বাংলাদেশে নতুন মহামারি শব্দ দূষণ!
ডা. শাহনেওয়াজ পারভেজ
প্রকাশ: ০৭ মার্চ ২০২০, ০৯:১২ এএম
সারা বিশ্বে ৫ ভাগ মানুষ শব্দ দূষণের শিকার। ছবি: ইকোনমিক টাইমস
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
সকালে এলার্ম শুনে ঘুম ভাঙা থেকে শুরু। তারপর সারাটা দিন ধরে অজস্র শব্দের মাঝে বাস। কখন সেই শব্দ দূষণে পরিণত হয় আমরা জানিও না। নগরায়নের নতুন মহামারি- শব্দ দূষণ।
স্বাভাবিক বা সহনীয় শব্দের মাত্রা ৫৫ থেকে ৬০ ডেসিবেল।
বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার মতে, ৬০ ডেসিবেলের অধিক শব্দ যদি দীর্ঘসময় ধরে থাকে তাহলে সাময়িক বধিরতা আর ১০০ ডেসিবেলের বেশি হলে স্থায়ী বধিরতা (Permament Deafness) হতে পারে।
সারা বিশ্বে ৫ ভাগ মানুষ শব্দ দূষণের শিকার। ‘শব্দ দূষণ (নিয়ন্ত্রণ) বিধিমালা ২০০৬’ হল একমাত্র আইনি হাতিয়ার, যা অনেক পুরনো এবং এতে অনেক আইনের ফাঁকফোকরও আছে। তবুও এটাই একমাত্র লিগ্যাল ইন্সট্রুমেন্ট।
এই বিধিমালা অনুযায়ী নীরব এলাকা, আবাসিক এলাকা, মিশ্র এলাকা, বাণিজ্যিক এলাকা, শিল্প এলাকা এরকম জায়গার ক্যাটাগরি অনুযায়ী দিন ও রাতের জন্য আলাদা আলাদাভাবে শব্দের ‘মানমাত্রা’ বা স্ট্যান্ডার্ড লেভেল নির্ধারণ করা আছে। তাতে দিনের বেলায় সবচেয়ে কম নীরব এলাকায় ৫০ ডেসিবেল আর সবচেয়ে বেশি শিল্প এলাকায় ৭৫ ডেসিবেল মাত্রার শব্দ অনুমোদনযোগ্য। অথচ ঢাকার ফার্মগেট এলাকায় রেকর্ডকৃত দেশের সর্বোচ্চ শব্দমাত্রা ১৩২.০২ ডেসিবেল!
এই বিধিমালা অনুযায়ী, প্রথমবার শব্দদূষণের অভিযোগে অভিযুক্ত হলে সর্বোচ্চ শাস্তি এক বছর জেল অথবা ৫০০০ টাকা জরিমানা অথবা উভয় দণ্ড, আর দ্বিতীয়বার করলে ১০ হাজার টাকা জরিমানা অথবা ৬ মাসের জেল অথবা উভয় দণ্ড।
বিদ্যমান এই আইনের ব্যাপারে সচেতন গড়ে ৫০ ভাগ মানুষ। আর আইনের প্রয়োগের ক্ষেত্রে এগিয়ে আছে খুলনা (প্রয়োগ হার ২৫.২০%) ও পিছিয়ে আছে ঢাকা (প্রয়োগহার ৩.৬%)। এছাড়া আরো যে সকল আইন, বিধি, ধারা শব্দদূষণকে রোধ করতে পারে সেগুলো হলো- ‘আমদানী নীতি আদেশ ২০১৫-২০১৮, বাঙ্গালদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ আইন ১৯৯৫, স্থানীয় সরকার (সিটি কর্পোরেশন) আইন ২০০৯, মোটরযান আইন ১৯৮৮, সড়ক পরিবহন আইন ২০১৮, ইমারত নির্মান বিধিমালা ২০০৮ ইত্যাদি।
২০১৭ সালে পরিবেশ অধিদফতর একটি জরিপ চালায়, ‘বিভাগীয় শহরের শব্দের মাত্রা পরিমাপ বিষয়ক জরিপ’। তাতে দেখা যায়, স্বাভাবিকভাবেই ঢাকায় শব্দদূষণের মাত্রা সবচেয়ে বেশি, সবচেয়ে কম রাজশাহীতে।
আরেকটি জরিপে দেখা যায়, ঢাকার শ্যামলী এলাকায় ১০ মিনিট সময়ের মধ্যে শব্দ দূষণ হয় ৬০০ বার, যা কিনা ময়মনসিংহের ব্রিজ মোড় এলাকায় প্রায় ১০০০ বার।
নানাবিধ কারণে শব্দ দূষণ ঘটে। মোটর গাড়ি ও এর হর্ণ শহর এলাকায় শব্দদূষণের প্রধান কারণ। অনেক সময় গাড়ি চালকরা অনর্থক হর্ণ বাজান।
দুঃখজনকভাবে এই প্রবণতা বেশি দেখা যায় সরকারি যানবাহনগুলোর ভেতরে এবং ভিআইপি গাড়িবহরগুলোতে। ইদানিং এমনকি ব্যক্তিগত গাড়িতেও উচ্চস্বরে ইমার্জেন্সি সাইরেন বাজিয়ে চলার প্রবণতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে যা কিনা খুবই দুঃখজনক।
দেখা গেছে যে, শহরের অনেক স্থানে ১০ মিনিটের ভেতরে ১০০০ বার পর্যন্ত হর্ণ বাজানো হয়। তাছাড়া বিয়ে, অনুষ্ঠান, উৎসব, মিলাদ মাহফিল, রাজনৈতিক সভা, পার্টি, কনসার্ট, ইমারত নির্মাণ, আবাসিক এলাকায় ফ্যাক্টরি ইত্যাদি নানান কারণে শব্দ দূষণ ঘটে।
সবচেয়ে পরিতাপের বিষয় হলো, শব্দ দূষণকে একটা সমস্যা বলেই কেউ মনে করে না, সবাই এটাকে একটা স্বাভাবিক ঘটনা হিসেবে ধরে নিয়েছে।
শব্দদূষণে যত স্বাস্থ্য ঝুঁকি
শব্দদূষণের স্বাস্থ্য ঝুঁকির তালিকা নেহাত ছোট নয়। যেমন- কানে কম শোনা, বধিরতা, হৃৎকম্প, হৃদরোগ, শিশুদের লেখাপড়ায় মনোযোগ কমে যাওয়া, মানসিক বিকাশ বিঘ্নিত হওয়া, খিটখিটে মেজাজ, পেটের আলসার, অনিদ্রা বা ইনসমনিয়া, মানসিক উত্তেজনা ও উদ্বিগ্নতা বা অ্যাংজাইটি, স্ট্রোক ইত্যাদি।
কর্মজীবীদের ভেতরে কাজের দক্ষতা, মনোযোগ কমে যাওয়া ও সহজেই মেজাজ হারিয়ে ফেলার প্রবণতা দেখা যায়।
আমেরিকান হার্ট এসোসিয়েশনের মতে শব্দের মাত্রা প্রতি ১০ ডেসিবেল বৃদ্ধি পেলে যেকোন বয়সে স্ট্রোকের ঝুঁকি ১৪ ভাগ করে বাড়তে থাকে। আর যদি তা হয় ৬৫ বছরের বেশি বয়সে তাহলে প্রতি ১০ ডেসিবেল বাড়লে স্ট্রোকের ঝুঁকি ২৭ ভাগ করে বাড়তে থাকে!
শব্দদূষণ এমনকি মায়ের গর্ভের শিশুর শারীরিক ও মানসিক বৃদ্ধিকেও প্রভাবিত করে।
শব্দ দূষণ রোধে করণীয় কী?
আরেকটি জরিপে দেখা যায় যে, কোথাও শব্দ দূষণ হলে শতকরা ৫৯ জন কেবলমাত্র বন্ধ করার অনুরোধ জানান, ১৮ জন পুলিশে ও ১৪ জন কর্তৃপক্ষের কাছে অভিযোগ করেন, ৫ জন ঝগড়া বাধিয়ে দেন আর ৪ জন কিছুই করেন না। অর্থাৎ, দেখা যায় যে, যথাযথ কর্তৃপক্ষ ও আইনপ্রয়োগকারী সংস্থা ছাড়া আসলে শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণ করা খুবই দুরূহ।
প্রথমত জনসচেতনতা সৃষ্টির কোনও বিকল্প নেই। এরপর আইনের যথাযথ প্রয়োগের পাশাপাশি নীতিনির্ধারকদেরও অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে হবে। নাহলে খুব বেশি দেরি নেই, যখন আমরা দেশ ভর্তি প্রতিবন্ধী ও বিকলাঙ্গ মানুষ দেখতে পাবো।
[তথ্যসূত্র: পরিবেশ অধিদপ্তরের পরিচালিত জরিপ, বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার ওয়েবসাইট, বিভিন্ন জাতীয় দৈনিক, আন্তর্জাতিক জার্নাল ইত্যাদি।]
লেখক: ডা. শাহনেওয়াজ পারভেজ, এনসিডি কন্ট্রোল প্রোগ্রাম, স্বাস্থ্য অধিদফতর
