Logo
Logo
×

সুস্থ থাকুন

থ্যালাসেমিয়া

প্রয়োজন সঠিক চিকিৎসা ও পরিচর্যা

Icon

ডা. মো. কামরুজ্জামান

প্রকাশ: ১০ মে ২০২৫, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

প্রয়োজন সঠিক চিকিৎসা ও পরিচর্যা

থ্যালাসেমিয়া একটি বংশগত রক্তস্বল্পতাজনিত রোগ। এটি কোনো ছোঁয়াচে রোগ নয়। রক্তের ক্যানসারও নয়। কেবল স্বামী-স্ত্রীর দু’জনই থ্যালাসেমিয়ার বাহক বা মাইনর বা ট্রেইট হলেই সন্তান থ্যালাসেমিয়ার রোগী হওয়ার ঝুঁকি থাকে। থ্যালাসেমিয়া বাহক যার একটি জিন ত্রুটিযুক্ত থাকে আর থ্যালাসেমিয়া রোগী যার দুইটি জিন ত্রুটিযুক্ত থাকে। সুতরাং থ্যালাসেমিয়া বাহক আর থ্যালাসেমিয়া রোগী এক কথা নয়। থ্যালাসেমিয়ার বাহক স্বাভাবিক মানুষরূপে বেড়ে ওঠে। তাই কেউ থ্যালাসেমিয়ার বাহক কি না, রক্তের পরীক্ষা ছাড়া তা বাহ্যিকভাবে বোঝার কোনো উপায় নেই। থ্যালাসেমিয়া রোগী জন্মের ৬ মাস বয়স হতে দূর্বল ও ফ্যাকাসে হয়ে যায়, জন্ডিস দেখা দেয়। আস্তে আস্তে পেটের প্লিহা ও লিভার বড় হয়ে যায়। ঠিকমতো শরীরের বৃদ্ধিও হয় না। রক্তস্বল্পতার জন্য প্রতি মাসে ১ থেকে ২ ব্যাগ রক্ত শরীরে নিতে হয়। ঘন ঘন রক্ত নেওয়ায় ও পরিপাক নালি থেকে আয়রনের শোষণ ক্ষমতা বেড়ে যাওয়ায় শরীরে আয়রনের মাত্রা বেড়ে যায়। ফলে লিভার, হৃদপিণ্ডসহ অন্যান্য অঙ্গের নানা রকম মারাত্মক জটিলতা দেখা দেয়। থ্যালাসেমিয়া রোগীকে বেঁচে থাকতে হলে সঠিক চিকিৎসা ও নিয়মিত রক্ত নিতে হয়। দেশে থ্যালাসেমিয়া স্ক্রিনিং প্রোগ্রাম না থাকায় অনেকেই জানেন না তিনি থ্যালাসেমিয়ার বাহক কিনা। তাই অজান্তেই থ্যালাসেমিয়া বাহকের মধ্যে বিয়ে হচ্ছে এবং দিন দিন থ্যালাসেমিয়া রোগী বাড়ছেই। যেহেতু থ্যালাসেমিয়া একটি বংশগত রোগ তাই ভাইবোনের (চাচাতো, মামাতো, খালাতো, ফুফাতো) মধ্যে বিয়ে এবং পরিবারের কারও থ্যালাসেমিয়া থাকলে থ্যালাসেমিয়া বাহক হওয়ার ঝুঁকি অনেক বেড়ে যায়।

* থ্যালাসেমিয়া বাহক আর রোগীর খাবারের ধরন এক নয়

থ্যালাসেমিয়া বাহকের খাবার স্বাভাবিক মানুষের মতো। আয়রন জাতীয় খাবারের নিষেধ নেই। বরং আয়রনের ঘাটতি হলে বেশি বেশি আয়রন জাতীয় খাবার খেতে দিতে হয়। যেসব থ্যালাসেমিয়া রোগী নিয়মিত রক্ত নিয়ে বেঁচে থাকে এবং যাদের শরীরে আয়রনের মাত্রা বেশি হয়ে যায় তাদের জন্য আয়রন জাতীয় খাবার নিষেধ করা হয়ে থাকে, শরীর থেকে আয়রন কমানোর জন্য ওষুধ খেতে হয়।

* ধরন

ক্লিনিক্যালি থ্যালাসেমিয়াকে তিনভাগে ভাগ করা হয়, যেমন থ্যালাসেমিয়া মেজর- যাদের অন্যের রক্ত ছাড়া মৃত্যু অনিবার্য, ইন্টারমিডিয়েট- যাদের কদাচিৎ রক্ত লাগে এবং মাইনর বা বাহক- যারা সুস্থ স্বাভাবিক মানুষের মতোই। থ্যালাসেমিয়া অনেক ধরনের আছে, যেমন-বিটা থ্যালাসেমিয়া, ই বিটা থ্যালাসেমিয়া, হিমোগ্লোবিন ই ডিজিজ, আলফা থ্যালাসেমিয়া, এস বিটা থ্যালাসেমিয়া, হিমোগ্লোবিন এস ডিজিজ, হিমোগ্লোবিন ডি পাঞ্জাব, হিমোগ্লোবিন ডি আরব ইত্যাদি।

* জেনেটিক কারণেই থ্যালাসেমিয়া হয়

লোহিত রক্ত কণিকার মধ্যে হিমোগ্লোবিন থাকে বিধায় রক্ত লাল দেখায়। স্বাভাবিক মানুষের লোহিত রক্ত কণিকার গড় আয়ু ১২০ দিন হলেও থ্যালাসেমিয়া রোগীর ত্রুটিপূর্ণ গ্লোবিনের কারণে লোহিত রক্ত কণিকার গড় আয়ু মাত্র ২০ থেকে ৬০ দিন। অপরিপক্ব অবস্থায় লোহিত রক্ত কনিকা ভেঙে যায় বা মারা যায়, তাই রক্তস্বল্পতা দেখা দেয়। মানবদেহে ২৩ জোড়া বা ৪৬টি ক্রোমোজোম থাকে। সন্তানের মধ্যে একটি ক্রোমোজম মায়ের আর একটি ক্রোমোজম বাবার কাছ থেকে আসে। ১৬নং ক্রোমোজোমে থাকে আলফা জিন আর ১১নং ক্রোমোজোমে থাকে বিটা জিন। আলফা ও বিটা জীনদ্বয় আলফা ও বিটা গ্লোবিন নামক প্রোটিন তৈরি করে, যা অনেক এমাইনো অ্যাসিডের সমষ্টি। জন্মগতভাবে ১৬ অথবা ১১নং ক্রোমোজোমের আলফা অথবা বিটা জিন সঠিকভাবে এমাইনো অ্যাসিড তৈরি করতে পারে না। ফলে আলফা অথবা বিটা গ্লোবিন নামক প্রোটিন ত্রুটিপূর্ণ হয়। আলফা অথবা বিটা গ্লোবিন চেইন ত্রুটিপূর্ণ থাকায় হিমোগ্লোবিন ত্রুটিপূর্ণ হয় বলে লোহিত রক্ত কণিকা দ্রুত ভেঙে যায় বা মারা যায় এবং রক্তস্বল্পতা দেখা দেয়।

* বংশাণুক্রমে কীভাবে রোগটির প্রসার ঘটে

বাবা-মা উভয়েই থ্যালাসেমিয়ার বাহক হলে প্রতিটি সন্তান জন্মদানে থ্যালাসেমিয়া রোগী হওয়ার ঝুঁকি শতকরা ২৫ ভাগ। বাহক হওয়ার ঝুঁকি শতকরা ৫০ ভাগ। সুস্থ হওয়ার সম্ভবনা শতকরা ২৫ ভাগ। বাবা-মা যেকোনো একজন থ্যালাসেমিয়ার বাহক হলে প্রতিটি সন্তান জন্মদানে থ্যালাসেমিয়া বাহক হওয়ার ঝুঁকি শতকরা ৫০ ভাগ, সুস্থ হওয়ার সম্ভবনা শতকরা ৫০ ভাগ। তবে থ্যালাসেমিয়া রোগী হওয়ার সম্ভবনা নেই।

* করণীয়

মা-বাবা দু’জনের জিনেই থ্যালাসেমিয়ার বাহক থাকলে সন্তানের থ্যালাসেমিয়া রোগী হওয়ার ঝুঁকি থাকে। তাই দু’জন বাহকের মধ্যে বিয়ে না হওয়া ভালো। কারণ সন্তানের রোগী হওয়ার ঝুঁকি আছে। তবে একজন সুস্থ মানুষ যে কাউকে (বাহক বা রোগীকে) বিয়ে করতে পারবে। কারণ, তাদের সন্তানের রোগী হওয়ার আশঙ্কা নেই। একজন বাহক আরেকজন বাহককে বিয়ে না করলে ঝুঁকি এড়ানো যায়। দু’জন থ্যালাসেমিয়া বাহকের মধ্যে যদি বিয়ে হয়েই যায় বা স্বামী-স্ত্রী দু’জনই থ্যালাসেমিয়ার বাহক হয়, তবে বাচ্চা পেটে আসার ৮ থেকে ১৪ সপ্তাহের মধ্যে গর্ভবতীর পেটের রক্ত/পানি (ক্রোওনিক ভিলাস স্যাম্পল বা এমনিওসেন্টেসিস) করে বাচ্চার অবস্থা জানা যায়। পেটের বাচ্চা থ্যালাসেমিয়ার রোগী হলে কাউন্সিলিং করতে হবে, যাতে একজন নতুন থ্যালাসেমিয়া রোগীর জন্ম না হয়। তবে থ্যালাসেমিয়া বাহক হলে বাচ্চার স্বাভাবিক জন্মদানে অসুবিধা নেই। তাই বিয়ের আগেই রক্ত পরীক্ষার মাধ্যমে প্রত্যেককে জানতে হবে থ্যালাসেমিয়ার বাহক কিনা। দু’জন থ্যালাসেমিয়া বাহকের মধ্যে বিয়ে নিরুৎসাহিত করে থ্যালাসেমিয়া রোগ প্রতিরোধ করা সম্ভব।

* কীভাবে জানা যাবে কেউ থ্যালাসেমিয়ার বাহক নাকি রোগী

হেমাটোলজি এনালাইজার মেশিনে সিবিসি (মাত্র ১৫০-৫০০ টাকার) পরীক্ষায় যদি হিমোগ্লোবিন স্বাভাবিক বা স্বাভাবিকের কাছাকাছি থাকে, লোহিত রক্তকণিকার পরিমাণ যদি বাড়ে, এমসিভি ৮০ এফএলের কম হয়, এমসিএইচ ২৭ পিজিএমের কম হয়, এমসিএইচসি ও আরডি ডব্লিউ স্বাভাবিক থাকে তাহলে থ্যালাসেমিয়া বাহক হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। হিমোগ্লোবিন ইলেকট্রোফোরাসেস (৬০০-২০০০ টাকার) পরীক্ষা করে থ্যালাসেমিয়া বাহক কিনা নিশ্চিত হওয়া যায়। তবে, ক্ষেত্রবিশেষ ডিএনএ এনালাইসিস লাগতে পারে।

* চিকিৎসা

সঠিক চিকিৎসা হচ্ছে নিয়মিত নিরাপদ রক্ত নেওয়া ও আয়রন চিলেশন, ডোনারের অস্থিমজ্জা প্রতিস্থাপন ও জিন থেরাপি যা অত্যন্ত ব্যয়বহুল। বাংলাদেশে এ চিকিৎসা সুবিধা সীমিত এবং অনেক রোগী এ চিকিৎসা পায় না। নিয়মিত রক্ত নিয়ে হেমাটোলজিষ্ট বা রক্তরোগ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের তত্ত্বাবধানে সঠিক চিকিৎসা নিলে থ্যালাসেমিয়া রোগীকে প্রায় ৩০ বছরের অধিক বাঁচান সম্ভব। কিছু ওষুধ দিয়ে চিকিৎসা নিলে রক্ত কম নেওয়া লাগে, প্লিহাও ছোট থাকে এবং প্লিহার অপারেশন দরকার হয় না। কিছু রোগী বিকল্প চিকিৎসার ওপর নির্ভর করে, যা থ্যালাসেমিয়ার জন্য কার্যকর নয় এবং রোগের অবস্থাকে আরও খারাপ করতে পারে। প্রতিবার রক্ত নেওয়া ও আয়রন কমানোর ওষুধসহ অন্য খরচে একজন থ্যালাসেমিয়া রোগীর চিকিৎসায় প্রতি মাসে ৩ থেকে ৫ হাজার টাকার বেশি খরচ হয়। তাই সবার পক্ষে চিকিৎসা নেওয়া সম্ভব হয় না এবং অকালে ঝরে যায় হাজারও প্রাণ। পরিবারে আসে দরিদ্রতা। অনেক পরিবারে থ্যালাসেমিয়া সম্পর্কে সচেতনতার অভাব রয়েছে, ফলে রোগটি প্রাথমিক পর্যায়ে শনাক্ত হয় না বা সঠিক চিকিৎসা শুরু করা হয় না।

লেখক : রক্তরোগ, ব্লাড ক্যানসার ও বিএমটি বিশেষজ্ঞ, ইউনিট প্রধান ও সহযোগী অধ্যাপক, (বিএমটি, হেমাটোলজি), ঢাকা মেডিকেল কলেজ।

চিকিৎসা

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম