‘গোরখোদক’ মনু মিয়ার মৃত্যুতে আপ্লুত অভিনেতা খায়রুল
বিনোদন ডেস্ক
প্রকাশ: ২৮ জুন ২০২৫, ১২:৫৮ পিএম
ছবি: সংগৃহীত
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
৪৯ বছর ধরে বিনাপারিশ্রমিকে মানবসেবা করে গেছেন কিশোরগঞ্জের ইটনার মনু মিয়া। চার যুগেরও বেশি সময় ধরে তিনি কবর খননকাজ করে গেছেন। অত্র এলাকায় তিনি ‘গোরখোদক’ হিসেবে বেশ পরিচিতি পান। আশপাশ এলাকার মুসলিম রীতি অনুযায়ী তিনি কবর খননকাজ করে এ নজির স্থাপন করেন।। দীর্ঘ এই সময়ে প্রায় তিন হাজারের বেশি কবর খনন করেন মনু মিয়া। কিন্তু কোনো প্রকার অর্থ কিংবা উপহার তিনি কারও কাছ থেকেই নেননি। কোনো গ্রামে মৃত্যুর খবর পেলেই নিজের লাল রঙের ঘোড়ায় পৌঁছে যেতেন মনু মিয়া।
সেই ৬৭ বছরের মনু মিয়া আজ (২৮ জুন) সকাল ১০টায় মারা গেছেন (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)। তার মৃত্যুর খবর জেনে অভিনেতা খায়রুল বাসার সামাজিক মাধ্যমে একটি আবেগঘন পোস্ট দিয়েছেন।
সেই পোস্টে এ অভিনেতা লিখেছেন—মনু কাকা শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছেন। এতদিন তিনি ঢাকায় ছিলেন। তিন দিন আগে উনি বাড়ি ফিরেছেন। বলছিলেন আগের চেয়ে বেশ সুস্থ আছেন। উনার সুস্থ হয়ে বাড়ি ফেরার ইচ্ছা আল্লাহ কবুল করেছেন। সুস্থ থেকেই উনি আল্লাহর ডাকে ফিরতে চেয়েছিলেন এ দোয়াও চাইতেন-বলতেন।
তিনি বলেন, হয়তো নিজ গ্রাম, নিজের জন্মস্থান থেকেই আল্লাহ তাকে ডেকে নেবেন এই চেয়েছেন আল্লাহ। উনার মহৎ কর্মের ফলস্বরূপ আল্লাহ নিশ্চয়ই উনাকে উনার স্বপ্নের ঘোড়া উপহার দেবেন। আল্লাহ উনাকে জান্নাতবাসী করুন। সবাই মনু কাকার জন্য দোয়া করবেন। আল্লাহতায়ালা তাকে শান্তিতে রাখুন। আমিন।
এর আগে ‘গোরখাদক’ মনু মিয়ার সঙ্গে বুক মিলিয়েছিলেন ছোটপর্দার অভিনেতা খায়রুল বাসার। একবার তিনি অসুস্থ হয়ে ঢাকার একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন। এ সুযোগে দুষ্কৃতকারীরা ধারালো অস্ত্র দিয়ে তার ঘোড়াটিকে হত্যা করে। যে ঘটনাটি সামাজিক মাধ্যমে অসংখ্য মানুষের হৃদয়ে দাগ কাটে। সেই ঘটনার পর ‘গোরখোদক’ মনু মিয়ার পাশে দাঁড়ানোর ঘোষণা দিয়েছিলেন খায়রুল বাসার।
সামাজিক মাধ্যম ফেসবুকে একটি স্ট্যাটাস দিয়ে অভিনেতা বলেছিলেন, মনু মিয়াকে আমি ঘোড়া কিনে দিতে চাই। আমার কবর খোঁড়ার আগ পর্যন্ত আল্লাহ যেন তাকে সুস্থ ও নিরাপদ রাখেন। এ অভিনেতা আরও বলেন, যদি কেউ মনু মিয়ার সঙ্গে যোগাযোগ করিয়ে দিতে পারেন, তাহলে চিরকৃতজ্ঞ থাকব।
এরপরই মনু মিয়ার সঙ্গে ফোনকলে কথা বলেন খায়রুল বাসার। কথোপকথনে তিনি আশ্বস্ত করেন, খুব শিগগির হাসপাতালে তাকে দেখতে যাবেন বলে জানান অভিনেতা। পরে হাসপাতালে মনু মিয়ার সঙ্গে দেখা করেন খায়রুল বাসার। তার সঙ্গে দীর্ঘক্ষণ আলাপে একটি ঘোড়া কিনে দেওয়ার প্রস্তাব দেন তিনি। কিন্তু মনু মিয়া সেই প্রস্তাবে রাজি হননি। বরং বলেছেন— সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরলে প্রয়োজনে ৭টা ঘোড়া কিনবেন তিনি।
মনু মিয়ার সঙ্গে কথা হওয়ার পর সামাজিক মাধ্যমে একটি স্ট্যাটাস দিয়ে বিষয়টি তুলে ধরেন খায়রুল বাসার। সেখানে তিনি বলেছিলেন, মনু চাচা দোয়া ছাড়া কিছু চান না আপনাদের কাছে। উনি আপনাদের জন্য দোয়া করেন, আপনারা ভালো থাকুন, সুন্দর থাকুন।
অভিনেতা বলেন, মনু চাচা শুধু বললেন— ঘোড়ার জন্য তার কষ্ট নাই। কষ্ট নাই কারা তার ঘোড়াকে হত্যা করেছে তা নিয়েও। তার ঘোড়ার সঙ্গে যাত্রা এ পর্যন্তই রেখেছেন আল্লাহ। মনু চাচা আরও বললেন— সে মারা গেছে তো চোখে দেখি নাই, তাই কষ্ট যেটুকু হওয়ার তাও হচ্ছে না। আসলে আর কতটা অভিনয় করলে সন্তানের প্রতি মায়া আড়াল করতে পারবেন, মনু চাচা ভেবে পাচ্ছেন না!
খায়রুল বাসার বলেন, আবার জিজ্ঞেস করলাম— বাড়ি ফিরে ওকে ছাড়া শূন্য শূন্য লাগবে না? তিনি বললেন, ১০ মণ খড় আর ১০ মন কুড়া কিনেছিলেন ওর জন্য। অল্প খাইয়ে ঢাকায় এসেছিলেন চিকিৎসার জন্য। এই খড়-কুড়া ওর রিজিকে থাকল না, তার আগেই সে চলে গেল। বাড়ি ফিরে এই খড়-কুড়া দেখে কষ্ট হবে। বাড়ি ফিরে যে ঘোড়াটার জন্য কষ্ট হবে এই ভেবেই মনু চাচার চোখ ভিজে উঠল। আমি একটু থামলাম। ভাবলাম কত আর শক্ত থাকা যায়! মায়া তো মনু চাচার আছে।
অভিনেতা বলেন, মানুষের বাইক-সাইকেলের শখ থাকে। আমি যতটা বুঝলাম, উনার শখ ছিল হাতেমতাই হওয়া। মানুষের প্রয়োজনে ঘোড়ার পিঠে চড়ে মানুষের দুয়ারে পৌঁছে যাওয়া। উনি উনার সাধ্যের মধ্যে সবচেয়ে মহৎ কাজটিই করে গেছেন আজীবন। উনি সুস্থ হয়ে আবার উনার শখের কাজে ফিরতে চান দ্রুত। আপনাদের দোয়ায় নিশ্চয়ই আল্লাহ উনাকে দ্রুত সুস্থ করে তুলবেন।
খায়রুল বাসার বলেন, ‘উনি কারও কাছে ঘোড়া চান না, দোয়া চান। উনার কারও প্রতি অভিযোগ-অনুযোগ নেই। সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরলে প্রয়োজনে ৭টা ঘোড়া কিনতে পারবেন বলেছেন। যা হওয়ার হয়ে গেছে, আল্লাহ যা নির্ধারণ করতে চান তাই হবে। উনি মনে করেন সবই নসিব।
তিনি বলেন, মনু মিয়ার ঘোড়া তার জীবন দিয়ে আমাদের সঙ্গে এক নায়কের পরিচয় করিয়ে দিল। আমাদের শেখা উচিত—এই সমাজের মানবিক আদর্শ, সম্মান এবং গর্ব আমাদের মনু মিয়া।
