাকে ক্যান্টিনে রেখে বোনকে আনার জন্য মাইলস্টোন স্কুলের হায়দার আলী ভবনে গিয়েছিল নাফি। আর সেখানেই আগুনে পুড়ে না ফেরার দেশে পাড়ি জমায় দুই সহোদর।

সেদিনের সেই মুহূর্তের বর্ণনা দিয়ে দুই সন্তান হারানো আশরাফুল ইসলাম যুগান্তরকে বলেন, দুপুর আনুমানিক সোয়া একটার দিকে দিয়াবাড়ি মেট্রোরেল স্টেশনে নামতেই আমার স্ত্রীর মোবাইল থেকে কল আসে। খুবই চিৎকার-চেঁচামেচির শব্দ শুনছিলাম। মনে করেছি হয়তো রোড এক্সিডেন্ট হয়েছে। পরে দৌড়ে মাইলস্টোন স্কুলে যাই। অনেক খোঁজাখুঁজির পর আমার মিসেসকে খুঁজে পেলেও আমার সন্তানদের খুঁজে পাচ্ছিলাম না। পরে উত্তরা আধুনিকসহ আশপাশের মেডিকেলগুলোতে খোঁজ নিয়েও বাচ্চাদের না পেয়ে আমরা সিএনজি নিয়ে সিএমএইচ হাসপাতালে রওনা দেই।

তিনি বলেন, ক্যান্টনমেন্ট পৌঁছতেই আমার নাম্বারে একটা কল আসে এবং জানায়, আপনার বাচ্চাদের জাতীয় বার্ন ইউনিটে নিয়ে যাচ্ছি। আপনারা আসেন। তখন আমরা সেখানে যাই।

কলিজার টুকরো সন্তানদের খুঁজে পাওয়ার বিষয়ে আশরাফুল বলেন, আমার ছেলেকে আইডি কার্ড দেখে ওর খালা শনাক্ত করেছে।

কান্নাভেজা কণ্ঠে আশরাফুল জানান, আমার বাবাটার শরীরের ৯৫ ভাগই পুড়ে গিয়েছিল। মেয়ে নাজিফাকে খুঁজতে গিয়ে অনেক ঘোরাঘুরি করেছি। একপর্যায়ে একটি বেডের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় আমার মা নাজিফাই আমাকে বাবা বলে ডাক দেয়। আমার মা-টার শরীরের ৯০ ভাগ পুড়ে গিয়েছিল।

কাঁদতে কাঁদতে আশরাফুল বলেন, আমার মা আমাকে দেখেই ওর ভাইয়ের কথা জানতে চেয়েছিল। ও জানতে চায়- বাবা আমার ভাই কেমন আছে? আমি নাজিফাকে বলি- মা তোমার ভাই ভালো আছে। তুমিও ভালো হয়ে যাবে মা।

আশরাফুল জানান, আমার মেয়েটা ডাক্তার হতে চেয়েছিল। ও খুব ভালো আঁকাআঁকিও করত। দীর্ঘদিন দেশের বাইরে থাকায় ছেলেটা আমার তেমন একটা আদর পায়নি। নাফি ওর মায়ের খুব ভক্ত ছিল। আমার ছেলেটা ক্লাস টু থেকে পড়লেও ও এই বয়সে আরবি, ইংরেজি ও হিন্দি-সব ভাষাই বুঝত। এখন আমার জীবন থেকে আমার এই দুই মা-বাবাই চলে গেল। থেমে থেমে কথাগুলো যুগান্তরকে বলছিলেন সেনাবাহিনী থেকে অবসর নেওয়া আশরাফুল।

ছেলে আরিয়ান আশরাফ নাফির মৃত্যুর বিষয়ে আশরাফুল বলেন, যে ভবনটার সামনে যুদ্ধবিমানটি বিধ্বস্ত হয়েছে সেই ভবনে আমার মেয়ে নাজিফার ক্লাশ ছিল। নাফির ক্লাশ অন্য ভবনে ছিল। কিন্তু সেদিন ওর মা অসুস্থ ছিল বিধায় ও মাকে ক্যান্টিনের পাশে বসিয়ে বোনকে আনতে গিয়েছিল নাফি। আর ওখানে গিয়েই বোনের সাথে পুড়ে যায় নাফি।

আদরের সন্তানদের দুনিয়া ছেড়ে চলে যাওয়ার বিষয়ে চাপা কন্ঠে আশরাফুল জানান, ২২ জুলাই রাতে আমার মাটা দুনিয়া থেকে বিদায় নেয়। পরদিন ২৩ জুলাই রাতে বাবাটাও আমাদের কাঁদিয়ে চলে গেছে। আমার বাবা-মা দুজনই এখন কবরস্থানে পাশাপাশি ঘুমিয়ে আছে।

এদিকে নিজের সন্তানদের মর্মান্তিক এই মৃত্যুর পেছনে বিমানবাহিনী কিছুতেই দায় এড়াতে পারে না বলে মন্তব্য করেছেন সাবেক এই অবসরপ্রাপ্ত সার্জেন্ট।

এ বিষয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করে নাজিয়া ও নাফির বাবা মো. আশরাফুল ইসলাম যুগান্তরকে বলেন, এই যুদ্ধবিমানটা কত বছর আগের বলতে পারেন। এত বছর আগের এসব বিমান দিয়ে প্রশিক্ষণ দিতে হবে কেন? যে পাইলট মারা গেছেন তিনিও তো অনেক কষ্ট করে এ পর্যন্ত এসেছেন তাই না।

আশরাফুল বলেন, ঢাকা শহরের মতো এমন জনবহুল এলাকায় এ ধরনের প্র্যাকটিস কেনই-বা করতে হবে। কক্সবাজারে এত এত সামুদ্রিক এলাকা ও খোলা জায়গায় এ ধরনের ট্রেনিং কী করা যেত না?

এ সময় দুই সন্তান হারানো এই বাবা বলেন, আজকের এ ঘটনার জন্য বিমানবাহিনীর অতীতের এবং বর্তমান কর্তৃপক্ষই দায়ী। যুগান্তরের সঙ্গে এসব কথা বলতে গিয়ে বারবার শোকে কাতর হয়ে পড়েন তিনি। সবশেষ নিজ সন্তানদের জন্য দেশবাসীর কাছে দোয়া চান আশরাফুল ইসলাম ও তাহমিনা আশরাফ দম্পতি।

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম