বিশ্ব প্যালিয়েটিভ কেয়ার ও হসপিস দিবস
প্রকাশ: ১২ অক্টোবর ২০২৫, ১০:১২ এএম
ডা. আরমান রেজা চৌধুরী
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
প্রতি বছর অক্টোবর মাসের দ্বিতীয় শনিবার পালিত হয় বিশ্ব প্যালিয়েটিভ কেয়ার ও হসপিস দিবস (World Hospice and Palliative Care Day)। এই দিবসের মূল লক্ষ্য হলো বিশ্বব্যাপী এমন সেবার পক্ষে কথা বলা যা জীবনসীমিত বা জটিল অসুস্থতায় আক্রান্ত মানুষদের জন্য সহানুভূতিশীল, মর্যাদাপূর্ণ ও সহজলভ্য যত্ন নিশ্চিত করে।
এটি মনে করিয়ে দেয়— প্যালিয়েটিভ ও হসপিস কেয়ার কোনো বিলাসিতা নয়, এটি মানবিক স্বাস্থ্যসেবার অপরিহার্য অংশ, যা বয়স, স্থান বা অর্থনৈতিক অবস্থার পার্থক্য ছাড়াই সবার নাগালে থাকা উচিত।
দুর্ভাগ্যবশত, এখনো বিশ্বের কোটি কোটি মানুষ প্রয়োজনীয় ব্যথা উপশম, মানসিক সহায়তা ও জীবনের শেষ পর্যায়ের যত্ন থেকে বঞ্চিত।
অনেকেই “প্যালিয়েটিভ কেয়ার” ও “হসপিস কেয়ার” শব্দ দুটি একই অর্থে ব্যবহার করেন, যদিও এদের প্রয়োগের সময় ও উদ্দেশ্যে কিছু পার্থক্য রয়েছে।
তবে উভয়ের লক্ষ্য এক— রোগীর জীবনমান উন্নত করা এবং কষ্ট লাঘব করা।
প্যালিয়েটিভ কেয়ার: প্যালিয়েটিভ কেয়ার হলো এমন এক বিশেষায়িত চিকিৎসা ও সহায়তা, যা ক্যান্সার, হৃদরোগ, কিডনি বিকল বা যেকোনো দীর্ঘস্থায়ী রোগের যেকোনো পর্যায়ে দেওয়া যেতে পারে।
এর মূল উদ্দেশ্য হলো—
ব্যথা, বমি, শ্বাসকষ্টসহ উপসর্গ নিয়ন্ত্রণ
মানসিক ও সামাজিক চাপ লাঘব
রোগী ও পরিবারের জন্য পরামর্শ ও সহায়তা
এই সেবা রোগীর স্বস্তি বজায় রাখে, এবং চিকিৎসার পাশাপাশি পরিবারকেও এই চিকিৎসা সেবার সহযাত্রী করে তোলে।
হসপিস কেয়ার: হসপিস কেয়ার সাধারণত তখন শুরু হয়, যখন রোগ নিরাময়ের সব প্রচেষ্টা শেষ হয়ে যায় এবং চিকিৎসার লক্ষ্য হয়ে ওঠে আরাম ও মানসিক প্রশান্তি।
হসপিস কেয়ার রোগীকে জীবনের শেষ সময়টুকু শান্তি, ভালোবাসা ও মর্যাদার সাথে কাটাতে সহায়তা করে।
এই সেবায় শারীরিক ব্যথা নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি মানসিক ও আধ্যাত্মিক সহায়তাও দেওয়া হয়— যাতে রোগী ও পরিবার জীবনের শেষ অধ্যায়টি শান্তভাবে গ্রহণ করতে পারে।
প্যালিয়েটিভ ও হসপিস কেয়ার মিলে গড়ে তোলে এমন এক সহানুভূতিশীল স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থা, যা শুধু শরীর নয়, মন ও আত্মাকেও স্পর্শ করে।
২০০৫ সালে “Worldwide Hospice Palliative Care Alliance (WHPCA)” প্রথম এই দিনটি উদযাপন শুরু করে।
এর উদ্দেশ্য ছিল— স্বাস্থ্যকর্মী, নীতিনির্ধারক, রোগী, পরিবার ও সমাজকে একত্রিত করে প্যালিয়েটিভ কেয়ারের গুরুত্ব সম্পর্কে সচেতন করা এবং বিশ্বব্যাপী সহজলভ্যতা বাড়ানো।
প্রতি বছর অক্টোবরের দ্বিতীয় শনিবার এই দিনটি উদযাপিত হয়, যাতে সারাবিশ্ব একই সময়ে একই বার্তা ছড়িয়ে দিতে পারে।
বছরের পর বছর এটি একটি বৈশ্বিক আন্দোলনে রূপ নিয়েছে— হাসপাতাল, বিশ্ববিদ্যালয়, কমিউনিটি ও অনলাইন প্ল্যাটফর্মে নানা আয়োজনের মাধ্যমে মানুষকে যুক্ত করছে।
দিবসটির মূল উদ্দেশ্য হলো—
• প্যালিয়েটিভ কেয়ারকে জাতীয় স্বাস্থ্যনীতির অংশ করা
• জীবনসীমিত রোগীদের জন্য ব্যথানাশক ও মানসিক সহায়তার নিশ্চয়তা
• চিকিৎসক, নার্স ও স্বেচ্ছাসেবীদের অবদানকে সম্মান জানানো
• মৃত্যু ও জীবনের শেষ সময় নিয়ে খোলামেলা আলোচনা উৎসাহিত করা
২০২৫ সালের প্রতিপাদ্য: “Achieving the Promise of Universal Access to Palliative Care” অর্থাৎ— “সবার জন্য প্যালিয়েটিভ কেয়ার নিশ্চিত করার অঙ্গীকার”
এই প্রতিপাদ্য বিশ্বজুড়ে একটি যৌথ বার্তা দেয়—
গুণগতমানসম্পন্ন প্যালিয়েটিভ কেয়ার কেবল কিছু মানুষের জন্য নয়, বরং সবার অধিকার।
এটি বাস্তবায়নের জন্য প্রয়োজন—
১. সরকার ও স্বাস্থ্যব্যবস্থায় নীতিগত অন্তর্ভুক্তি,
২. চিকিৎসা কর্মীদের প্রশিক্ষণ,
৩. ব্যথানাশক ও ওষুধের সহজলভ্যতা, এবং
৪. জনগণের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি।
এভাবে প্যালিয়েটিভ কেয়ারকে সার্বজনীন স্বাস্থ্যসেবার অংশ করা সম্ভব, যা একে মানবিকতার এক প্রতীক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করবে।
ক্যান্সার চিকিৎসায় প্যালিয়েটিভ কেয়ারের ভূমিকা: ক্যান্সার কেবল শরীরের রোগ নয়— এটি রোগী ও পরিবারের মানসিক, সামাজিক এবং আবেগীয় জীবনে গভীর প্রভাব ফেলে।
চিকিৎসা যখন রোগ নিয়ন্ত্রণে মনোযোগ দেয়, তখন প্যালিয়েটিভ কেয়ার মনোযোগ দেয় জীবনের মান উন্নয়নে।
প্যালিয়েটিভ কেয়ার ক্যান্সার চিকিৎসায়—
১। ব্যথা, বমি, ক্লান্তি ইত্যাদি উপসর্গ নিয়ন্ত্রণে সহায়তা করে,
২। ভয়, উদ্বেগ, হতাশা কমাতে মানসিক সহায়তা দেয়,
৩। পরিবারের সদস্যদের কাউন্সেলিং ও পরামর্শ দেয়,এবং
৪। চিকিৎসার ফলাফল ও রোগীর আত্মবিশ্বাস বাড়ায়।
এটি রোগকে নয়, মানুষকে কেন্দ্র করে চিকিৎসা দেয়— যাতে রোগী আরাম ও আশায় বাঁচতে পারেন।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) পরামর্শ দিয়েছে যে, প্যালিয়েটিভ কেয়ার রোগ নির্ণয়ের মুহূর্ত থেকেই শুরু হওয়া উচিত।
প্রাথমিক পর্যায়ে এই সেবা শুরু করলে—
• রোগীর হাসপাতালে ভর্তি ও জটিলতা কমে,
• মানসিক সুস্থতা বজায় থাকে,
• চিকিৎসার ধারাবাহিকতা ভালো হয়,
• এবং পরিবার ভবিষ্যতের জন্য প্রস্তুত থাকে।
এটি “শেষ পর্যায়ের যত্ন” নয়, বরং “পুরো যাত্রার সহযাত্রীতা”— যা রোগী ও পরিবারের উভয়ের মানসিক শক্তি বাড়ায়।
বিশ্ব প্যালিয়েটিভ কেয়ার ও হসপিস দিবস আমাদের মনে করিয়ে দেয়— মানবজীবনের প্রতিটি মুহূর্ত মূল্যবান। রোগ বা মৃত্যুর মুখোমুখি হয়েও মানুষ ভালোবাসা, আরাম ও মর্যাদার সাথে বাঁচার অধিকার রাখে।
২০২৫ সালের প্রতিপাদ্য “Achieving the Promise of Universal Access to Palliative Care” হোক আমাদের অঙ্গীকার -
“কেউ যেন কষ্টে না থাকে, কেউ যেন একা না থাকে।”
এটাই হোক আমাদের মানবিক পৃথিবী গড়ার প্রতিশ্রুতি— সহানুভূতি, যত্ন ও সম্মানের মাধ্যমে জীবনের শেষ অধ্যায়কেও আলোকিত করা।
লেখা: ডা. আরমান রেজা চৌধুরী
সিনিয়র কনসালট্যান্ট, রেডিয়েশন অনকোলজি, এভারকেয়ার হাসপাতাল, ঢাকা

