Logo
Logo
×

সুস্থ থাকুন

অ্যানথ্রাক্স : সচেতনতা ও প্রতিরোধ জরুরি

Icon

অধ্যাপক ডা. এ বি এম আবদুল্লাহ

প্রকাশ: ২৯ নভেম্বর ২০২৫, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

অ্যানথ্রাক্স : সচেতনতা ও প্রতিরোধ জরুরি

গবাদিপশুর একটি প্রাণঘাতী রোগ অ্যানথ্রাক্স। ব্যাসিলাস অ্যানথ্রাসিস নামক ব্যাকটেরিয়ার কারণে হয়। গবাদিপশু যেমন-গরু, ছাগল, ভেড়া, মহিষ, শূকরের মতো পশুতে রোগটি দ্রুতগতিতে ছড়িয়ে পড়ে এমনকি কোনো দৃশ্যমান লক্ষণ ছাড়াই প্রাণীর মৃত্যু ঘটে। রোগটি নিয়ে বিস্তারিত লিখেছেন ইমেরিটাস অধ্যাপক ডা. এ বি এম আবদুল্লাহ

* অ্যানথ্রাক্সে আক্রান্ত পশুর মধ্যে কী কী লক্ষণ দেখা যায়

আক্রান্ত হওয়ার কিছুক্ষণের মধ্যেই রোগের লক্ষণ দেখা দেয়। জ্বর হয়, লোম খাড়া হয়ে যায়, খিঁচুনি ও বমি হয় এবং আক্রান্ত পশু সাধারণত ৪৮ ঘণ্টার মধ্যেই মারা যায়। আক্রান্ত পশুর নাক, মুখ, কান বা পায়ুপথ দিয়ে কালো রঙের তরল বা রক্ত বের হয়, যা জমাট বাঁধে না। এ রোগের তেমন কোনো কার্যকরী চিকিৎসা নেই।

* অ্যানথ্রাক্স কীভাবে পশুর মধ্যে ছড়ায়

অ্যানথ্রাক্সকে বলা হয় সয়েল বেজড্ রোগ। এটি মাটির মাধ্যমে পশুর মধ্যে ছড়ায়। অ্যানথ্রাক্সের জীবাণু স্পোর হিসাবে অনেকদিন, এমনকি শত বছর বাঁচতে পারে। পশু আক্রান্ত হয়ে মারা যাওয়ার পর সেই মৃত পশুর ভুঁড়ি বা মাংস যেখানে ফেলে রাখা হয়, কিংবা যেখানে চামড়া কাটা হয়, সেখানকার ঘাসে জীবাণু ছড়িয়ে পড়ে। অন্য কোনো পশু যদি সেই জীবাণুযুক্ত ঘাস খায়, তাহলে সে পশুটিও আক্রান্ত হয়।

* মানুষের অ্যানথ্রাক্স কত ধরনের

সাধারণত তিন ধরনের, চর্ম, পরিপাকতন্ত্র ও শ্বাসতন্ত্রে। আক্রান্ত পশুর সংস্পর্শে যারা আসে, কিংবা যারা চামড়া বা মাংস কাটে তাদের চর্ম জাতীয় অ্যানথ্রাক্স হওয়ার আশঙ্কা থাকে। ত্বক বা চামড়ায় প্রথমে ছোট ফোসকা বা ঘা দেখা দেয়, তাকে বলে মেলিগনেন্ট পাস্টিউল বা পুঁজভর্তি ফোড়া। আক্রান্ত পশুর মাংস ভালোভাবে সিদ্ধ করে না খেলে পরিপাকতন্ত্রে অ্যানথ্রাক্স হয়ে থাকে। এতে পেট ব্যথা, বমি, ডায়রিয়া এবং পায়খানার সঙ্গে রক্ত যেতে পারে। আরেকটি হয় শ্বাস-প্রশ্বাসের মাধ্যমে। বাতাসে, উল, পশম বা লেদারে লেগে থাকা জীবাণু বা স্পোর ফুসফুসে প্রবেশ করে। আক্রান্ত ব্যক্তির হাঁচি-কাশি, জ্বর, শ্বাসকষ্ট, নাক দিয়ে পানি ঝরা, বুক ব্যথা হতে পারে। চিকিৎসা না দিলে রোগী মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে। আমাদের দেশে শুধু চর্মের রোগটাই দেখা যায়। ফুসফুসে আক্রান্ত বা পেটে আক্রান্ত রোগী এখনো আমাদের দেশে পাওয়া যায়নি।

* অ্যানথ্রাক্স কীভাবে মানুষের মধ্যে ছড়ায়

মানুষ আক্রান্ত হয় সাধারণত মৃত বা আক্রান্ত পশুর লালা, রক্ত, হাড়, চামড়া বা পশম ও মাংসের সংস্পর্শে এলে। এমনকি আক্রান্ত পশুর মাংস স্পর্শ বা নাড়াচাড়ার মাধ্যমেও রোগটি ছড়াতে পারে। আক্রান্ত পশুর চামড়া থেকে ট্যানারিতে কর্মরত শ্রমিকদের মধ্যে ছড়াতে পারে। তাই কসাই, খামারি ও ট্যানারি কর্মীরা বেশি ঝুঁকিতে থাকেন। আক্রান্ত পশুর মাংস ফ্রিজে রাখলেও অ্যানথ্রাক্সের জীবাণু থাকে। আক্রান্ত প্রাণীর গোশত আধাকাঁচা বা আধারান্না করে খেলে গ্যাস্ট্রোইনটেসটাইনাল অ্যানথ্রাক্স হওয়ার ঝুঁকি থাকে, তবে ভালো করে সিদ্ধ মাংস খেলে আশঙ্কা থাকে না। রান্নার আগে যারা কাঁচা মাংসের সংস্পর্শে যান তাদের আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি থাকে। শ্বাস-প্রশ্বাসের মাধ্যমে জীবাণুর স্পোর ফুসফুসে ঢুকলে তা আক্রান্ত হতে পারে। এ রোগে মানুষ আক্রান্ত হলে মারা যাওয়া কিংবা বিকলাঙ্গ হওয়ার কোনো আশঙ্কা নেই।

* অ্যানথ্রাক্স কি ছোঁয়াচে

এটা ছোঁয়াচে নয়, মানুষ থেকে মানুষের মধ্যে ছড়ায় না। তাই এতে আতঙ্কিত হওয়ার কিছুই নেই এবং কেউ অ্যানথ্রাক্সে আক্রান্ত হলে তার থেকে দূরে থাকারও কোনো প্রয়োজন নেই। আসলে অ্যানথ্রাক্স শুধুই পশু থেকে মানুষের মধ্যে সংক্রমিত হয় এবং যারা আক্রান্ত পশু হ্যান্ডেল করে তারাই মূলত আক্রান্ত হয়। যারা পশুপালন ও ট্যানারি শিল্পের সঙ্গে জড়িত তাদের এ রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বেশি।

* স্বাভাবিক গরুর মাংস ও আক্রান্ত গরুর মাংস চেনার কোনো উপায় আছে কি

এটা আসলে চেনার কোনো উপায় নেই। আর আক্রান্ত গরু জবাই করা তো নিষেধ। কেউ যদি অন্যায়ভাবে আক্রান্ত গরু জবাই করে তাহলে তার দায়ভার বহন করতে হবে অনেককে। আর যদি আক্রান্ত গরুর মাংস বেশি সিদ্ধ করে কেউ খেয়েই ফেলে, তাহলে অ্যানথ্রাক্সে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা নেই।

* মানুষের ক্ষেত্রে অ্যানথ্রাক্স কি নিরাময় যোগ্য

মানুষ অ্যানথ্রাক্সে আক্রান্ত হলে তা শতভাগ নিরাময়যোগ্য। কারণ, রোগটি সাধারণত চামড়ায় হয়। সময়মতো ওষুধ সেবনে সম্পূর্ণরূপে ভালো হয়ে যায়। মারা যাওয়ার কোনো আশঙ্কা নেই।

* গরু ব্যবসায়ীদের জন্য পরামর্শ

গরু আক্রান্ত হওয়ার দু-চার ঘণ্টা থেকে দুই দিনের মধ্যে মারা যাবে। যেহেতু এর কোনো ওষুধ নেই, তাই গরু আক্রান্ত হওয়ার আগেই ব্যবসায়ীরা ভ্যাকসিনের মাধ্যমে এ রোগ প্রতিরোধ করতে পারবে এবং গরুকে টিকা দিতে হবে। ভ্যাকসিন দেওয়ার পর কোনো পশুর অ্যানথ্রাক্স হওয়ার আশঙ্কা নেই। আর যেগুলো আক্রান্ত হয়ে গেছে সেগুলোকে আর কিছুই করার নেই। তবে মারা যাওয়ার পর ৫-৭ ফুট গর্ত করে পুঁতে রাখতে হবে।

* প্রতিরোধে করণীয়

▶ গবাদিপশুকে নিয়মিত অ্যানথ্রাক্সের ভ্যাক্সিন দিতে হবে।

▶ আক্রান্ত পশুকে সুস্থ পশু ও মানুষের কাছ থেকে দূরে রাখতে হবে। অ্যানথ্রাক্সে আক্রান্ত গবাদিপশু এবং এ রোগে মৃত পশুর সংস্পর্শ এড়িয়ে চলতে হবে। আক্রান্ত পশুর বসবাসের ঘর ব্লিচিং পাউডার বা সোডা দিয়ে পরিষ্কার রাখতে হবে।

▶ আক্রান্ত পশুর পরিচর্যার সময় মাস্ক, গ্লাভস, এমনকি গাউন বা পিপিই পরা উচিত। আক্রান্ত পশুর সংস্পর্শে কেউ এলে তাকে সাবান বা অ্যান্টিসেপটিক দিয়ে হাত, মুখ ভালোভাবে পরিষ্কার করাতে হবে।

▶ আক্রান্ত এলাকার গবাদিপশু অ্যানথ্রাক্সমুক্ত না হওয়া পর্যন্ত অন্য কোথাও পাঠানো যাবে না। এমনকি আক্রান্ত অঞ্চল থেকে মাংস পরিবহণও নিষিদ্ধ করতে হবে।

▶ অ্যানথ্রাক্সে আক্রান্ত মৃত পশুর দেহ নদী-নালা, খাল-বিল, জলাশয় বা খোলা জায়গায় ফেলা যাবে না, পুড়িয়ে ফেললে সবচেয়ে ভালো। সেটি সম্ভব না হলে মাটিতে গভীর গর্ত করে পুঁতে ফেলতে হবে। শেয়াল, কুকুর যেন গর্ত করে তা বের করতে না পারে। এমনকি আক্রান্ত পশুর লালা, গোবর, রক্তসহ সবকিছুই একইসঙ্গে পুঁতে ফেলতে হবে।

▶ গবাদিপশু বহনকারীকে অবশ্যই বিশেষ ধরনের পোশাক পরতে হবে যেন তিনি আক্রান্ত না হন। মৃত পশুটিকেও পলিথিনজাতীয় কাপড়ে পেঁচিয়ে নিতে হবে, যাতে দেহ থেকে রক্ত, মলমূত্র, লালা ইত্যাদি ছড়িয়ে না যায়। মৃত পশুর চামড়া কোনো ক্রমেই ছাড়ানো যাবে না এবং কোন ট্যানারি শিল্পে ব্যবহার করা যাবে না।

▶ কোনো আক্রান্ত পশুর সংস্পর্শে আসার পর কারও গায়ে যদি সন্দেহভাজন চর্মরোগ দেখা দেয় অথবা শ্বাসকষ্ট, কাশি অথবা পেটের সমস্যা দেখা দেয়, তবে অবশ্যই তাকে ডাক্তারের পরামর্শ নিতে হবে।

▶ পশুশ্রমিক, কসাই ও চামড়া ব্যবসায়ীর নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা করতে হবে। যারা নিয়মিত পশুর সংস্পর্শে থাকেন তারা যেন খামারে কাজ করার সময় গ্লাভস, মাস্ক ব্যবহার এবং কাজ শেষে হাত-পা সাবান দিয়ে ভালো করে ধুয়ে নেন।

অ্যানথ্রাক্স প্রতিরোধে জনসচেতনতা বাড়ানো ছাড়া এ রোগ নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়। অ্যানথ্রাক্সে ভয় নয়, সচেতনতা ও নিয়মিত পশুকে টিকাদানের মাধ্যমেই এ রোগ প্রতিরোধ করা সম্ভব।

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম