Logo
Logo
×

সুস্থ থাকুন

বায়ুদূষণ ও স্বাস্থ্য সমস্যা

Icon

অধ্যাপক ডা. এ বি এম আব্দুল্লাহ

প্রকাশ: ০৮ নভেম্বর ২০২৫, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

বায়ুদূষণ ও স্বাস্থ্য সমস্যা

জলবায়ু পরিবর্তনসহ বিশ্বের বড় বড় শহরগুলোতে বায়ুদূষণ এক মারাত্মক সমস্যা। শিশু থেকে বৃদ্ধ সবাই বায়ুদূষণের ফলে মারাত্মক স্বাস্থ্য ঝুঁকির সম্মুখীন হচ্ছেন এবং দিন দিন এ স্বাস্থ্য সমস্যাগুলো আরও বেড়েই চলছে। সুস্থ ও সুন্দরভাবে বেঁচে থাকার জন্য কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদানের মধ্যে বায়ু অন্যতম।

নির্মল ও পরিচ্ছন্ন বায়ু আমাদের শ্বাস-প্রশ্বাসের জন্য অনিবার্য, সুস্বাস্থ্যের জন্য সহায়ক। তাই বায়ুদূষণ প্রতিরোধ করা আমাদের সবার দায়িত্ব।

সম্প্রতি ‘বিশ্ব ধরিত্রী দিবস ২০২৫’ বায়ুদূষণ নিয়ন্ত্রণে করণীয় শীর্ষক বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) ও বায়ুমণ্ডলীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্রের (ক্যাপস) উদ্যোগে আলোচনায় জানা যায়, ঢাকায় গত ৯ বছরে মানুষ মাত্র ৩১ দিন নির্মল বা ভালো বায়ুতে নিশ্বাস নিতে পেরেছে। আর বিগত ২০২৪ সালে মানুষ সবচেয়ে ভালো বায়ুমান পেয়েছে মাত্র ২ দিন এবং সবচেয়ে খারাপ বায়ুমান ছিল ৩৫ দিন।

সংস্থাটি বলছে, ঢাকাবাসী ২০১৬ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত ৯ বছরে (৩,১১৪ দিন) মাত্র ৩১ দিন নির্মল বাতাসে নিশ্বাস নিয়েছে, যা গত ৬ বছরের মধ্যে মাত্র ১ শতাংশ সময়। এ ছাড়া ৬২৪ দিন (২০ শতাংশ) মাঝারি বায়ু, ৮৭৮ দিন (২৮ শতাংশ) সংবেদনশীল বায়ু, ৮৫৩ দিন (২৭ শতাংশ) অস্বাস্থ্যকর, ৬৩৫ দিন (২১ শতাংশ) খুব অস্বাস্থ্যকর এবং ৯৩ দিন (৩ শতাংশ) পেয়েছে দুর্যোগপূর্ণ বায়ু। ২০২৪ সালের সবচেয়ে ভালো ও সবচেয়ে খারাপ বায়ুমানের দিন সংখ্যা ছিল যথাক্রমে ২ ও ৩৫ দিন।

* বায়ুদূষণের কারণ ও উৎস

পরিবেশ সচেতনতা এবং সঠিক পরিকল্পনার অভাবে আমাদের বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কার্যক্রম এবং পরিবেশ দূষণ পরস্পরের কারণ হিসাবে প্রতীয়মাণ হচ্ছে। সবচেয়ে ক্ষতিকর যানবাহনের কালো ধোঁয়া, বিশেষ করে মেয়াদোত্তীর্ণ এবং ফিটনেসবিহীন যানবাহন থেকেই বের হচ্ছে কালো ধোঁয়া, যা বিষাক্ত।

বায়ুদূষণের ২৮ শতাংশের জন্য দায়ী যানবাহনের ধোঁয়া। এ ছাড়া কারখানা ১৩ শতাংশ, ইটভাটা ১১ শতাংশ এবং নির্মাণ প্রকল্পের ধুলাবালি ৮ শতাংশ, বাকি অংশ আসে আবর্জনা পোড়ানো, গৃহস্থালির ধোঁয়া ও জীবাশ্ম জ্বালানির অনিয়ন্ত্রিত ব্যবহার থেকে। অপরিকল্পিত অবৈধ এবং অবৈজ্ঞানিকভাবে ইটভাটার কার্যক্রম চালানো, যা বায়ুদূষণের অন্যতম কারণ।

এ ছাড়া মেয়াদোত্তীর্ণ যানবাহন ও শিল্পকারখানা থেকে নির্গত কালো ধোঁয়া, উন্মুক্তভাবে ইট-বালি পরিবহণ করা, ভবন নির্মাণের সময় খোলা জায়গায় অথবা রাস্তার ওপরে সেগুলো রেখে দেওয়া, বিভিন্ন রাস্তায় ইট-ভাঙা এবং যত্রতত্র ইটের টুকরা, বালি, মাটি, পলিথিন ফেলে রাখা, বিভিন্ন রকমের নির্মাণকার্য, সড়ক খনন এবং বর্জ্য দহন বায়ুদূষণের অন্যতম কারণ। এ ছাড়া মানব সৃষ্ট বিভিন্ন কারণও স্পষ্ট, এমনকি নববর্ষ উদযাপনে ব্যাপকভাবে বায়ু দূষিত হয়ে থাকে। অনেক স্থানে মহাসড়কের পাশে ফেলা হয় ময়লা, রাতের আঁধারে লরি ও ভ্যানে নিয়মিত ফেলা হচ্ছে বাড়ি ও কারখানার বর্জ্য।

আবর্জনার স্তূপ, দূষিত বায়ু আর দুর্গন্ধ নগরবাসীর জীবনকে করে তুলেছে দুর্বিষহ। আবর্জনার স্তূপ থেকে নির্গত দূষিত পদার্থ বৃষ্টির পানির সঙ্গে মিশে কাছের জলাশয়গুলোকে দূষিত করছে এবং এর সঙ্গে জনস্বাস্থ্য ও জীববৈচিত্র্য উভয়ের জন্যই মারাত্মক ক্ষতিকর কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

এ ছাড়া প্রায়ই দেখা যায় উন্মুক্ত স্থানে পলিথিন ও বর্জ্য পোড়ানো হচ্ছে, যার ফলে বায়ুমণ্ডলে মিশছে আরও বিষাক্ত ধোঁয়া। এসব কার্যকলাপ পরিবেশ দূষণকে আরও তীব্র করে তুলছে এবং নগরবাসীকে শ্বাসকষ্টসহ নানাবিধ স্বাস্থ্য সমস্যার সম্মুখীন করছে, যা উদ্বেগজনক।

আবার এসব ময়লা সবসময় ফেলা হলেও নিয়মিত ডাম্পিংয়ের অভাব দেখা যায় বা করা হয় না। তাই মহাসড়কের পাশে প্রায়ই দেখা যায় ময়লার স্তূপ। এ ছাড়া পর্যাপ্ত গাছপালা না থাকার কারণে দিন দিন কার্বন ডাই-অক্সাইডের মাত্রা বৃদ্ধি পাচ্ছে, আর কমছে অক্সিজেন। কারণ কার্বন ডাই-অক্সাইড গ্রহণ করে গাছ, আর বাতাসে ছাড়ে অক্সিজেন। বড় শহরে ১০-১২ শতাংশ জলাভূমি থাকতে হয়, আছে ৩ শতাংশের কম। সবুজ থাকতে হয় ১৫ শতাংশ, আছে ৭ শতাংশ।

* কী কী স্বাস্থ্য সমস্যা হতে পারে

বায়ুদূষণের ফলে স্বাস্থ্যের ওপর মারাত্মক প্রভাব পড়ে। ধুলাবালি নাক-মুখ দিয়ে শ্বাসতন্ত্রে আক্রান্ত করে বেশি। প্রথমেই চোখ-নাক আক্রান্ত হওয়ার ফলে চোখ লাল হয়, পানি ঝরে, এলার্জি হয়।

নাকে প্রবেশ করে নাক বন্ধ হওয়া, নাকে পানি, অনবরত হাঁচি, নাকে এলার্জি বা রাইনাইটিস, সাইনোসাইটিস এমনকি নাকে রক্তক্ষরণও হতে পারে। মুখে প্রবেশ করলে টনসিল, ফ্যারিংস, ল্যারিংসে প্রদাহ হয়ে কাশিসহ গলার স্বর ক্ষতিগ্রস্ত হয়। বায়ুদূষণে এলার্জি, সোরিয়াসিসসহ বিভিন্ন চর্ম রোগের জন্য হতে পারে মারাত্মক। শ্বাসনালি ও ফুসফুসে আক্রান্তের ফলে সাধারণ কাশি, অ্যাজমা বা হাঁপানি, ব্রঙ্কাইটিস, এমফাইসিমা, সিওপিডি, নিউমোনিয়াসহ অন্য ভাইরাল ইনফেকশনের প্রকোপ বাড়তে পারে। এভাবে দীর্ঘদিন দূষিত বায়ুর গ্রহণের প্রভাবে ফুসফুসের ক্যানসারসহ অন্য রোগ যেমন-হৃদরোগ, উচ্চরক্তচাপ, মস্তিষ্ক, লিভার ও কিডনিসহ অন্য অঙ্গের রোগ হতে পারে।

বায়ুদূষণের কারণে সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে রয়েছেন বয়স্ক, শিশু ও জটিল রোগে আক্রান্ত মানুষরা। সবচেয়ে ক্ষতি হয় শিশুদের, বায়ুতে অতিরিক্ত সিসার উপস্থিতি শিশুদের মানসিক বৃদ্ধিকে ব্যাহত করে তাদের শারীরিক ও মানসিক বিকাশে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে, বুদ্ধিমত্তার বিকাশ ব্যাহত হয় এবং স্নায়ুর ক্ষতি হতে পারে। শিশুর রোগ-প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যাওয়ার পাশাপাশি বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকিও বেড়ে যায়। পাঁচ বছরের কম বয়সি শিশুদের জন্য বিশ্বব্যাপী মৃত্যুর দ্বিতীয় প্রধান কারণ এখন বায়ুদূষণ।

বিশ্বে এ বয়সে যত শিশুর মৃত্যু হয়, তার এক চতুর্থাংশের বেশির জন্য দায়ী বায়ুদূষণ। গর্ভবতী মহিলাদের শারীরিক ক্ষতি, গর্ভের সন্তানের ওজন কম হওয়া ও অকাল প্রসব, জন্মগত ত্রুটি, মস্তিষ্কের বিকাশ ব্যাহত হয়ে বুদ্ধি প্রতিবন্ধী হওয়ার মতো ঝুঁকি বাড়তে পারে।

এ ছাড়া বায়ুতে সিসার পরিমাণ বেশি থাকলে স্নায়ুতন্ত্রের রোগ, পেটের পীড়াসহ রক্তশূন্যতার মতো জটিল রোগের আশঙ্কা বেশি হতে পারে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, প্রতিবছর বিশ্বে বায়ুদূষণের কারণে মৃত্যু হয় প্রায় ৭০ লাখ মানুষের। এসব মৃত্যুর প্রধান কারণ হলো স্ট্রোক, হৃদরোগ, দীর্ঘস্থায়ী শ্বাসকষ্ট, সিওপিডি, ফুসফুসের ক্যানসার এবং শ্বাসযন্ত্রের তীব্র সংক্রমণ। এর মধ্যে জীবাশ্ম জ্বালানি থেকে বায়ুদূষণ প্রতিবছর বিশ্বব্যাপী ৫২ লাখ মানুষের মৃত্যুর কারণ। প্রতিবছর প্রায় ৩২ লাখ মানুষ রান্নাবান্না ও গৃহস্থালিজনিত বায়ুদূষণের শিকার হয়ে মারা যায়।

* প্রতিরোধে করণীয়

পরিবেশ দূষণ এড়ানোর জন্য শুধু সরকার বা কর্তৃপক্ষের দিকে তাকিয়ে থাকলেই চলবে না। নিজেরা আগে পরিবেশ রক্ষার ব্যাপারে সচেতন হতে হবে। রাস্তায় পানি দিয়ে ধুলা নিয়ন্ত্রণ বা ময়লাগুলো পুড়িয়ে ফেলার মতো নানা ব্যবস্থা নিতে হবে। সম্ভব হলে বর্জ্য দহনের ফলে সৃষ্ট বায়ুদূষণ বন্ধে বর্জ্য থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনের ব্যবস্থা করা যেতে পারে।

যে কোনো উন্নয়নমূলক কাজ তো বন্ধ রাখা যাবে না, তাই উন্নয়নমূলক কাজের সঙ্গে সঙ্গে আইন মেনে ও যথাযথ পরিকল্পনার মাধ্যমে সম্ভাব্য দূষণ প্রতিরোধের ব্যবস্থা নিতে হবে। পরিকল্পিতভাবে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে ইটভাটার কার্যক্রম চালানো, পরিবেশসম্মত ইট উৎপাদন ও ব্যবহার বৃদ্ধিতে কার্যকর পদক্ষেপ এবং কারখানাগুলোর বর্জ্য নিষ্কাশনসহ ধোঁয়া কমিয়ে আনার যথাযথ ব্যবস্থা নিতে হবে। কারখানাগুলো শহরের বাইরে নিয়ে যাওয়া যেতে পারে, এমনকি নতুন কারখানা তৈরির সময় পরিবেশবান্ধব ব্যবস্থা নিতে হবে। বিদ্যুৎ উৎপাদন ও শিল্প কারখানায় বিশ্বমানের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নিঃসরণ মাননির্ধারণ এবং তার কঠোর প্রয়োগ নিশ্চিতকরণ খুবই জরুরি।

মেয়াদোত্তীর্ণ ও অনুপযুক্ত এবং পুরোনো যানবাহন পরিবর্তন করতে হবে, যানবাহনে আধুনিক নির্গমন নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা চালু ও গণপরিবহণ ব্যবস্থার উন্নয়নসহ উন্নত জ্বালানি ব্যবহার করতে হবে এবং ট্রাফিক জ্যামের সমাধান করতে হবে। নিয়মিত বর্জ্য অপসারণ, পর্যাপ্ত ডাস্টবিন স্থাপন এবং বর্জ্য প্রক্রিয়াকরণের আধুনিক ও বিজ্ঞানসম্মত পদ্ধতির প্রয়োগ করার ব্যবস্থা করতে হবে। এ ব্যাপারে শহরবাসীকেও সচেতন হতে হবে, যত্রতত্র আবর্জনা ফেলা বন্ধ করতে হবে এবং বর্জ্য ব্যবস্থাপনার নিয়মাবলী মেনে চলতে হবে।

এ ছাড়া দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার অংশ হিসাবে প্রচুর বনায়ন করতে হবে, গাছ লাগানো ও ছাদবাগান সম্প্রসারণ করতে হবে, কারণ গাছ বায়ুদূষণ প্রতিরোধে জোরালো ভূমিকা রাখে। জলাশয় বৃদ্ধির জন্য যথোপযুক্ত ব্যবস্থা করতে হবে। ব্যক্তিগত সতর্কতার কোনো বিকল্প নাই। নিজেদের ঘরবাড়ি প্রতিদিন ভালোভাবে ধুয়ে-মুছে রাখতে হবে যাতে ধুলা না জমে। আর বাইরে বের হলে মাস্ক ব্যবহার করতে হবে।

শুধু সরকার নয়, জনগণকেও সচেতন হতে হবে। মনে রাখতে হবে, আমাদের সুন্দরভাবে বেঁচে থাকার জন্য প্রয়োজন দূষণমুক্ত পরিবেশ ও নির্মল বাতাস।

লেখক : ইমেরিটাস অধ্যাপক

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম