মুক্তিযুদ্ধের অনুপ্রেরণায় করোনা রোগীদের পাশে থেকেছি
করোনায় চিকিৎসকদের সংগ্রাম
যোবায়ের আহসান জাবের
১৬ আগস্ট ২০২১, ১০:১৫:০৯ | অনলাইন সংস্করণ
করোনা মহামারীতে প্রথম সারির এক সম্মুখ যোদ্ধা দেশের প্রখ্যাত কিডনি রোগ ও মেডিসিন বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. এম এ সামাদ। তিনি ঢাকা মেডিকেল কলেজ, রাজশাহী মেডিকেল কলেজ, জাতীয় কিডনী রোগ ইনস্টিটিউটসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে কিডনী বিভাগে অধ্যাপনা করেছেন। চিকিৎসা বিজ্ঞানে তার অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ ইংল্যান্ডের প্লাসগো রয়্যাল কলেজ হতে এফআরসিপি ডিগ্রি লাভ করেন। বিশ্বব্যাপী করোনাভাইরাসে চিকিৎসকরাও যখন ভীতসন্ত্রস্ত ছিলেন, অনেকেই হাসপাতালে যেতে ভয় পাচ্ছিলেন, ঠিক ওই সময় রোগীদের কথা চিন্তা করে নিজের মৃত্যুঝুঁকি উপেক্ষা করে এগিয়ে আসেন। করোনার প্রথম দিকের পরিস্থিতি কীভাবে সামাল দিয়েছেন, কোন অনুপ্রেরণায় তিনি এভাবে ঝুঁকি নিলেন এ বিষয়ে বিস্তারিত জানিয়েছেন যুগান্তরকে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন যোবায়ের আহসান জাবের
যুগান্তর: করোনার প্রথম দিকের পরিস্থিতি নিয়ে কিছু বলুন।
অধ্যাপক ডা. এম এ সামাদ: চীনে যখন করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব বাড়তে শুরু হল তখন ভীত ও উৎকণ্ঠা নিয়ে সংবাদমাধ্যমগুলোর দিকে কৌতুহলী হয়ে সার্বক্ষণিক মনোযোগ রাখতাম। করোনায় আক্রান্ত হয়ে, কোথায় কী হচ্ছে, কোন দেশের কী অবস্থা? বাংলাদেশের অবস্থা কোন দিকে যাচ্ছে? করোনা ঠেকাতে নতুন উদ্ভাবন সম্পর্কে সহকর্মীদের সঙ্গে মতবিনিময় প্রভৃতি ছিল আমাদের (চিকিৎসকদের) প্রতিদিনের সঙ্গী।
আমরা তখন দেখেছি, একের পর এক মৃত্যু। অনেক পরিবারের সদস্যরা ভয়ে, মৃতের সৎকার না করে পালিয়ে যেতে দেখেছি। হাসপাতালের বিলের ভয়ে অনেকে মোবাইলে ফোন বন্ধ করে রাখেন। কবরস্থানে কবর খোরার কর্মীরা ২৪ ঘণ্টা কাজ করেও দাফনের কাজ করতে গিয়ে হিমশিম খেতে দেখেছি।
২০২০ সালের মার্চ থেকে, পৃথিবীর বহু দেশ, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার জরুরি পরামর্শ অনুসারে, সর্বাত্মক লকডাউন দিতে শুরু করে। পুরো পৃথিবীজুড়ে মানুষের মধ্যে মহা আতঙ্ক ছড়াতে থাকে। অনেক দেশেই জরুরী চিকিৎসা দেয়ার মতো, জরুরী সরঞ্জাম, প্রয়োজনীয় ঔষধের মজুদ ও যোগান অপ্রতুল ছিল। কঠোর নিয়ম পালন করে কষ্টকর চিকিৎসা সেবা প্রদানে অভিজ্ঞ ডাক্তার খুঁজে পাওয়াও দুরূহ ছিল। ঘর বন্দি মানুষের কাজ বন্ধ, আয় রোজগার বন্ধ। যারা দিনে-আনে-দিনে-খায় অবস্থায় চলে, তাদের অবস্থা আরও করুন।
বিভীষিকাময় অবস্থা দেখেছি বিশ্বব্যাপী, ইতালিতে দেখা গেছে গণকবর নিত্যদিনের। এরপর স্পেন, আমেরিকাসহ একের পর এক দেশের করুণ চিত্র দেখে দেখে, আমরা প্রতিনিয়ত ভাবছিলাম, যদি বাংলাদেশে নিয়ন্ত্রনহীন বিভীষিকাময় অবস্থা শুরু হয়ে যায়, তখন আমরা ডাক্তার হিসেবে কী করব? বিবেক তাড়িত হয়ে বহুবার নিজ পরিবার ও আত্মীয়-স্বজনের সঙ্গে শেয়ার করেছি। তারাও প্রায় সময় কিংকর্তব্যবিমুর হয়ে, বিমর্ষতা প্রকাশ করত।
আমাদের পরিবারের প্রায় সবাই জানত, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার গাইডলাইন অনুসারে, আমরা সমসাময়িক যারা, তারা প্রবীণ চিকিৎসকদের দলে। করোনা মহামারীতে প্রবীণ চিকিৎসকগণের বেলায় সম্মুখ যুদ্ধে টিকে থাকা অত্যান্ত ঝুঁকিপূর্ণ ছিল। এরূপ স্পর্শকাতর মুহূর্তে, আমি নিজেও হতভম্ব হয়ে যাই। অনেকে বলেন, ঘরে বসে অনলাইনে “টেলিমেডিসিন চিকিৎসা” সেবা প্রদান চালু করতে।
যুগান্তর: করোনার সময় কি কখনও আপনার কোনো বিষয়ে হতাশা কাজ করেছে? যদি করে থাকে তাহলেকেন?
অধ্যাপক ডা. এম এ সামাদ: যখন বাংলাদেশে প্রথম করোনা রোগী শনাক্ত হওয়ার খবর পাওয়া গেল ২০২০ সালের মার্চের প্রথম দিকে। এর সাতদিন পর আমার হাসপাতালের ডায়ালাইসিস ইউনিটের কর্মরত চিকিৎসক পদত্যাগপত্র দিয়ে গেলেন। কারণ তার বাবা-মা ও স্ত্রী তাকে ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় চাকরি করতে দেবে না। তখন আমি গভীর হতাশায় ডুবে গেলাম।
আমি তো ডাক্তার, তাছাড়া আমার একটা সেবামূলক প্রতিষ্ঠান আছে ক্যাম্পস কিডনি এওয়ারনেস মনিটরিং এন্ড প্রিভেনশন সোসাইটি- এর চারটি ডায়ালিসিস সেন্টার আছে। সেখানে বেশকয়েকজন ডাক্তার, নার্স, টেকনিশিয়ান ও অন্যান্য স্টাফরাও আছে তাদের জীবনেরও ঝুঁকি আছে। তাদের সবার পরিবারও চিন্তিত ছিল।
আমার মূল কর্মস্থল আনোয়ার খান মর্ডান মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে প্রতিদিন শতাধিক রোগীর জন্য সময় ভাগ করে সেবা চালিয়ে যেতে হয়, সেখানে একটি অত্যাধুনিক ডায়ালাইসিস ইউনিট সদ্য সেবা চালু করি, সে সময়ে, যখন আমার অধীনস্ত একজন অভিজ্ঞ ডাক্তার, স্বাস্থ্য ঝুঁকি এড়াতে ইস্তফা দিয়ে চলে যায়, তখন হঠাৎ করে এমন মুহূর্তে অন্যজনকে স্থলাভিষিক্ত করেও সন্দেহ কাটছিল না ছিল, কাজ চলমান রাখবে কি রাখবে না। পুরো ডিপার্টমেন্ট কিভাবে চালাবো, ভেবে নিশ্চয়তা পাচ্ছিলাম না।
যুগান্তর: কোন অনুপ্রেরণায় নিজের মৃত্যুঝুঁকি নিয়ে ওই দুঃসময়ে রোগীদের সেবায় এগিয়ে এলেন?
অধ্যাপক ডা. এম এ সামাদ: কঠিন ওই পরিস্থিতিতে হঠাৎ আমার মাথায় মহান মুক্তিযুদ্ধের কথা স্মরণ হয়। ১৯৭১ সালে আমি তখন ক্লাস নাইনে পড়ি। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলো। অনেকেই মুক্তিবাহিনীতে যোগ দেন। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে কাদেরিয়া বাহিনীর ঘাঁটি হলো; আমাদের টাঙ্গাইল থানার সখীপুরের প্রায় ৮০০ মুক্তিযোদ্ধা। তারা সেখানে গেরিলা যুদ্ধ করছে, ট্রেনিং নিচ্ছে। তখনকার সময়ে, অনেকেই যার যার সাধ্যমত এসব যোদ্ধাদের সহায়তা করেন। তাদের খাবারের ব্যবস্থার জন্য স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে প্রথমে কাজ শুরু করেন আমার বড় ভাই প্রয়াত এম এ মালেক মিয়া। প্রথমেই স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে কাজ শুরু করলেন পরে তিনি চলে যান সরাসরি যুদ্ধে। তখন আমিও স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে তার স্থানে আমি স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে দায়িত্ব পালন শুরু করলাম। বাড়ি-বাড়ি থেকে খাবার তুলে নিয়ে সেগুলো সরবরাহ করেছি। কিন্তু তখন সারাক্ষণ আতঙ্কে দিন কাটিয়েছি। যেকোনো সময় রাজাকার, আল-বদর, আল-সামসদের সহায়তায় হানাদার পাকসেনা পাকড়াও করে আমাদের হত্যা করতে পারত। কতরাত বনে-জঙ্গলে কাটিয়েছি।
তখন যদি সেই যুদ্ধ করতে পারি, তাহলে এখন তো জীবনের শেষ প্রান্তে। তাহলে কেন করোনা যুদ্ধে যেতে পারবো না? এই ভাবনা আমার বিবেককে দারুণভাবে অনুপ্রাণিত করে।
টেলিভিশনের পর্দায় প্রায়ই দেখছিলাম, মহামারী প্রচণ্ডতার সময়ে চিকিৎসকদের অভাব। বিশেষ করে অভিজ্ঞ ডাক্তারের। এই সময়ে শুধু যে করোনার কারণে মৃত্যুর মিছিল চলছিল তাই নয়; করোনা ব্যতীত কিডনি বিকল, হৃদরোগসহ অন্যান্য চিকিৎসাযোগ্য ব্যধিতে অসংখ্য মৃত্যু হচ্ছিল, শুধু অভিজ্ঞ চিকিৎসকদের হাসপাতালে না পাওয়ার কারণে। সব দেখে মন স্থির করলাম, এবার স্বেচ্ছাসেবক নয় একেবারে সম্মুখযুদ্ধে নামতেই হবে। কারণ পুরো পৃথিবী আমাদের দিকে তাকিয়ে আছে!
যুগান্তর: করোনায় কিডনি রোগীদের সেবা দিতে গিয়ে কী কী চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়েছিলেন? ওই সময় কীভাবে আপনার হাসপাতালে রোগীরা সেবা পেয়েছেন?
অধ্যাপক ডা. এম এ সামাদ: করোনার প্রথম ঢেউয়ে তরুণ থেকে প্রবীণ পর্যন্ত সবাই যখন আতঙ্কে কর্মস্থল ত্যাগ করতে শুরু করেছে। করোনার প্রথম ঢেউ সবাইকে অত্যাধিক আতঙ্কিত করে ফেলে। জুনিয়র ডাক্তার নার্স ও অন্যান্য যারা স্বাস্থ্যসেবার সঙ্গে সম্পৃক্ত, তারা সবাই কাজ করবে কিনা দ্বিধান্বিত ছিল। এমতাবস্থায়, আমার উপস্থিতি তাদের সাহসী করে তুলল। ২০২০ সালের মে মাসে স্বাস্থ্যমন্ত্রী মহোদয় আমাদের হাসপাতালে ২০০ বেডের করোনা ইউনিট উদ্বোধন করছিলেন।
আমি কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে আনোয়ার খান মডার্ন হাসপাতাল এর তিনটি ডায়ালিসিস ইউনিটের প্রস্তাব পাস করিয়ে নেই। এর একটি সম্পূর্ণ করোনামুক্ত। দ্বিতীয়টি, যারা করোনা-সন্দেহ-যুক্ত ও তৃতীয়টি, যাদের করোনা- প্রমাণিতো কিডনি বিকল রোগী, তাদের জন্য। করোনা পজিটিভ রোগীদের জন্য চার বেডের ডায়ালাইসিস ইউনিট’টি বাস্তবায়িত করা একটি বড় চ্যালেঞ্জ ছিল। কারণ, প্রত্যক্ষ যমদূতের মাঝে একটানা ১২ ঘন্টা ডিউটি করার মতো পর্যাপ্ত ডাক্তার, নার্স জোগাড় করা ছিল অনেক কঠিন। সেই কারণে, বেশির ভাগ ফ্যাকাল্টি মেম্বার এই ইউনিটের বাস্তবায়ন নিয়ে সন্দিহান ছিলেন। কিন্তু স্টাফদের নিয়োগ দেয়ার সময় যখন তাদের আশ্বস্ত করলাম তাদের পাশে আমি থাকবো, তারা উৎসাহিত হল।
শুরু হল করোনা ইউনিটের ডায়ালাইসিস। শতাধিক মূল্যবান জীবন বেঁচে গেল এই ইউনিট থেকে ডায়ালাইসিস পেয়ে।
যুগান্তর: কর্মস্থলে আপনার সহযোদ্ধাদের নিয়ে কিছু বলুন।
অধ্যাপক ডা. এম এ সামাদ: আমি সম্মুখ যুদ্ধে থাকাতে সহকর্মীরা উৎসাহিত হয়। আমার সঙ্গে যারা করোনার সম্মুখ যুদ্ধে আমার সহকর্মীদের জানাই অন্তরের অন্তঃস্থল থেকে ভালোবাসা, শুভেচ্ছা ও কৃতজ্ঞত জানাই।
ক্যাম্পাসের চারটি ডায়ালাইসিস সেন্টারের একজন ডাক্তার বা স্টাফও করোনাকালীন সময়ে সেবা দিতে বিরত থাকেনি।
সবচেয়ে মজার ব্যাপার হলো, এই দীর্ঘ সময়ে করোনা ইউনিটের ৮ জন ডায়ালাইসিস টেকনিশিয়ানের একজনও করোনায় আক্রান্ত হয়নি।
যুগান্তর: করোনাকালীন কোন বিষয়টা আপনাকে আবেগতাড়িত করে? রোগীদের সেবা দিতে গিয়ে আপনি কখনও করোনায় আক্রান্ত হয়েছিলেন কিনা?
অধ্যাপক ডা. এম এ সামাদ: আমাদের হাসপাতালের যত জটিল কিডনি রোগী এসেছে তাদের পাশে থেকে চিকিৎসা দেবার সুযোগ পেয়েছি। এতে আরও নতুন অভিজ্ঞতা লাভের সুযোগ পেয়েছি। মনে ভয়ে সবার মতো আমাদেরও ছিল, কিন্তু মহান মুক্তিযুদ্ধের কথা চিন্তা করে, মনে ভীষণ সাহসের সঞ্চার হয় বলেই, করোনা মহামারীতে আমরা যথাযথ প্রস্তুতি নিয়ে, চিকিৎসা সেবা চালিয়ে গিয়েছি।
এটা মুক্তিযুদ্ধের চেতনা থেকে অনুপ্রেরণা পাওয়া। মনে একটা আশার সঞ্চার হয়, সাধারণ মানুষের পাশে থেকে দাঁড়িয়ে যদি যুদ্ধের মোকাবেলা করি, তাহলে আল্লাহ আমাদের পাশে থাকবেন। আর আল্লাহ আমাদের সহায় হয়েছেন। আমি করোনা ইউনিটে ১২ মাস দায়িত্ব পালন করেছি। কিন্তু আমি আক্রান্ত হইনি। আমি ছোট ছোট কিছু আক্রমণের শিকার হয় রেজিস্ট্যান্স বা অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিলাম। হয়তো, আমার মাধ্যমে করোনা আমার বাড়িতে গিয়েছে। আমার স্ত্রী, সন্তান ও পরিবারের অনেকেই আক্রান্ত হয়েছে। আল্লাহর রহমতে তারা চিকিৎসার পর ভালো হয়ে গিয়েছে। কিন্তু আল্লাহর রহমতে আমি করোনায় আক্রান্ত হইনি। আল্লাহ আমাকে সেভ করেছেন।
যুগান্তর: সময় দেওয়ার জন্য আপনাকেধন্যবাদ
অধ্যাপক ডা. এম এ সামাদ: আপনাদেরকেও ধন্যবাদ।
সম্পাদক : সাইফুল আলম, প্রকাশক : সালমা ইসলাম
প্রকাশক কর্তৃক ক-২৪৪ প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড), বারিধারা, ঢাকা-১২২৯ থেকে প্রকাশিত এবং যমুনা প্রিন্টিং এন্ড পাবলিশিং লিঃ থেকে মুদ্রিত।
পিএবিএক্স : ৯৮২৪০৫৪-৬১, রিপোর্টিং : ৯৮২৩০৭৩, বিজ্ঞাপন : ৯৮২৪০৬২, ফ্যাক্স : ৯৮২৪০৬৩, সার্কুলেশন : ৯৮২৪০৭২। ফ্যাক্স : ৯৮২৪০৬৬
E-mail: jugantor.mail@gmail.com
© সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত
করোনায় চিকিৎসকদের সংগ্রাম
মুক্তিযুদ্ধের অনুপ্রেরণায় করোনা রোগীদের পাশে থেকেছি
করোনা মহামারীতে প্রথম সারির এক সম্মুখ যোদ্ধা দেশের প্রখ্যাত কিডনি রোগ ও মেডিসিন বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. এম এ সামাদ। তিনি ঢাকা মেডিকেল কলেজ, রাজশাহী মেডিকেল কলেজ, জাতীয় কিডনী রোগ ইনস্টিটিউটসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে কিডনী বিভাগে অধ্যাপনা করেছেন। চিকিৎসা বিজ্ঞানে তার অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ ইংল্যান্ডের প্লাসগো রয়্যাল কলেজ হতে এফআরসিপি ডিগ্রি লাভ করেন। বিশ্বব্যাপী করোনাভাইরাসে চিকিৎসকরাও যখন ভীতসন্ত্রস্ত ছিলেন, অনেকেই হাসপাতালে যেতে ভয় পাচ্ছিলেন, ঠিক ওই সময় রোগীদের কথা চিন্তা করে নিজের মৃত্যুঝুঁকি উপেক্ষা করে এগিয়ে আসেন। করোনার প্রথম দিকের পরিস্থিতি কীভাবে সামাল দিয়েছেন, কোন অনুপ্রেরণায় তিনি এভাবে ঝুঁকি নিলেন এ বিষয়ে বিস্তারিত জানিয়েছেন যুগান্তরকে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন যোবায়ের আহসান জাবের
যুগান্তর: করোনার প্রথম দিকের পরিস্থিতি নিয়ে কিছু বলুন।
অধ্যাপক ডা. এম এ সামাদ: চীনে যখন করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব বাড়তে শুরু হল তখন ভীত ও উৎকণ্ঠা নিয়ে সংবাদমাধ্যমগুলোর দিকে কৌতুহলী হয়ে সার্বক্ষণিক মনোযোগ রাখতাম। করোনায় আক্রান্ত হয়ে, কোথায় কী হচ্ছে, কোন দেশের কী অবস্থা? বাংলাদেশের অবস্থা কোন দিকে যাচ্ছে? করোনা ঠেকাতে নতুন উদ্ভাবন সম্পর্কে সহকর্মীদের সঙ্গে মতবিনিময় প্রভৃতি ছিল আমাদের (চিকিৎসকদের) প্রতিদিনের সঙ্গী।
আমরা তখন দেখেছি, একের পর এক মৃত্যু। অনেক পরিবারের সদস্যরা ভয়ে, মৃতের সৎকার না করে পালিয়ে যেতে দেখেছি। হাসপাতালের বিলের ভয়ে অনেকে মোবাইলে ফোন বন্ধ করে রাখেন। কবরস্থানে কবর খোরার কর্মীরা ২৪ ঘণ্টা কাজ করেও দাফনের কাজ করতে গিয়ে হিমশিম খেতে দেখেছি।
২০২০ সালের মার্চ থেকে, পৃথিবীর বহু দেশ, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার জরুরি পরামর্শ অনুসারে, সর্বাত্মক লকডাউন দিতে শুরু করে। পুরো পৃথিবীজুড়ে মানুষের মধ্যে মহা আতঙ্ক ছড়াতে থাকে। অনেক দেশেই জরুরী চিকিৎসা দেয়ার মতো, জরুরী সরঞ্জাম, প্রয়োজনীয় ঔষধের মজুদ ও যোগান অপ্রতুল ছিল। কঠোর নিয়ম পালন করে কষ্টকর চিকিৎসা সেবা প্রদানে অভিজ্ঞ ডাক্তার খুঁজে পাওয়াও দুরূহ ছিল। ঘর বন্দি মানুষের কাজ বন্ধ, আয় রোজগার বন্ধ। যারা দিনে-আনে-দিনে-খায় অবস্থায় চলে, তাদের অবস্থা আরও করুন।
বিভীষিকাময় অবস্থা দেখেছি বিশ্বব্যাপী, ইতালিতে দেখা গেছে গণকবর নিত্যদিনের। এরপর স্পেন, আমেরিকাসহ একের পর এক দেশের করুণ চিত্র দেখে দেখে, আমরা প্রতিনিয়ত ভাবছিলাম, যদি বাংলাদেশে নিয়ন্ত্রনহীন বিভীষিকাময় অবস্থা শুরু হয়ে যায়, তখন আমরা ডাক্তার হিসেবে কী করব? বিবেক তাড়িত হয়ে বহুবার নিজ পরিবার ও আত্মীয়-স্বজনের সঙ্গে শেয়ার করেছি। তারাও প্রায় সময় কিংকর্তব্যবিমুর হয়ে, বিমর্ষতা প্রকাশ করত।
আমাদের পরিবারের প্রায় সবাই জানত, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার গাইডলাইন অনুসারে, আমরা সমসাময়িক যারা, তারা প্রবীণ চিকিৎসকদের দলে। করোনা মহামারীতে প্রবীণ চিকিৎসকগণের বেলায় সম্মুখ যুদ্ধে টিকে থাকা অত্যান্ত ঝুঁকিপূর্ণ ছিল। এরূপ স্পর্শকাতর মুহূর্তে, আমি নিজেও হতভম্ব হয়ে যাই। অনেকে বলেন, ঘরে বসে অনলাইনে “টেলিমেডিসিন চিকিৎসা” সেবা প্রদান চালু করতে।
যুগান্তর: করোনার সময় কি কখনও আপনার কোনো বিষয়ে হতাশা কাজ করেছে? যদি করে থাকে তাহলে কেন?
অধ্যাপক ডা. এম এ সামাদ: যখন বাংলাদেশে প্রথম করোনা রোগী শনাক্ত হওয়ার খবর পাওয়া গেল ২০২০ সালের মার্চের প্রথম দিকে। এর সাতদিন পর আমার হাসপাতালের ডায়ালাইসিস ইউনিটের কর্মরত চিকিৎসক পদত্যাগপত্র দিয়ে গেলেন। কারণ তার বাবা-মা ও স্ত্রী তাকে ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় চাকরি করতে দেবে না। তখন আমি গভীর হতাশায় ডুবে গেলাম।
আমি তো ডাক্তার, তাছাড়া আমার একটা সেবামূলক প্রতিষ্ঠান আছে ক্যাম্পস কিডনি এওয়ারনেস মনিটরিং এন্ড প্রিভেনশন সোসাইটি- এর চারটি ডায়ালিসিস সেন্টার আছে। সেখানে বেশকয়েকজন ডাক্তার, নার্স, টেকনিশিয়ান ও অন্যান্য স্টাফরাও আছে তাদের জীবনেরও ঝুঁকি আছে। তাদের সবার পরিবারও চিন্তিত ছিল।
আমার মূল কর্মস্থল আনোয়ার খান মর্ডান মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে প্রতিদিন শতাধিক রোগীর জন্য সময় ভাগ করে সেবা চালিয়ে যেতে হয়, সেখানে একটি অত্যাধুনিক ডায়ালাইসিস ইউনিট সদ্য সেবা চালু করি, সে সময়ে, যখন আমার অধীনস্ত একজন অভিজ্ঞ ডাক্তার, স্বাস্থ্য ঝুঁকি এড়াতে ইস্তফা দিয়ে চলে যায়, তখন হঠাৎ করে এমন মুহূর্তে অন্যজনকে স্থলাভিষিক্ত করেও সন্দেহ কাটছিল না ছিল, কাজ চলমান রাখবে কি রাখবে না। পুরো ডিপার্টমেন্ট কিভাবে চালাবো, ভেবে নিশ্চয়তা পাচ্ছিলাম না।
যুগান্তর: কোন অনুপ্রেরণায় নিজের মৃত্যুঝুঁকি নিয়ে ওই দুঃসময়ে রোগীদের সেবায় এগিয়ে এলেন?
অধ্যাপক ডা. এম এ সামাদ: কঠিন ওই পরিস্থিতিতে হঠাৎ আমার মাথায় মহান মুক্তিযুদ্ধের কথা স্মরণ হয়। ১৯৭১ সালে আমি তখন ক্লাস নাইনে পড়ি। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলো। অনেকেই মুক্তিবাহিনীতে যোগ দেন। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে কাদেরিয়া বাহিনীর ঘাঁটি হলো; আমাদের টাঙ্গাইল থানার সখীপুরের প্রায় ৮০০ মুক্তিযোদ্ধা। তারা সেখানে গেরিলা যুদ্ধ করছে, ট্রেনিং নিচ্ছে। তখনকার সময়ে, অনেকেই যার যার সাধ্যমত এসব যোদ্ধাদের সহায়তা করেন। তাদের খাবারের ব্যবস্থার জন্য স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে প্রথমে কাজ শুরু করেন আমার বড় ভাই প্রয়াত এম এ মালেক মিয়া। প্রথমেই স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে কাজ শুরু করলেন পরে তিনি চলে যান সরাসরি যুদ্ধে। তখন আমিও স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে তার স্থানে আমি স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে দায়িত্ব পালন শুরু করলাম। বাড়ি-বাড়ি থেকে খাবার তুলে নিয়ে সেগুলো সরবরাহ করেছি। কিন্তু তখন সারাক্ষণ আতঙ্কে দিন কাটিয়েছি। যেকোনো সময় রাজাকার, আল-বদর, আল-সামসদের সহায়তায় হানাদার পাকসেনা পাকড়াও করে আমাদের হত্যা করতে পারত। কতরাত বনে-জঙ্গলে কাটিয়েছি।
তখন যদি সেই যুদ্ধ করতে পারি, তাহলে এখন তো জীবনের শেষ প্রান্তে। তাহলে কেন করোনা যুদ্ধে যেতে পারবো না? এই ভাবনা আমার বিবেককে দারুণভাবে অনুপ্রাণিত করে।
টেলিভিশনের পর্দায় প্রায়ই দেখছিলাম, মহামারী প্রচণ্ডতার সময়ে চিকিৎসকদের অভাব। বিশেষ করে অভিজ্ঞ ডাক্তারের। এই সময়ে শুধু যে করোনার কারণে মৃত্যুর মিছিল চলছিল তাই নয়; করোনা ব্যতীত কিডনি বিকল, হৃদরোগসহ অন্যান্য চিকিৎসাযোগ্য ব্যধিতে অসংখ্য মৃত্যু হচ্ছিল, শুধু অভিজ্ঞ চিকিৎসকদের হাসপাতালে না পাওয়ার কারণে। সব দেখে মন স্থির করলাম, এবার স্বেচ্ছাসেবক নয় একেবারে সম্মুখযুদ্ধে নামতেই হবে। কারণ পুরো পৃথিবী আমাদের দিকে তাকিয়ে আছে!
যুগান্তর: করোনায় কিডনি রোগীদের সেবা দিতে গিয়ে কী কী চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়েছিলেন? ওই সময় কীভাবে আপনার হাসপাতালে রোগীরা সেবা পেয়েছেন?
অধ্যাপক ডা. এম এ সামাদ: করোনার প্রথম ঢেউয়ে তরুণ থেকে প্রবীণ পর্যন্ত সবাই যখন আতঙ্কে কর্মস্থল ত্যাগ করতে শুরু করেছে। করোনার প্রথম ঢেউ সবাইকে অত্যাধিক আতঙ্কিত করে ফেলে। জুনিয়র ডাক্তার নার্স ও অন্যান্য যারা স্বাস্থ্যসেবার সঙ্গে সম্পৃক্ত, তারা সবাই কাজ করবে কিনা দ্বিধান্বিত ছিল। এমতাবস্থায়, আমার উপস্থিতি তাদের সাহসী করে তুলল। ২০২০ সালের মে মাসে স্বাস্থ্যমন্ত্রী মহোদয় আমাদের হাসপাতালে ২০০ বেডের করোনা ইউনিট উদ্বোধন করছিলেন।
আমি কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে আনোয়ার খান মডার্ন হাসপাতাল এর তিনটি ডায়ালিসিস ইউনিটের প্রস্তাব পাস করিয়ে নেই। এর একটি সম্পূর্ণ করোনামুক্ত। দ্বিতীয়টি, যারা করোনা-সন্দেহ-যুক্ত ও তৃতীয়টি, যাদের করোনা- প্রমাণিতো কিডনি বিকল রোগী, তাদের জন্য। করোনা পজিটিভ রোগীদের জন্য চার বেডের ডায়ালাইসিস ইউনিট’টি বাস্তবায়িত করা একটি বড় চ্যালেঞ্জ ছিল। কারণ, প্রত্যক্ষ যমদূতের মাঝে একটানা ১২ ঘন্টা ডিউটি করার মতো পর্যাপ্ত ডাক্তার, নার্স জোগাড় করা ছিল অনেক কঠিন। সেই কারণে, বেশির ভাগ ফ্যাকাল্টি মেম্বার এই ইউনিটের বাস্তবায়ন নিয়ে সন্দিহান ছিলেন। কিন্তু স্টাফদের নিয়োগ দেয়ার সময় যখন তাদের আশ্বস্ত করলাম তাদের পাশে আমি থাকবো, তারা উৎসাহিত হল।
শুরু হল করোনা ইউনিটের ডায়ালাইসিস। শতাধিক মূল্যবান জীবন বেঁচে গেল এই ইউনিট থেকে ডায়ালাইসিস পেয়ে।
যুগান্তর: কর্মস্থলে আপনার সহযোদ্ধাদের নিয়ে কিছু বলুন।
অধ্যাপক ডা. এম এ সামাদ: আমি সম্মুখ যুদ্ধে থাকাতে সহকর্মীরা উৎসাহিত হয়। আমার সঙ্গে যারা করোনার সম্মুখ যুদ্ধে আমার সহকর্মীদের জানাই অন্তরের অন্তঃস্থল থেকে ভালোবাসা, শুভেচ্ছা ও কৃতজ্ঞত জানাই।
ক্যাম্পাসের চারটি ডায়ালাইসিস সেন্টারের একজন ডাক্তার বা স্টাফও করোনাকালীন সময়ে সেবা দিতে বিরত থাকেনি।
সবচেয়ে মজার ব্যাপার হলো, এই দীর্ঘ সময়ে করোনা ইউনিটের ৮ জন ডায়ালাইসিস টেকনিশিয়ানের একজনও করোনায় আক্রান্ত হয়নি।
যুগান্তর: করোনাকালীন কোন বিষয়টা আপনাকে আবেগতাড়িত করে? রোগীদের সেবা দিতে গিয়ে আপনি কখনও করোনায় আক্রান্ত হয়েছিলেন কিনা?
অধ্যাপক ডা. এম এ সামাদ: আমাদের হাসপাতালের যত জটিল কিডনি রোগী এসেছে তাদের পাশে থেকে চিকিৎসা দেবার সুযোগ পেয়েছি। এতে আরও নতুন অভিজ্ঞতা লাভের সুযোগ পেয়েছি। মনে ভয়ে সবার মতো আমাদেরও ছিল, কিন্তু মহান মুক্তিযুদ্ধের কথা চিন্তা করে, মনে ভীষণ সাহসের সঞ্চার হয় বলেই, করোনা মহামারীতে আমরা যথাযথ প্রস্তুতি নিয়ে, চিকিৎসা সেবা চালিয়ে গিয়েছি।
এটা মুক্তিযুদ্ধের চেতনা থেকে অনুপ্রেরণা পাওয়া। মনে একটা আশার সঞ্চার হয়, সাধারণ মানুষের পাশে থেকে দাঁড়িয়ে যদি যুদ্ধের মোকাবেলা করি, তাহলে আল্লাহ আমাদের পাশে থাকবেন। আর আল্লাহ আমাদের সহায় হয়েছেন। আমি করোনা ইউনিটে ১২ মাস দায়িত্ব পালন করেছি। কিন্তু আমি আক্রান্ত হইনি। আমি ছোট ছোট কিছু আক্রমণের শিকার হয় রেজিস্ট্যান্স বা অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিলাম। হয়তো, আমার মাধ্যমে করোনা আমার বাড়িতে গিয়েছে। আমার স্ত্রী, সন্তান ও পরিবারের অনেকেই আক্রান্ত হয়েছে। আল্লাহর রহমতে তারা চিকিৎসার পর ভালো হয়ে গিয়েছে। কিন্তু আল্লাহর রহমতে আমি করোনায় আক্রান্ত হইনি। আল্লাহ আমাকে সেভ করেছেন।
যুগান্তর: সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ
অধ্যাপক ডা. এম এ সামাদ: আপনাদেরকেও ধন্যবাদ।