নওগাঁয় মৃত ব্যক্তির নামে ১০ টাকা কেজির চাল উত্তোলন
মো. আবু সাঈদ, পত্নীতলা (নওগাঁ)
প্রকাশ: ০৮ মে ২০২০, ০৩:৫৩ পিএম
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
নওগাঁর পত্নীতলায় খাদ্যবান্ধব কর্মসূচির আওতায় হতদরিদ্রের মাঝে ১০ টাকা কেজি'র চাল বিতরণে উপকারভোগীর তালিকা প্রণয়নে ব্যাপক অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে। তালিকায় নাম থাকার পরও চাল না দেয়া, মৃত ব্যক্তিদের চাল উত্তোলন করে আত্মসাৎ করার অভিযোগ পাওয়া গেছে সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে।
সরকারি নীতিমালা অনুযায়ী খাদ্যবান্ধব কর্মসূচিতে দরিদ্র ও প্রান্তিক মানুষকে তালিকাভুক্ত করার কথা থাকলেও রাজনৈতিক বিবেচনা ও স্বজনপ্রীতির মাধ্যমে উপকারভোগী নির্বাচনের অভিযোগ পাওয়া গেছে। এ কারণে তালিকায় স্থান পেয়েছে চাকরিজীবী ও সম্পদশালী ব্যক্তি।
এ ছাড়াও একই পরিবারের একাধিক ব্যক্তিকে তালিকাভুক্ত করে অনিয়ম করা হয়েছে। এ দিকে তালিকায় নাম থাকার পরও চাল না দেয়া, মৃত ব্যক্তিদের চাল উত্তোলন করে আত্মসাৎ করার অভিযোগ পাওয়া গেছে সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে। আর এ সব কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে প্রকৃত হতদরিদ্র ও প্রান্তিক মানুষকে কৌশলে বঞ্চিত করা হয়েছে সরকারের খাদ্য বান্ধব কর্মসূচির ১০ টাকা কেজির চাল পাওয়ার অধিকার থেকে।
সরেজমিন অনুসন্ধান ও উপকারভোগীদের তালিকা পর্যবেক্ষণ করে দেখা গেছে, উপজেলার ঘোষনগর ইউনিয়নের চকশ্রীপুর গ্রামের ইয়াকুব আলীর ছেলে সাদেকুল ইসলাম চকশ্রীপুর উচ্চবিদ্যালয়ে অফিস সহকারী, গগণপুর গ্রামের ছোলাইমান আলীর ছেলে হাদিউজ্জামান গগণপুর ওয়াজেদিয়া ফ্রাজিল মাদ্রাসার শিক্ষক, গগণপুর গ্রামের আবদুস সামাদের ছেলে মোত্তাকিন হোসেন গগণপুর ওয়াজেদিয়া ফ্রাজিল মাদ্রাসার গ্রন্থাগারিক, নোধূনী গ্রামের সামসুদ্দীনের ছেলে আবদুল্লাহ হেল হাসিব নোদনী-বাগমার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় সহকারী শিক্ষক, ঘোষনগর সরদারপাড়া গ্রামের মজিবর রহমানের ছেলে আবদুর রাজ্জাক ঘোষনগর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক, ঘোষনগর গ্রামের সাহাব উদ্দীনের ছেলে শাহিনুর ইসলাম ঘোষনগর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় সহকারী শিক্ষক, চাপড়া গ্রামের আমিনা খাতুনের স্বামী শাহিনুর আলম গগণপুর ওয়াজেদিয়া ফাজিল মাদ্রাসার শিক্ষক, ঘোষনগর গ্রামের আহাদ আলীর ছেলে ফিরোজ হোসেন ৩০ বিঘা জমির মালিক, চকশ্রীপুর গ্রামের অছিমদ্দীনের ছেলে ওবায়দুল হক ও ফরছেদ আলীর জমির পরিমাণ ১৫ বিঘা, শ্রীপুর গ্রামের নজরুল ইরলামের ছেলে মশিউর রহমানের জমি ৮ বিঘা, জামগ্রাম গ্রামের কহর আলীর ছেলে রমজান আলীর জমির পরিমাণ ১২ বিঘা, একই গ্রামের মোফাজ্জল হোসেনের ছেলে আবুল বাশার মেজুর জমির পরিমাণ ৮ বিঘা, শ্রীপুর গ্রামের নজরুল ইরলামের ছেলে মশিউর রহমানের জমি ৮ বিঘা। তাদের প্রত্যেকের নাম তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।
এ ছাড়াও ঘোষনগর গ্রামের অফির উদ্দীনের ছেলে ছানোয়ার ও তার স্ত্রী সুলতানা রাজিয়া, ঘোষনগর উচ্চপাড়া গ্রামের সোলেমানের ছেলে জুয়েল ও তার স্ত্রী রুবিনা, ঘোষনগর গ্রামের শাহাজান হোসেনের ছেলে ফারুক হোসেন ও তার স্ত্রী পারভীন, অছিমুদ্দীন শাহের ছেলে ব্যবসায়ী ইউসুব আলী ও তার স্ত্রী ফেন্সি আরা বেগম, গগপুর গ্রামের দিল মোহাম্মদের স্ত্রী ঝর্ণা ও ছেলে রুহুলামীনসহ আরও কয়েকজন স্বামী ও স্ত্রী উভয়ের নাম তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। শুধু তাই নয়, ৭নং ওয়ার্ডের কৃষ্ণরামপুর গ্রামের মৃত সিরাজুল ইসলাম ও কমলাবাড়ি গ্রামের মৃত ময়েন উদ্দিনের নামে চাল উত্তোলন করে আত্মসাৎ করার মতো ঘটনাও ঘটেছে।
এ দিকে তালিকায় নাম থাকলেও চাল না দিয়ে আত্মসাতের অভিযোগ করেছেন গগণপুর গ্রামের মাহমুদুল হকের ছেলে আবু তাহের, ইয়াকুব আলীর ছেলে সাইদুল ইসলাম, ঘোষনগর উচ্চপাড়া গ্রামের ওবাদুলের স্ত্রী চম্পা বেগম, মধুপুর গ্রামের জয়েন উদ্দীনের ছেলে আনোয়ার হোসেন ও চাপড়া গ্রামের হরিচন্দ্র বর্মণের ছেলে মনমত বর্মণ।
এ বিষয়ে নাম প্রকাশ না করার শর্তে কয়েকজন এলাকাবাসী যুগান্তরকে জানান, ঘোষনগর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ও ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মো. আবু বকর সিদ্দিক এবং তার সহযোগী আলামিন ও নান্টু মেম্বার অর্থের বিনিময়ে সরকারি চাকরিজীবী ও স্বাবলম্বী ব্যক্তিদের নাম তালিকাভুক্ত করেছেন। ২০১৬ সালে কর্মসূচি চালু হওয়ার পর থেকেই ইউনিয়নের চেয়ারম্যান এই অনিয়ম করে আসছেন।
এ বিষয়ে ঘোষনগর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মো. আবু বকর সিদ্দিক জানান, ইউনিয়নে ১ হাজার ৩০ জনকে খাদ্যবান্ধব কর্মসূচির ১০ টাকা কেজির চালের জন্য তালিকাভুক্ত করা হয়েছে। তালিকায় কিছু ভুলভ্রান্তি থাকার সত্যতা স্বীকার করে তিনি বলেন, আমি এর সঙ্গে জড়িত নই। প্রয়োজনে তালিকা সংশোধন করা হবে।
এ বিষয়ে উপজেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক মো. নজমুল করিম জানান, দরিদ্র ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর খাদ্য নিরাপত্তার জন্য সরকার ২০১৬ সালে খাদ্য বান্ধব কর্মসূচি চালু করেছে। হতদরিদ্রের তালিকায় কোনোভাবেই সরকারি চাকরিজীবী, সম্পদশালীদের নাম থাকতে পারবে না। যারা তথ্য গোপন করে তালিকাভুক্ত হয়েছেন তদন্তসাপেক্ষে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
এ বিষয়ে জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক জিএম ফারুক হোসেন পাটোয়ারী বলেন, কোনো চাকরিজীবী, একই পরিবারের একাধিক ব্যক্তি খাদ্যবান্ধব কর্মসূচিতে তালিকাভুক্ত হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। যে সব জনপ্রতিনিধি তাদের তালিকাভুক্ত করেছেন তদন্ত করে তাদের আইনের আওতায় আনা হবে। একই সঙ্গে প্রকৃত হতদরিদ্রের নাম তালিকাভুক্ত করা হবে।
পত্নীতলা উপজেলা নির্বাহী অফিসার মো. লিটন সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে তিনি জানান, পরবর্তী বরাদ্দ প্রদানের পূর্বে এগুলো যাচাই-বাছাই করা হবে। কোনো অনিয়ম পেলে সেগুলো বাতিলসহ আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হবে।
