Logo
Logo
×

ডাক্তার আছেন

আঘাত ছাড়াই হাত-পায়ে হঠাৎ ব্যথা: হতে পারে অ্যাকিউট লিম্ব ইশকেমিয়া

Icon

যুগান্তর প্রতিবেদন

প্রকাশ: ০৭ জুলাই ২০২১, ০৭:২৬ পিএম

আঘাত ছাড়াই হাত-পায়ে হঠাৎ ব্যথা: হতে পারে অ্যাকিউট লিম্ব ইশকেমিয়া

ছোটবেলায় রিউম্যাটিক ফিভার বা বাতজ্বর হয়েছিল মাগুরার মেয়ে বিথীর। বাতজ্বর থেকে হার্টের ভাল্ব নষ্ট হতে পারে- এ কথা জানার আগেই ওর হার্টের গুরুত্বপূর্ণ একটা ভাল্ব নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। হার্টের নষ্ট ভাল্ব নিয়েই বিথীর বিয়ে হয়েছে, বাচ্চা-কাচ্চাও হয়েছে।

ভারি কাজকর্ম করতে হাঁপিয়ে যায়, বুক ধরফর করে। কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে আবার কাজ করে। গরিবের সংসার- উপায় কী? হার্টের ডাক্তারের কাছে দু-একবার গিয়েছে।

ডাক্তার বলেছে, ঢাকায় গিয়ে ভাল্বের উন্নত চিকিৎসা করাতে। যাচ্ছি যাবো করে যাওয়া হচ্ছে না। পয়সা-কড়িরও সমস্যা। একদিন রাতে ঘুমের মধ্যে হঠাৎ ডান পায়ের তীব্র ব্যথায় ককিয়ে উঠলো বিথী। আমার পা গেলো রে, পা গেলো রে- বলে চিৎকার করে পাড়া মাথায় করে তুললো। বিথীর বর কুদ্দুস জেগে উঠে দেখেন, তীব্র ব্যথায় ছটফট করছে তার বউ। ডান পায়ে হাত দিয়ে দেখেন খুব ঠাণ্ডা।

কী হলো- কিছু না বুঝেই পায়ে তেল মালিশ শুরু করলো সবাই। ঠাণ্ড দেখে কেউ কেউ গরম সেক দেওয়ার প্রস্তাব দিল। সেক একটু দেওয়াও হলো। সেই রাতেই ডেকে আনা হলো পল্লী চিকিৎসক বাবলুকে। বাবলু চোখ কচলাতে কচলাতে ডাইক্লোফেন ইনজেকশন পুশ করলো। সঙ্গে ঘুমের ওষুধ সেডিল। ব্যথার আরাম কতটুকু হলো- বুঝা গেল না, তবে ঘুমের ওষুধের কারণে একটু ঝিম মেরে গেল বিথী। সবাই আবারও ঘুমাতে গেলেন।

সকালে দেখা গেল, বিথী পায়ে ভর দিয়ে দাঁড়াতে পারছে না। পা বরফের মতো ঠাণ্ড আর অবশ। আঙুলগুলো নীল। বিপদ আন্দাজ করে শালিখার উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে যাওয়া হলো বিথীকে। সেখানে ব্যথার ওষুধ দিয়ে রোগীকে মাগুরা সদর হাসপাতালে রেফার করলেন ডাক্তার। সদর থেকে রেফার্ড হয়ে ঢাকার জাতীয় হৃদরোগ হাসপাতালে যখন পৌঁছল, বিথীর পায়ের আঙুলগুলো তখন কালো। পা নাড়ানোর শক্তি নেই, এমনকি চিমটি কাটলেও টের পায় না।

পায়ের রক্তনালির পরীক্ষা করে দেখা গেল, হাঁটুর পেছনের পপলিটিয়াল ধমনি জমাট রক্ত দিয়ে বন্ধ। রোগের নাম ‘অ্যাকিউট লিম্ব ইশকেমিয়া’। জমাট রক্তের উৎস খোঁজ করতে হার্টের ইকো পরীক্ষা করানো হলো। ইকোতে হার্টের বাম দিকের একটা প্রকোষ্ঠের ভেতরে জমাট রক্তের চাকা পাওয়া গেল। এদিকে পায়ের মাংসপেশি পরীক্ষা করে দেখা গেল, হাঁটুর নিচের মাংসগুলো মৃত। ডাক্তাররা জানালেন, এ পা রাখা সম্ভব না। পা কাটার জন্য বিথীকে পাঠানো হলো পাশের পঙ্গু হাসপাতালে। তিন দিনের মধ্যে পঙ্গুত্ব বরণ করল ২৫ বছর বয়সের একটা মেয়ে।

অ্যাকিউট লিম্ব ইশকেমিয়া (Acute Limb Ischemia) কী?
চিকিৎসা বিজ্ঞানের ভাষারীতিতে ‘অ্যাকিউট’ ও ’ক্রনিক- দুটো বহুল প্রচলিত শব্দ। অ্যাকিউট মানে- সহসা বা স্বল্প মেয়াদ আর ক্রনিক মানে- দীর্ঘ মেয়াদের ব্যাপার। লিম্ব ইশকেমিয়া বা হাত-পায়ের ধমনিতে রক্ত চলাচলে বিঘ্নসংক্রান্ত সমস্যার ক্ষেত্রেও এ রকম দুটো সময় সম্পর্কিত বিষয় রয়েছে। অ্যাকিউট লিম্ব ইশকিমিয়া এমন একটা পরিস্থিতি, যেখানে ধমনিতে ব্লকের ঘটনা ঘটে সহসা এবং এর বহিঃপ্রকাশও একেবারে নাটকীয়। অন্যদিকে ক্রনিক লিম্ব ইশকেমিয়াতে এ ঘটনা দীর্ঘমেয়াদে ঘটে ও এর লক্ষণগুলো একটু একটু করে ধাপে ধাপে প্রকাশিত হয়।

অ্যাকিউট লিম্ব ইশকেমিয়ার কারণ
আঘাতের কারণে রক্তনালি ছিঁড়ে-কেটে বা থেঁতলে বন্ধ হয়ে যাওয়ার ঘটনাগুলো বাদ দিলে অ্যাকিউট লিম্ব ইশকেমিয়ার কারণগুলো মোটামুটি নিম্নরূপ-

হার্ট বা হৃৎপিণ্ড
আমরা সবাই জানি, রক্ত তরল অবস্থায় রক্তনালির ভেতর দিয়ে শরীরের বিভিন্ন অংশে সঞ্চালিত হয়। রক্তনালি বা হৃৎপিণ্ডের ভেতরে রক্ত জমাট বেঁধে যাওয়াটা অস্বাভাবিক এবং বিপজ্জনক। বিভিন্ন কারণে হৃৎপিণ্ডের প্রকোষ্ঠের মধ্যে রক্ত জমাট বেঁধে যেতে পারে। জমাট বাঁধা রক্তের এই টুকরো রক্তস্রোতের সঙ্গে প্রবাহিত হয়ে মুহূর্তের মধ্যে শরীরের যে কোনো জায়গায় গিয়ে পৌঁছাতে পারে এবং সেখানকার রক্ত সরবরাহে বিঘ্ন ঘটাতে পারে।

মস্তিষ্কে এ ধরনের ঘটনা ঘটলে তাকে স্ট্রোক (Stroke) বলা হয়। হাত বা পায়ের ধমনি বন্ধ হলে ঘটনাটি পরিচিত হয় অ্যাকিউট লিম্ব ইশকেমিয়া নামে। হৃৎপিণ্ডের ভেতরে রক্ত জমাট বেঁধে যাওয়ার অনেক কারণ আছে; আমাদের দেশের পরিপ্রেক্ষিতে নিচের কারণগুলো গুরুত্বপূর্ণ্।

১. হৃৎপিণ্ডের ছন্দঘটিত বিপর্যয় বিশেষত অ্যাট্রিয়াল ফিব্রিলেশন (Atrial Fibrillation)
সুস্থ হৃৎপিণ্ড স্বাভাবিক অবস্থায় একটা নিয়মিত ছন্দে সংকুচিত ও প্রসারিত হয়। তবে অনেক সময় এই ছন্দের ব্যত্যয় ঘটতে দেখা যায়। হৃৎপিণ্ডের ছন্দ সংক্রান্ত সমস্যাগুলোর অন্যতম হলো অ্যাট্রিয়াল ফিব্রিলেশন। এতে বাম অলিন্দ (Left Atrium)  নামে হৃৎপিণ্ডের একটা বিশেষ প্রকোষ্ঠ অত্যন্ত দ্রুতগতিতে ও অনিয়মিতভাবে সংকুচিত ও প্রসারিত হতে থাকে। এর ফলে এই প্রকোষ্ঠের অভ্যন্তরে রক্ত জমাট বেঁধে যাওয়ার প্রবণতা তৈরি হয়। ছন্দের এ ব্যত্যয় বিভিন্ন কারণে ঘটতে পারে।

এর মধ্যে অন্যতম হলো মাইট্রাল ভাল্ব (Mitral Valve) নামে হৃৎপিণ্ডের একটা বিশেষ কপাটিকা নষ্ট হয়ে যাওয়া। আমাদের দেশে রিউম্যাটিক ফিভার বা বাতজ্বর থেকে হৃৎপিণ্ডের মাইট্রাল ভাল্ব নষ্ট হয়ে এ রকম ঘটনা ঘটতে দেখা যায়। ভাল্বের সমস্যা ছাড়াও উচ্চ রক্তচাপ ও ইশকেমিক হার্ট ডিজিজ বা হার্টের ব্লকজনিত সমস্যায়ও হার্টের এ রকম ছন্দ সংক্রান্ত সমস্যা হতে পারে। হৃৎপিণ্ডের  বাইরে অ্যাট্রিয়াল ফিব্রিলেশনের সবচেয়ে বড় কারণ শরীরে থাইরয়েড হরমোনের আধিক্য বা হাইপারথাইরয়ডিজম (Hyperthyroidism)|

২. হৃৎপিণ্ডের কাজে কমতি
হৃৎপিণ্ডের মূল কাজ হলো রক্ত পাম্প করে রক্তনালির মাধ্যমে শরীরের বিভিন্ন অংশে ছড়িয়ে দেওয়া। বিভিন্ন কারণে হৃৎপিণ্ডের এ কাজে কমতি আসতে পারে। যেমন- মায়োকার্ডিয়াল ইনফার্কশান (Myocardial Infarction)  বা হার্ট অ্যাটাক, কার্ডিওমায়োপ্যাথি ইত্যাদি। এসব ক্ষেত্রে হৃৎপিণ্ড দক্ষতার সঙ্গে রক্ত পাম্প করতে পারে না। এর ফলে হৃৎপিণ্ডের প্রকোষ্ঠের ভেতরে রক্ত জমাট বাঁধতে পারে, যা এক সময় স্ট্রোক বা অ্যাকিউট লিম্ব ইশকেমিয়ার কারণ হয়ে ওঠে।

রক্তনালি
মাঝে মাঝে রক্তনালি বা ধমনি নিজেই অ্যাকিউট লিম্ব ইশকেমিয়ার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। হয়তো ধমনির ভেতরের দেয়ালে আগে থেকেই কোলেস্টেরলের আস্তরণ ছিল। এই আস্তরণ কোনো কারণে ভেঙে গেলে তার ওপর রক্ত জমাট বাঁধতে শুরু করে। এক পর্যায়ে এই জমাট রক্ত ধমনির রক্ত চলাচলের পুরো পথটাকেই বন্ধ করে দেয়। আর পুরো ঘটনাটা ঘটে অতি অল্প সময়ের মধ্যে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এই রোগীরা আগে থেকে ক্রনিক লিম্ব ইশকিমিয়ার লক্ষণাদি (যেমন হাঁটতে গেলে পায়ে ব্যথা) প্রকাশ করেন যদিও সেই সময় তারা তা টের পান না বা গুরুত্ব দেন না। অ্যাকিউট অন ক্রনিক লিম্ব ইশকিমিয়ার মূল দৃষ্টান্ত হলেন এসব রোগী।

কখনো ধমনির ফুলে যাওয়া অংশ বা অ্যানিউরিজম থেকে জমাট রক্ত ছুটে গিয়েও পরবর্তী অংশের ধমনি বন্ধ করে অ্যাকিউট লিম্ব ইশকেমিয়ার সৃষ্টি করতে পারে।

সারভাইকাল রিব (Cervical Rib)
হাতের অ্যাকিউট লিম্ব ইশকেমিয়ার ক্ষেত্রে সারভাইকাল রিবের কথা মাথায় না রাখলেই নয়। সারভাইকাল রিব ঘাড়ের নিচের দিকের কশেরুকা থেকে জন্ম নেওয়া একটা বাড়তি হাড় যা কখনো কখনো হাতে রক্ত সরবরাহকারী সাবক্লাভিয়ান ধমনির ওপর চাপ সৃষ্টি করতে থাকে। এ চাপের ফলে ধমনির ভেতরের দেয়াল ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

এতে করে অনেক সময় ধমনির আঘাতপ্রাপ্ত অংশ ফুলে যায় (অ্যানিউরিজম) ও এর ভেতরে রক্ত জমাট বেঁধে যায়। এই জমাট রক্ত ছুটে গিয়ে পরবর্তী অংশের ধমনি বন্ধ করে দিয়ে অ্যাকিউট লিম্ব ইশকেমিয়ার সৃষ্টি করে। রোগীরা ঠান্ডা হাত, তীব্র ব্যথা ও কালো/নীল আঙ্গুল নিয়ে চিকিৎসকের কাছে আসেন। এসব ক্ষেত্রে রক্তনালির অপারেশনের সঙ্গে সঙ্গে ঘাড়ের বাড়তি হাড় কেটে ফেলাও চিকিৎসার অংশ। সারভাইকাল রিব ছেলেদের চেয়ে মেয়েদের বেশি হয়।

রক্ত
কখনো কখনো রক্তও অ্যাকিউট লিম্ব ইশকেমিয়ার কারণ হয়ে ওঠে। রক্তের উপাদানগত সমস্যা বা কোনো কারণে সাময়িকভাবে রক্তের ঘনত্ব বৃদ্ধি পেলে (যেমন- পানি শূন্যতা) রক্ত ধমনির ভেতরেই জমাট বেঁধে যায় ও রক্ত চলাচলের পথ বন্ধ করে দেয়।

অ্যাকিউট লিম্ব ইশকেমিয়ার লক্ষণাদি
১.     হঠাৎ করে হাত বা পা ঠাণ্ডা হয়ে গিয়ে তীব্র ব্যথা শুরু হয়।
২.    হাত-পা দ্রুত ফ্যাকাসে ও নীল হয়ে যেতে শুরু করে।
৩.    হাত-পায়ে বোধশক্তি কমে যেতে থাকে।
৪.    নাড়াচাড়ার ক্ষমতা হ্রাস পেতে থাকে।
৫.    আক্রান্ত অংশে নাড়ির স্পন্দন টের পাওয়া যায় না।

কী ঘটে?
পিভিডি বা ক্রনিক লিম্ব ইশকেমিয়ার সঙ্গে অ্যাকিউট লিম্ব ইশকেমিয়ার মূল তফাৎটা হলো সময়ের। ক্রনিক লিম্ব ইশকেমিয়াতে যে ঘটনা অনেক দিন, মাস, বছর ধরে একটু একটু করে ঘটতে থাকে। অ্যাকিউট  লিম্ব ইশকেমিয়ার ক্ষেত্রে সেই ঘটনাই কয়েক মিনিট বা ঘণ্টার মধ্যে ঘটে যায়।

অর্থাৎ রক্ত চলাচল বন্ধ হয়ে যায় একেবারে হঠাৎ করে। তাই অ্যাকিউট লিম্ব ইশকেমিয়ার বহিঃপ্রকাশও অত্যন্ত নাটকীয়। ক্রনিক লিম্ব ইশকেমিয়াতে একটু একটু করে রক্ত চলাচল কমতে থাকায় শরীর বিকল্প রাস্তা বা কোলেটারাল (Collateral)  তৈরি করে নেওয়ার সময় পায়। অ্যাকিউট লিম্ব ইশকেমিয়াতে বিকল্প পথ তৈরির সময় পাওয়া যায় না বলে আক্রান্ত অংশ হঠাৎ করে প্রায় পুরোপুরি রক্ত তথা অক্সিজেন ও পুষ্টি বঞ্চিত হয়ে পড়ে। দ্রুত রক্ত সরবরাহ ফিরিয়ে আনা না গেলে এর অবশ্যম্ভাবী পরিণতি অঙ্গহানি।

করণীয়
অ্যাকিউট লিম্ব ইশকেমিয়া বুঝতে পারাটাই আসল কাজ। রোগীর লক্ষণ দেখে সমস্যার কথাটা মাথায় আসলেই রক্ষে। দেখছি, যাচ্ছি, যাব করতে থাকলে বিপদ। রোগীর দায়িত্ব সময় নষ্ট না করে নিকটস্থ হাসপাতালে বা চিকিৎসকের  কাছে যাওয়া। চিকিৎসকের দায়িত্ব রোগী নির্ণয় বা আন্দাজ করে দ্রুত রক্তনালি বিশেষজ্ঞের কাছে পাঠানো। এই পাঠানো ব্যাপারটা নিয়ে আমাদের দেশে বিরাট সমস্যা দেখা যায়। প্রথমত রোগ নির্ণয়ে অনেকে ব্যর্থ হন, আবার রোগ নির্ণয় হলেও পাঠাতে বিলম্ব হয়। পথের দূরত্ব যোগাযোগ ব্যবস্থার বেহাল দশা এক্ষেত্রে দায়ী। কারণ যাই হোক, চিকিৎসার এই বিলম্বের মূল্য অনেক বেশি। যারা অর্থের মূল্য বোঝেন, তারা অর্থ উপার্জনে সময়ের দাম বুঝাতে বলেন- ‘টাইম ইজ মানি’। রক্তনালির চিকিৎসক হিসাবে আমরা অ্যাকিউট  লিম্ব ইশকেমিয়ায় সময়ের দাম বুঝনোর জন্য বলি- ‘টাইম ইজ লিম্ব’।
সময় কম- কত কম?
ধমনি বন্ধ হয়ে যাওয়ার পরেও হাত বা পা কতক্ষণ টিকে থাকতে পারে- এই প্রশ্নের উত্তর এক কথায় দেওয়া সম্ভব নয়। ব্যাপারটা অনেক কিছুর উপর করে। কোন ধমনিটা বন্ধ হয়েছে, হাত বা পায়ের রক্ত সরবরাহে তার  ভূমিকা কতখানি, বিকল্প কোনো ধমনি আছে কিনা- এসবের উপর নির্ভর করে সময়ের দৈর্ঘ্য। তবে এক্ষেত্রে ‘গোল্ডেন আওয়ার’ (Golden Hour) বলে একটা ধারণা প্রচলিত আছে। এই সময়ের ভেতরে ব্যবস্থা নেওয়া গেলে সাধারণত স্থায়ী ক্ষতি এড়ানো সম্ভব হয়। সময়টা ৬ ঘণ্টা। পায়ের ক্ষেত্রে হাঁটুর পেছনের পপলিটিয়াল ধমনি হঠাৎ বন্ধ হয়ে যাওয়ার পরিণতি সবচেয়ে ভয়াবহ। সময়মতো ব্যবস্থা না নেওয়া গেলে এক্ষেত্রে পা নষ্ট হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা আশি শতাংশেরও বেশি।

চিকিৎসা
বন্ধ ধমনিকে চালু করাই অ্যাকিউট লিম্ব ইশকেমিয়ার সবচেয়ে কার্যকর চিকিৎসা। কয়েকটি পদ্ধতিতে বন্ধ ধমনি চালু করা যায়-
১. অপারেশন
সাধারণত জমাট রক্ত দিয়ে বন্ধ হয় বলে এম্বোলেকটমি (Embolectomy) নামের এক ধরনের অপারেশনের মাধ্যমে ধমনির ভেতর থেকে জমাট রক্ত বের করে এনে রক্ত সরবরাহ চালু করা যায়। এই কাজে ‘ফগার্টি এম্বোলেকটমি ক্যাথেটার’ (Fogarty Embolectomy Catheter) নামে সরু এক ধরনের নল ব্যবহার করা হয়।

২. থ্রম্বোলাইসিস (Thrombolysis)
এ পদ্ধতিতে অপারেশন ছাড়াই স্যালাইনের মাধ্যমে এক বিশেষ ধরনের ওষুধ প্রয়োগ করে ধমনির ভেতরের জমাট রক্ত তরলায়িত করে রক্তপ্রবাহ চালু করা হয়। থ্রম্বোলাইসিসে ব্যবহৃত ওষুধগুলো আমাদের দেশে এখনো সহজলভ্য নয়, দামও অনেক বেশি।

৩. ক্যাথেটার ডিরেক্টেড থ্রম্বোলাইসিস (Catheter Directed Thrombolysis)
এটাও এক ধরনের থ্রম্বোলাইসিস। এখানেও ওপরে বর্ণিত থ্রম্বোলাইসিসে ব্যবহৃত ওষুধই ব্যবহার করা হয়। পার্থক্য হলো এক্ষেত্রে ব্যবহার্য ওষুধকে স্যালাইনের মাধ্যমে প্রয়োগ না করে ক্যাথেটারের (সরু নল) মাধ্যমে জমাট রক্তপিণ্ডের ভেতরে সরাসরি প্রয়োগ করা হয়। এতে জমাট রক্ত দ্রুত ও অনেক ভালোভাবে তরলায়িত হয়। জমাট রক্ত পরিষ্কার করে রক্তনালি চালু করার এটিই সর্বাধুনিক পদ্ধতি। এ পদ্ধতিতে রোগীকে একাধিকবার ক্যাথল্যাবে নিয়ে এনজিওগ্রামের মাধ্যমে চিকিৎসার ফলাফল দেখতে হয়। ফলে সার্বিক চিকিৎসা ব্যয় অনেক বেড়ে যায়।

অ্যাকিউট লিম্ব ইশকেমিয়ার চিকিৎসায় আমাদের দেশে অপারেশনের চল বেশি। এর মূল কারণ তুলনামূলকভাবে কম খরচ। এদেশে থ্রম্বোলাইসিস বা ক্যাথেটার ডিরেকেটড থ্রম্বোলাইসিস জনপ্রিয় না হওয়ার মূল কারণও ওই খরচ। সরকারি হাসপাতালে এই আধুনিক চিকিৎসা পদ্ধতির ব্যবস্থা করা গেলে ভবিষ্যতে এর প্রসার সম্ভব। এক্ষেত্রে আর একটা সমস্যা রক্তক্ষরণের সম্ভাবনা। থ্রম্বোলাইসিস চিকিৎসার পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া হিসাবে শরীর থেকে বড় ধরনের রক্তক্ষরণের সম্ভাবনা শতকরা ৮ ভাগ। শতকরা ৪৩ ভাগ রোগীর ক্ষেত্রে ছোটখাটো রক্তক্ষরণের ঘটনা ঘটতে পারে। মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ হয়ে স্ট্রোক হতে পারে শতকরা

২ ভাগ রোগীর ক্ষেত্রে।
অ্যাকিউট লিম্ব ইশকেমিয়ার চিকিৎসায় রোগীকে প্রথমেই হেপারিন (Heparin) নামের এক বিশেষ ধরনের ওষুধ ইনজেকশনের মাধ্যমে প্রয়োগ করা হয়, যার কাজ রক্তকে জমাট বাঁধতে না দেওয়া। অপারেশন বা থ্রম্বোলাইসিস চিকিৎসা সম্ভব না হলে বা শুরু করতে দেরি হলে অনেক সময় শুধু এই ওষুধের মাধ্যমেই চিকিৎসা চালিয়ে যাওয়া হয়। তবে মনে রাখতে হবে, হেপারিন জমাট রক্তকে তরলায়িত করার ওষুধ নয় এবং এই ওষুধ জমাট রক্ত দিয়ে বন্ধ ধমনি চালু করতে পারে না।

দেরি যদি হয়েই যায়
বিভিন্ন কারণে আমাদের দেশের অ্যাকিউট লিম্ব ইশকেমিয়ার রোগীরা গোল্ডেন আওয়ারের মধ্যে ভাস্কুলার সার্জনের কাছে পৌঁছাতে পারেন না। এদের একটা বড় অংশ হাত বা পায়ের একটা অংশ হারিয়ে বসেন।  অ্যাকিউট লিম্ব ইশকেমিয়ায় রক্তনালির অপারেশনে যাওয়ার আগে আক্রান্ত অংশ জীবিত নাকি মৃত- তা পরীক্ষা করে নেওয়া হয়। জীবিত থাকলে বা মৃতপ্রায় অবস্থায় পাওয়া গেলেও রক্ত সরবরাহ চালুর অপারেশন করে অঙ্গ টিকিয়ে রাখার চেষ্টা করা হয়। একেবারে মৃত অঙ্গের ক্ষেত্রে সেটি নিয়ম নয়। সেক্ষেত্রে মৃত অংশ কেটে বাদ দেয়া উচিত। তা না হলে বিভিন্ন জটিলতায় রোগীর জীবনহানি পর্যন্ত হতে পারে। মৃত অঙ্গ-প্রত্যঙ্গে রক্ত সরবরাহ পুনরুদ্ধার করার সবচেয়ে বড় বিপদ সম্ভবত কিডনির ক্ষতি। এসব ক্ষেত্রে কিডনি হঠাৎ করে পুরোপুরি অকেজো হয়ে যেতে পারে।

আঘাত ছাড়া হাত-পায়ে হঠাৎ ব্যথা: হতে পারে অ্যাকিউট লিম্ব ইশকেমিয়া

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম