হরমোন জীবন ও যৌবনের সঙ্গী
ডা. এম এ হালিম খান
প্রকাশ: ০৮ নভেম্বর ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
শরীরকে প্রায়ই একটি যন্ত্রের সঙ্গে তুলনা করা যায়। যন্ত্রের কাজ চলে বিদ্যুৎ দিয়ে, আর মানুষের শরীর চলে হরমোনের অদৃশ্য শক্তিতে। হরমোন হলো বিশেষ রাসায়নিক বার্তাবাহক যা রক্তের মাধ্যমে শরীরের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গে বার্তা পৌঁছে দেয় এবং প্রতিটি অঙ্গকে সঠিকভাবে কাজ করতে সাহায্য করে। জন্মের মুহূর্ত থেকে শুরু করে শৈশব, কৈশোর, যৌবন, মধ্য বয়স, এমনকি বার্ধক্য ও মৃত্যুর সময়েও মানুষের প্রতিটি ধাপেই হরমোন নীরবে নিয়ন্ত্রণ চালিয়ে যায়।
ভ্রূণের গঠন, শিশুর বৃদ্ধি, কিশোরের কণ্ঠস্বর ভারী হয়ে ওঠা, নারীর মাসিক চক্র, মায়ের মাতৃত্ব, পুরুষের পিতৃত্ব, বয়ঃসন্ধির উত্তেজনা, যৌবনের স্বপ্ন, এমনকি বার্ধক্যের ক্লান্তি- সবই আসলে হরমোনের মাধ্যমে পরিচালিত। হরমোন যেন আমাদের জীবনের নেপথ্যের পরিচালক; আমাদের সুখ-দুঃখ, শক্তি-দুর্বলতা, ইচ্ছা-অনিচ্ছা সবই কোনো না কোনোভাবে এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে।
চলুন, বিজ্ঞানের আলোকে দেখে নেই জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত হরমোন কীভাবে আমাদের জীবনের প্রতিটি অধ্যায়কে প্রভাবিত করে।
* গর্ভকালীন জীবন : অস্তিত্বের সূচনা
মানুষের জীবনের শুরু হয় মাতৃগর্ভে। এ সময় হরমোনের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
▶ এইচসিজি : গর্ভধারণ বজায় রাখে।
▶ ইস্টোজেন ও প্রোজেস্টেরন : ভ্রূণকে সুরক্ষিত পরিবেশ দেয় এবং জরায়ু প্রস্তুত করে।
▶ থাইরয়েড হরমোন : ভ্রূণের মস্তিষ্ক ও স্নায়ুতন্ত্রের বিকাশ ঘটায়।
▶ গ্রোথ হরমোন ও ইনসুলিন : অঙ্গপ্রত্যঙ্গের বৃদ্ধি ও শক্তি জোগাতে কাজ করে।
বলা যায়, জন্মের আগেই জীবন গড়ে তোলার কাজে হরমোন অগ্রণী ভূমিকা রাখে।
* শৈশব : বৃদ্ধি ও বিকাশের অধ্যায়
শিশুর জন্মের পর হরমোন আরও নতুনভাবে কাজ শুরু করে।
▶ গ্রোথ হরমোন : হাড় ও পেশি বাড়ায়।
▶ থাইরয়েড হরমোন : বুদ্ধিবিকাশ, শেখার ক্ষমতা ও স্মৃতিশক্তি বাড়ায়।
▶ ইনসুলিন : খাবার থেকে পাওয়া শক্তিকে কাজে লাগায়।
▶ মেলাটোনিন : ঘুম-জাগরণ নিয়ন্ত্রণ করে।
▶ থাইমাস হরমোন : রোগ-প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরি করে।
হরমোন ছাড়া শিশুর স্বাভাবিক বৃদ্ধি ও বুদ্ধিবিকাশ অসম্ভব।
* কৈশোর : জীবনের মোড় পরিবর্তন
কৈশোরে হরমোনের প্রভাব নাটকীয়ভাবে দৃশ্যমান হয়।
▶ GnRH, LH, FSH : যৌন হরমোন উৎপাদন শুরু করে।
▶ টেস্টোস্টেরন : কণ্ঠস্বর ভারী হয়, দাড়ি-গোঁফ গজায়, পেশি শক্তিশালী হয়।
▶ ইস্টোজেন ও প্রোজেস্টেরন : স্তন বিকাশ, মাসিক চক্র ও প্রজনন ক্ষমতা তৈরি হয়।
▶ গ্রোথ হরমোন : দ্রুত শারীরিক বৃদ্ধি ঘটে।
কৈশোর হলো হরমোনের এক বৈপ্লবিক রূপান্তরের সময়।
* যৌবন : পূর্ণতার অধ্যায়
প্রাপ্তবয়স্ক জীবনে হরমোন যৌনতা, প্রজনন ও শক্তি বজায় রাখে।
▶ টেস্টোস্টেরন ও ইস্টোজেন : যৌন ইচ্ছা ও প্রজনন ক্ষমতা নিয়ন্ত্রণ করে।
▶ ইনসুলিন ও মেটাবলিক হরমোনস : খাবারকে শক্তিতে রূপান্তরিত করে।
▶ কটিসল (স্ট্রেস হরমোন) : চাপ সামলায়, তবে বেশি হলে ক্ষতিকর হয়।
▶ থাইরয়েড হরমোনস : দেহের মেটাবলিজম ও শক্তি ব্যয় নিয়ন্ত্রণ করে।
▶ যৌবনকাল হলো হরমোনের সর্বাধিক সক্রিয় অধ্যায়।
* মধ্যবয়স : পরিবর্তনের সূচনা
বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে হরমোনের ভারসাম্য নষ্ট হতে শুরু করে।
▶ পুরুষদের ক্ষেত্রে টেস্টোস্টেরন কমে যায়, যৌন আগ্রহ হ্রাস, পেশি দুর্বলতা, স্থূলতা।
▶ নারীদের ক্ষেত্রে মেনোপোজ-এ ইস্টোজেন কমে যায়। মাসিক বন্ধ, গরমে হঠাৎ ঘাম, যোনি শুষ্কতা, হাড় ভাঙার ঝুঁকি।
▶ ইনসুলিন রেজিস্টেন্স বাড়ে, ডায়াবেটিসের ঝুঁকি।
▶ কটিসল দীর্ঘস্থায়ীভাবে বাড়তে থাকে, মানসিক চাপ, উচ্চরক্তচাপ হয়।
▶ মধ্যবয়সে হরমোননির্ভর রোগ বেড়ে যায়, যা জীবনযাত্রায় বড় প্রভাব ফেলে।
* বার্ধক্য : ক্ষয়ের অধ্যায়
বার্ধক্যে হরমোন ধীরে ধীরে ক্ষয় হতে থাকে।
▶ গ্রোথ হরমোন কমে যায়, শরীর শুকিয়ে যায়, চামড়া পাতলা হয়।
▶ টেস্টোস্টেরন ও ইস্টোজেন হ্রাস পায়, যৌন আগ্রহ কমে, হাড় ভঙ্গুর হয়।
▶ মেলাটোনিন কমে যায়, ঘুমের সমস্যা বাড়ে।
▶ ডোপামিন ও সেরোটোনিন কমে যায়, বিষণ্নতা, আলঝেইমার, পারকিনসনসের ঝুঁকি বাড়ে।
▶ হরমোনের পতনই বার্ধক্যের সবচেয়ে বড় বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা।
* জীবনের অন্তিম অধ্যায়
জীবনের শেষ সময়ে হরমোন নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা ভেঙে পড়ে। কর্টিসলসহ নানা হরমোনের ভারসাম্যহীনতা অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ দুর্বল করে, রোগ-প্রতিরোধ ক্ষমতা হ্রাস করে। অবশেষে এ পরিবর্তনই মৃত্যু ডেকে আনে।
লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, হরমোন ও ডায়াবেটিস রোগ বিভাগ, শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল, ঢাকা
