মুখের ক্যানসার রোগী এত বেশি কেন
অধ্যাপক ডা. অরূপরতন চৌধুরী
প্রকাশ: ০১ নভেম্বর ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
ছবি: সংগৃহীত
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
একজন ক্যানসার বিশেষজ্ঞের উক্তি-‘ক্যানসারে যত লোকের মৃত্যু হয়, চিকিৎসায় দেরি হওয়ার জন্য মারা যায় সমসংখ্যক লোক’। প্রাথমিক অবস্থায় ধরা পড়লে অধিকাংশ ক্যানসার নিরাময়যোগ্য। ক্যানসার হওয়ার আশঙ্কা থাকলে দেহে যেসব প্রাথমিক লক্ষণ দেখা যায়, এ সম্বন্ধে অনেকে অবহিত নন। ক্যানসারকে মোকাবিলা করার প্রথম শর্ত হলো রোগ সম্বন্ধে জানা, এর প্রাথমিক লক্ষণগুলো শনাক্ত করা এবং অভিজ্ঞ ডাক্তারের পরামর্শ নেওয়া। কোনো ক্রমেই চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া যেন বিলম্বিত না হয়, কারণ এতে রোগ অগ্রসর হতে থাকে এবং পরে দেহের বিভিন্ন স্থানে ক্যানসার কোষের উপনিবেশ গড়ে ওঠে।
বাংলাদেশে মুখগহ্বর ক্যানসারে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা অনেক বেশি। নতুন রোগীর সংখ্যাও বাড়ছে দিন দিন। খাদ্যনালি কিংবা মুখগহ্বরের কোনো অংশে ক্যানসার হলে একপর্যায়ে রোগীর জন্য খাবারদাবার গ্রহণের স্বাভাবিক নিয়ম কষ্টকর হয়ে পড়ে।
মুখগহ্বরের ক্যানসারের সঙ্গে একজন মানুষের প্রতিদিনের জীবনধারা বিশেষভাবে সম্পর্কিত। যেসব অভ্যাসের কারণে মুখগহ্বরের সরাসরি ক্ষতি হয়, সেগুলো সম্পর্কে সচেতন হওয়া আবশ্যক। যেমন-তামাক মুখগহ্বর ও খাদ্যনালির শত্রু, সেটা যেভাবেই তা গ্রহণ করা হোক না কেন। তামাক ও তামাকজাত দ্রব্যের কারণে মুখগহ্বর ও খাদ্যনালির কোষে ক্ষত সৃষ্টি হতে থাকে। এ ক্ষত থেকেই এক সময় ক্যানসার হয়।
সিগারেট, ই-সিগারেট, পান, সাদাপাতা, সুপারি, চুন, জর্দা, গুল, খইনি-সবই মুখগহ্বর ও খাদ্যনালির ক্যানসারের জন্য দায়ী। আমাদের দেশের বহু মানুষ এসব তামাকের কোনো না কোনোটি গ্রহণ করেন। বর্তমান সময়ে তরুণদের মধ্যে ধূমপানের হার অনেক বেড়েছে। আমাদের দেশের যত মানুষ মুখগহ্বর ও খাদ্যনালির ক্যানসারে আক্রান্ত, তাদের ৮০-৯০ শতাংশেরই তামাক বা তামাকজাত পণ্য সেবনের কারণ রয়েছে। সেইসঙ্গে অ্যালকোহল ও অনেকে পানের সঙ্গে জর্দা ব্যবহার করেন, এ ধরনের নেশাও ক্যানসারের ঝুঁকি বাড়ায়।
যারা পানের সঙ্গে জর্দা খান এবং নিয়মিত অনেকবার পান খান তাদের মুখের ঘা বেশি হয় এবং লক্ষ করা গেছে অনেকেই তামাক পাতাকে হাতের মধ্যে নিয়ে চুনের সঙ্গে মিশিয়ে গালের মধ্যবর্তী স্থানে রাখেন, তা দীর্ঘদিন ব্যবহারের ফলে ওই স্থানে ঘা হতে পারে। শুধু ঘা নয় পরে এ ঘা ক্যানসারেও রূপ নিতে পারে। যারা জর্দা বা তামাক পাতা খান তাদের রিস্ক-ফ্যাক্টর বা ঝুঁকি হতে পারে ৬০ ভাগ এবং যারা ধূমপান করেন এবং সেইসঙ্গে তামাক পাতা পানের সঙ্গে ব্যবহার করেন তাদের ঝুঁকি শতকরা ৮০ ভাগ।
ডেন্টাল সার্জনরা মুখগহ্বরের রুটিন পরীক্ষার সময় অনেক ক্ষেত্রে ক্যানসার শনাক্ত করেন। মুখগহ্বরের ক্যানসারের মধ্যে জিহ্বায় হয় ২০ শতাংশ, ঠোঁটে ১৫ শতাংশ এবং লালাগ্রন্থি ১০ শতাংশ। ২৫ শতাংশ হলো গলদেশের ক্যানসার। এ ছাড়া মাড়ি, তালু, টনসিল, চোয়ালেও এ ক্যানসার হয়। যারা ধূমপান করেন, তাদের মুখে ক্যানসার বেশি হয়। সিগার ও পাইপ খেলেও মুখের ক্যানসার হয় খুব বেশি।
যদি লক্ষ করা যায়, মুখগহ্বরের একটি ক্ষত বা ঘা যা শুকাচ্ছে না, এবং সহজেই এ থেকে রক্তক্ষরণ হচ্ছে, গিলতে অসুবিধা হচ্ছে, সব সময় গলায় কোনো কিছুর উপস্থিতি অনুভূত হচ্ছে, তাহলে অবশ্যই বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের পরামর্শ প্রয়োজন। এরকম লক্ষণ হওয়া মানেই ক্যানসার নয়, শুধু প্রয়োজন হলো একজন ডাক্তার দেখিয়ে নিশ্চিত হওয়া। ডেন্টাল সার্জনের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা হলো-মুখগহ্বরের রুটিন পরীক্ষার সময় অথবা অন্য সময় যখন দাঁত বা মুখগহ্বরের চিকিৎসা করছেন তখন তাদের দায়িত্ব হবে মুখগহ্বরের কোষকলায় কোনো অস্বাভাবিক পরিবর্তন হচ্ছে কিনা তা লক্ষ করা। সুতরাং কেউ যদি নিয়মিত ডেন্টাল সার্জন দিয়ে বছরে অন্তত একবার মুখের চেকআপ করান, তাহলে এরকম কিছু ঘটে থাকলেও চিকিৎসক সূচনাকালেই একে শনাক্ত করতে পারেন।
যারা মুখগহ্বরের পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার ব্যাপারে যত্নশীল নন কিংবা যাদের দাঁতের অংশ অত্যধিক ধারালো, তাদের মুখের ক্যানসারের ঝুঁকি বেশি। বিভিন্ন ক্ষতিকর রাসায়নিক দিয়ে প্রক্রিয়াজাত করা খাবার খেলেও হতে পারে মুখের ক্যানসার। যাদের ডায়াবেটিস আছে এবং তা নিয়ন্ত্রণে থাকে না, তাদের এ মুখের ক্যানসার হওয়ার প্রবণতা অন্যদের চেয়ে বেশি।
* প্রতিকার
সাধারণভাবে মুখগহ্বর ক্যানসারের চিকিৎসার জন্য অস্ত্রোপচার ও রেডিওথেরাপিই মূল চিকিৎসা। কোনো কোনো রোগীর কেমোথেরাপিরও প্রয়োজন হতে পারে। নির্ধারিত থেরাপিরও সুযোগ রয়েছে। যারা নিয়মিত তামাক বা তামাকজাত পণ্য গ্রহণ করেন, তাদের কোনো উপসর্গ না থাকলেও চিকিৎসকের পরামর্শ মাফিক কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষা করানো উচিত। কারণ, প্রাথমিক অবস্থায় ক্যানসার ধরা পড়লে চিকিৎসা পদ্ধতি সহজ হয়। যেমন-এসব ক্ষেত্রে বায়াপসি বা মাংস পরীক্ষা করা জরুরি। তাহলে সুনির্দিষ্টভাবে তার রোগনির্ণয় বা ক্যানসার কোন পর্যায়ে রয়েছে তা জানা যায়।
* প্রতিরোধ
মুখগহ্বরের ক্যানসার প্রতিরোধে করণীয়-
▶ ধূমপান, তামাক ও তামাকজাত যে কোনো পণ্য সেবন বন্ধ করা।
▶ মুখগহ্বর পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখা। প্রতিদিন দুবেলা দাঁত ব্রাশ এবং খাওয়ার পর ভালোভাবে কুলকুচি করা প্রয়োজন।
▶ দাঁতের কোনো অংশ ধারালো থাকলে চিকিৎসা করা।
▶ ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখা।
▶ প্রচুর ফলমূল ও শাকসবজি গ্রহণ এবং আয়রনসমৃদ্ধ খাবার গ্রহণ।
▶ শারীরবৃত্তীয় কারণে মহিলাদের আয়রনের ঘাটতি বেশি হয়। তাদের পুষ্টিকর খাবার গ্রহণ নিশ্চিত করা আবশ্যক।
▶ ফাস্টফুড বা প্রোসেস ফুড বাদ দেওয়া প্রয়োজন।
▶ অতিরিক্ত অ্যাসিডিটি থাকলে চিকিৎসকের পরামর্শ গ্রহণ করা।
▶ অতিরিক্ত ঝাল কিংবা অতিরিক্ত গরম খাবার ও পানীয় বর্জন করা।
▶ সব ধরনের মাদক ও অ্যালকোহল বর্জন করা।
সবচেয়ে বড় কথা, যদি আমরা তামাক, ধূমপান, জর্দা ইত্যাদি বর্জন করতে পারি, তাহলে মুখের, গলার ও ফুসফুসের ক্যানসারসহ অনেক ক্যানসারই প্রতিরোধ করতে পারব।
লেখক : ডেন্টাল সার্জন
