Logo
Logo
×

সারাদেশ

বাবুগঞ্জে শহীদ ৩ পরিবার

কান্নাই যাদের বাকি জীবনের সঙ্গী

Icon

বাবুগঞ্জ (বরিশাল) প্রতিনিধি

প্রকাশ: ২৮ জুলাই ২০২৫, ০৯:৩৭ পিএম

কান্নাই যাদের বাকি জীবনের সঙ্গী

জুলাই-আগস্টের বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে বরিশালের বাবুগঞ্জ উপজেলায় দুজন ছাত্র এবং একজন বিশ্ববিদ্যালয় কর্মী শহীদ হয়েছেন। এ ঘটনার এক বছর অতিবাহিত হয়েছে। শোকাহত তিন শহীদ পরিবারে কান্না চলছেই। 

২০২৪ সালের জুলাই মাসের শুরু থেকে সারা দেশের মতো চট্টগ্রামেও শুরু হয়েছিল কোটা সংস্কার আন্দোলন। চট্টগ্রাম নগরীর মুরাদপুরে সন্ত্রাসীদের গুলিতে শহীদ হয়েছেন ওমর গণি (এমইএস) কলেজের বিবিএ প্রথমবর্ষের শিক্ষার্থী ফয়সাল আহমেদ শান্ত। 

বরিশালের বাবুগঞ্জ উপজেলার ব্যবসায়ী জাকির হোসেনের ছেলে শান্তকে হারিয়ে এখনো দিশেহারা তার পরিবার। কান্নাই এখন স্কুল শিক্ষিকা মা কোহিনূর বেগমের বাকি জীবনের সঙ্গী। 

স্কুলপড়ুয়া ছোট বোন সুমাইয়া বৃষ্টিও খুঁজে ফিরে তার ভাইকে। মায়ের চাকরির সুবাদে সপরিবারে চট্টগ্রামের লালখান বাজারে ভাড়া বাসায় ছিল। জুলাই বিপ্লবের বর্ষপূতিতে শান্তর পরিবারকে সান্ত্বনা দেওয়ার ভাষা ছিল না কারও।

ফয়সাল আহমেদ শান্ত নামটি এখন পরিবারের কাছে স্মৃতি। সন্তান নিহতের এক বছর পরও মা কোহিনুর আক্তার কাঁদতে কাঁদতে মূর্ছা যাচ্ছেন। একমাত্র ছেলেকে হারিয়ে নির্বাক বাবা জাকির হোসেনও। ভাইয়ের অকাল প্রাণহানি মানতে পারছে না ছোটবোন সুমাইয়া জান্নাত বৃষ্টি।

গত বছরের ১৬ জুলাই গণআন্দোলনে চট্টগ্রাম থেকে লাশ হয়ে বরিশালের গ্রামের বাড়িতে ফিরেছিলেন  ফয়সাল আহম্মেদ শান্ত। ২০২৪ সালের ১৬ জুলাই চট্টগ্রামের মুরাদপুর ২নং গেটের মাঝামাঝি জায়গায় কোটা সংস্কারে আন্দোলনরত অবস্থায় গুলিতে নিহত হন ফয়সাল আহমেদ শান্ত। 

গ্রামের বাড়ি বরিশালের বাবুগঞ্জ উপজেলার রহমতপুর ইউনিয়নের মহিষাদী গ্রামে। শান্তর বাবা জাকির হোসেন জাহাজের পুরনো আসবাব পত্রের ব্যবসা করেন। সে সুবাদে তিনি বাবুগঞ্জে থাকেন। 

ছোটবোন বৃষ্টি ও মা কহিনুরকে নিয়ে চট্টগ্রামের ইপিজেডে ভাড়া বাসায় থাকতেন শান্ত। দুই ভাই-বোনের মধ্যে শান্ত বড়। ২০২৪ সালের ১৭ জুলাই অ্যাম্বুলেন্সযোগে নানা বাড়িতে লাশ নিয়ে যাওয়া হয়।  বাবুগঞ্জের মহিষাদী গ্রামের পারিবারিক কবরস্থানে তাকে দাফন করা হয়েছে। তার শরীরে তিনটি গুলি লেগেছিল। 

শহীদ ফয়সাল আহমেদ শান্তর বাবা জাকির হোসেন বলেন, বিনা দোষে আমার সন্তানকে যারা হত্যা করেছে, তাদের বিচার চাই আমি। আমি জাকির হোসেন শহীদ ফয়সালের গর্বিত বাবা, এটাই আমার পরিচয়। 

শান্তর মা বলেন, আমার তো অনেক আশা ছিল। আমার ছেলে পড়ালেখা করে অ্যাওয়ার্ড নিয়ে আসবে। আমার বাবা যে এত বড় অ্যাওয়ার্ড নিয়ে আসবে, আমি তো বুঝতে পারি নাই। আমারে সে সেরা মায়ের সম্মান দিয়ে গেল।

আমি শহীদের সম্মানিত মা, এখন এই পরিচয় আমার জন্য অনেক গর্বের। 

অপরদিকে ১৯ জুলাই নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের স্টাফ ছিলেন আবদুল্লাহ আল আবির (২৭); কোটা সংস্কার আন্দোলনে নেমে পুলিশের গুলিতে আহত হয়েছিলেন তিনি। 

১৯ জুলাই ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে পুলিশের দিনভর সংঘর্ষ চলে। সন্ধ্যায় গুলিতে পেটের ভেতর ছিন্ন ভিন্ন হয়ে যায় তার। কিডনি ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় ঢাকা মেডিকেলে অস্ত্রোপচারে ১১ ব্যাগ রক্ত দিয়েও বাঁচানো যায়নি তাকে। 

পরদিন ২০ জুলাই সকালে হাসপাতালে মারা যান আবদুল্লাহ। ২১ জুলাই রাতে বরিশালের বাবুগঞ্জ উপজেলার বাহেরচর ক্ষুদ্রকাঠী গ্রামে জানাজা শেষে তাকে দাফন করা হয়। 

বাবুগঞ্জের ক্ষুদ্রকাঠী গ্রামের মিজানুর রহমান বাচ্চুর ছেলে আবদুল্লাহ আল আবির বোনের সঙ্গে ঢাকায় ভাড়া বাসায় থাকতেন। ভগিনীপতি মহিমুল ইসলাম নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকরি করার সুবাদে আবদুল্লাহরও সেখানে চাকরির ব্যবস্থা হয়। তার বাবা বাচ্চু বরিশাল নগরের জননিরাপত্তা অপরাধ ট্রাইব্যুনালের চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী। ক্ষুদ্রকাঠী গ্রামে এখনো শোকের ছায়া। একমাত্র ভাইয়ের মৃত্যু কিছুতেই মানতে পারছেন না বোন মারিয়া আক্তার। 

মারিয়া বলেন, গুলিতে তার কিডনি ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় চিকিৎসকেরা একটি কিডনি কেটে ফেলেন। তারপরও ভেতরের রক্তক্ষরণ বন্ধ হয়নি। ১১ ব্যাগ রক্ত দিলেও শরীরে ধরে রাখা যায়নি।  

কান্নায় ভেঙে পড়েন আবদুল্লাহর মা পারভীন সুলতানা। তিনি বলেন, আমার ছেলে শহীদ হয়েছে। তার বিজয় হয়েছে।

৫ আগস্ট বিজয়ের কয়েক ঘণ্টা আগে নিহত হয়েছিলেন বরিশালের বাবুগঞ্জ উপজেলার মানিককাঠি গ্রামের কৃষক আলমগীর হোসেনের ছেলে রাকিব হোসেন। 

২০২৪ সালের ৫ আগস্ট আন্দোলনের চূড়ান্ত বিজয়ের কয়েক ঘণ্টা আগে তিনি নিহত হন। রাকিব বরিশাল থেকে টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিং বিষয়ে ডিপ্লোমা করে বিএসসির জন্য ভর্তি হন ঢাকার সাউথ ইস্ট ইউনিভার্সিটিতে। 

নিহত রাকিব হোসাইনের প্রতিবেশীরা জানান, একজন প্রতিবাদী যুবক হিসেবে এলাকায় সুপরিচিত ছিলেন রাকিব। অন্যায় দেখলে মুখ বুজে থাকতেন না তিনি। দুই ভাই, তিন বোনসহ সাতজনের সংসার তাদের। তার কৃষক বাবার আর্থিক অবস্থা তেমন ভালো নয়। রাকিবকে ঘিরেই সব স্বপ্ন ছিল তাদের। তাই রাকিবের পরিবারকে ক্ষতিপূরণ দেওয়াসহ পুনর্বাসন করা প্রয়োজন।

বাবুগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী অফিসার ফারুক আহমেদ বলেন, জুলাই-আগস্ট আন্দোলনে বাবুগঞ্জ উপজেলায় তিনজন যুবক গুলিবিদ্ধ হয়ে শহীদ হয়েছেন। ইতোমধ্যে নিহতদের পরিবারের জন্য বরাদ্দকৃত সহায়তা দেওয়া হয়েছে। এছাড়া তাদের সর্বাত্মক সাহায্য প্রদানের জন্য আমরা প্রস্তুত রয়েছি। তাদের প্রয়োজনে উপজেলা প্রশাসন প্রস্তুত রয়েছে। 

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম