বিনিয়োগ সংলাপে ব্যবসায়ীদের অভিযোগ
উচ্চসুদ ও করের চাপে ব্যবসা-বাণিজ্য স্থবির
যুগান্তর প্রতিবেদন
প্রকাশ: ০৫ ডিসেম্বর ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
একদিকে ঋণের উচ্চসুদ, অপরদিকে ‘কর সন্ত্রাস’। এরপর মিলছে না গ্যাস। বিদ্যুতের চড়া মূল্য। নিয়ন্ত্রণে নেই আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ও পরিবহণ ব্যবস্থা। সবকিছু মিলে দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য স্থবির। অতীতের যে কোনো সময়ের চেয়ে খারাপ অবস্থায় স্থানীয় বিনিয়োগ। এ অবস্থায় সরকারকে কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে। বৃহস্পতিবার রাজধানীর আগারগাঁওয়ে বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিডা) সম্মেলন কক্ষে বিনিয়োগ সংলাপে দেশের ব্যবসায়ীরা এসব কথা বলেন। বিডা এই সংলাপের আয়োজন করে। এতে দেশের বিভিন্ন শিল্পখাতের অর্ধশতাধিক ব্যবসায়ী নেতা ও শিল্প উদ্যোক্তারা উপস্থিত ছিলেন।
ব্যবসায়ী নেতারা বলেন, ব্যবসায়ীদের চেয়ে আমলারা বিদেশে বেশি টাকা পাচার করেছেন। কিন্তু তারা ধরাছোঁয়ার বাইরে। বিশ্বব্যাংক ও আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) পরামর্শে দেশের পলিসি নির্ধারণের বিরোধিতা করেন তারা। অনুষ্ঠানে ব্যবসায়ীদের বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দেন জ্বালানি উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান, প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ দূত লুৎফে সিদ্দিকী, বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুর, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) চেয়ারম্যান মো. আবদুর রহমান খান ও বিডার নির্বাহী চেয়ারম্যান আশিক চৌধুরী।
জমি অধিগ্রহণের সমালোচনা করে ফাওজুল কবির খান বলেন, এভাবে অধিগ্রহণ চলতে থাকলে সামনে কবর দেওয়ার মতো জায়গাও পাওয়া যাবে না। গভর্নর বলেন, জানুয়ারি থেকে সুদের হার কমবে। স্কয়ার ফার্মার ব্যবস্থাপনা পরিচালক তপন চৌধুরী বলেন, রাজনৈতিক সরকার নানা কারণে ব্যবস্থা নেয় না। কিন্তু অন্তর্বর্তী সরকার অরাজনৈতিক। তারাও খেলাপিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারছে না। অ্যাপেক্স ফুটওয়্যারের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ নাসিম মঞ্জুর বলেন, অগ্রিম কর ও উৎসে কর হচ্ছে ‘কর সন্ত্রাস’ (ট্যাক্স টেরোরিজম)। এটা বন্ধ করতে হবে।
ব্যবসায়ীদের পক্ষ থেকে বলা হয়, ঋণের চড়া সুদের বোঝা আর বহন করা সম্ভব হচ্ছে না। সুদের হার কমাতে হবে। তা না হলে ব্যবসা সচল রাখা সম্ভব হচ্ছে না। দেশি-বিদেশিসহ চার দিকের বাধায় ব্যবসায়ীরা এখন আক্রান্ত। সামনে আগানো সম্ভবই হচ্ছে না। উলটো আগের ব্যবসাও ধরে রাখা সম্ভব হচ্ছে না। এই অবস্থায় নতুন বিনিয়োগ আসা দূরের কথা, আগের বিনিয়োগ সচল রাখতে হলেও অবিলম্বে নীতি সহায়তা বাড়াতে হবে।
অ্যাপেক্স ফুটওয়্যারের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ নাসিম মঞ্জুর বলেন, ব্যবসায়ীরা অগ্রিম আয়কর ও উৎসে করের চাপ থেকে মুক্তি চান। আমরা লাভ করি বা লোকসান করি সব অবস্থাতেই কর দিয়ে যাচ্ছি। এমনো হয়েছে যে, লোকসান করেছি বেশি, আবার করও বেশি দিয়েছি। এই অবস্থা থেকে আমরা মুক্তি চাই। তিনি বলেন, এনবিআর বিভিন্ন সংস্কার ইতোমধ্যে করেছে। তাতে বন্ড অটোমেশন হয়েছে এবং এইচএস কোডের যে ‘টেরোরিজম’ ছিল, সেখান থেকে আমরা মুক্তি পেয়েছি। এখন অগ্রিম কর ও উৎসে কর থেকে মুক্তি চাই। সৈয়দ নাসিম মঞ্জুর আরও বলেন, বাংলাদেশে শুধু ব্যবসায়ীরা বিত্তবান হয়েছেন, নাকি আমলারাও হয়েছেন, এই কথাটা বলা হয় না। যে টাকা পাচার করা হয়েছে, তার মধ্যে সবচেয়ে বেশি পাচার করেছেন আমলারা। আমরা ব্যবসায়ীরা এ দায় নিতে চাই না। ব্যবসায়ীদের মধ্যে যারা টাকা চুরি করেন, গ্যাস চুরি করেন, তাদের ধরেন। আইনের আওতায় আনেন। ওনাদের দায় যেন আমাদের ওপরে না আসে।
সুদহার নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরের উদ্দেশে নাসিম মঞ্জুর বলেন, আপনার কাছে একটা বিনীত নিবেদন, ব্যবসায়ীরা এই সুদহার আর সইতে পারছে না। এটা বহন করা আমাদের জন্য অসম্ভব হয়ে যাচ্ছে। ব্যবসার খরচ অনেক বেড়ে যাচ্ছে। এতে বিশেষ করে প্রতিদ্বন্দ্বী দুটি দেশ ভিয়েতনাম ও ভারতের সঙ্গে আমরা পারছি না। তিনি বলেন, আইএমএফ, বিশ্বব্যাংকের মতো বিদেশি অংশীদারদের কথা শুনে দেশের নীতি তৈরি করা হচ্ছে। এটি ব্যবসায়ীরা সমর্থন করে না। আপনাদের চার বিলিয়ন, পাঁচ বিলিয়ন যে অর্থ লাগবে, আমরা রফতানি থেকে এনে দেব। কিন্তু তাদের সব জায়গায় অনুসরণ করা উচিত হবে না। এছাড়া রফতানিতে ইডিএফ তহবিল পুনরায় চালু করা, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি করা, ঢাকার পরিবহণ সমস্যা সমাধান করার অনুরোধ জানান তিনি। পাশাপাশি সরকারকে এলডিসি উত্তরণ নিয়ে একটা স্পষ্ট অবস্থান জানাতে বলেন।
আলোচনায় অংশ নিয়ে স্কয়ার ফার্মাসিউটিক্যালসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) তপন চৌধুরী বলেন, বড় বড় ঋণখেলাপিরা দেশে-বিদেশে বহাল তবিয়তে আছেন। তারা বড় বড় কথাও বলছেন। সরকার এসব ঋণখেলাপিদের বিষয়ে কার্যকর কোনো ব্যবস্থা নিতে পারেনি। ঋণখেলাপিদের নিয়ে অনেক কথা বলা হয়েছে, হচ্ছে। কিন্তু খেলাপিদের বিরুদ্ধে কার্যকর কোনো পদক্ষেপ এখনো পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে না। তিনি বলেন, রাজনৈতিক সরকারের ক্ষেত্রে অনেক সময় বিভিন্ন বিষয় থাকে। কিন্তু বর্তমান সরকারের এমন কিছু নেই। ফলে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কাছে অন্তত এইটুকু প্রত্যাশা ছিল যে তারা কঠোর ব্যবস্থা নেবেন। এ সরকার দায়িত্ব থেকে যাওয়ার আগে অন্তত কিছু উদাহরণ রেখে যাক। কেউই বিচারের ঊর্ধ্বে নন, আইনের ঊর্ধ্বে নন-এটা দেখতে চাই।
তপন চৌধুরীর বক্তব্যের পর এর উত্তর দেন গভর্নর আহসান এইচ মনসুর। তিনি বলেন, ওয়ান-ইলেভেনের সময় ব্যবসায়ীদের ওপর ক্র্যাকডাউন করা হয়েছিল। এর ফল কিন্তু ভালো হয়নি। অর্থনীতি স্থবির হয়ে গিয়েছিল। সরকার মনে করছে, অর্থনীতির চাকাকে সচল রাখতে হবে। একই সঙ্গে আইনগতভাবে আগাতে হবে। এখানে ডাণ্ডা নিয়ে কিছু করার নেই।
বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আরও বলেন, মূল্যস্ফীতির হার চলতি বছরের মধ্যে ৭ শতাংশে নেমে আসবে বলে আশা করা হচ্ছে। এ হার ৭ শতাংশে নেমে এলেই সুদের হার কমানোর পদক্ষেপ নেওয়া হবে। চলতি অর্থ বছরের শেষ নাগাদ মূল্যস্ফীতি ৫ শতাংশের নিচে নামবে। অর্থাৎ জানুয়ারিতে নতুন মুদ্রানীতি ঘোষণার সময় থেকেই নীতি সুদ হার কমানো হবে। তিনি আরও বলেন, খেলাপি ঋণ আদায় ও পাচার করা টাকা ফেরানো এখন আইনি প্রক্রিয়ার মধ্যে রয়েছে। আইনের বাইরে গিয়ে কিছু করা যাবে না। ব্যবসা সচল রাখার স্বার্থে কিছু ঋণ খেলাপি প্রতিষ্ঠানকেও ঋণ দিয়ে এলসি খোলার সুযোগ দেওয়া হয়েছে।
ঋণ খেলাপিরা বহালতবিয়তে রয়েছে, টাকা পাচারকারীরা ঋণ পাচ্ছে-ব্যবসায়ীদের এমন প্রশ্নের জবাবে গভর্নর বলেন, ব্যবসা সচল রাখতে ঋণখেলাপি হলেও কিছু প্রতিষ্ঠানকে ঋণ দেওয়া হচ্ছে। কারণ ব্যক্তির কারণে সরকার কোনো প্রতিষ্ঠান বন্ধ করার পক্ষে নয়। ব্যক্তির দায়ের কারণে কোনো প্রতিষ্ঠান বন্ধ করা হবে না। গত বছরের ৫ আগস্টের পর অনেক ব্যবসায়ী দেশ ছেড়ে চলে গেছেন বা অনেকে জেল-হাজতে রয়েছেন। তাদের প্রতিষ্ঠানগুলোও সচল রাখতে ঋণ সহায়তা দেওয়া হচ্ছে। এর আওতায় বেক্সিমকো গ্রুপ, এস আলম গ্রুপসহ আরও কিছু প্রতিষ্ঠান ঋণ পাচ্ছে। এছাড়াও আরও কিছু প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে বিদেশি শেয়ার রয়েছে। তাদেরও ঋণ দিতে হচ্ছে। এখানে ডাণ্ডা দিয়ে কিছু করা যাবে না।
আইনগতভাবে ঋণ প্রদানের ক্ষেত্রে কড়াকড়ির বিষয়ে এক প্রশ্নের জবাবে গভর্নর বলেন, আগে কোনো নিয়ম নীতি ছাড়াই ঋণ দেওয়া হয়েছে। যে কারণে এখন ব্যাংকগুলো সংকটে রয়েছে। এখন ব্যাংকই নিজেরা বাঁচতে ঋণ বিতরণের ক্ষেত্রে কড়াকড়ি করছে। তবে প্রচলিত নিয়ম নীতির আওতায়ই ব্যাংকগুলোকে ঋণ দিতে বলা হয়েছে।
ফাওজুল কবির খান বলেন, এভাবে অধিগ্রহণ চলতে থাকলে সামনে কবর দেওয়ার মতো জায়গাও পাওয়া যাবে না। এজন্য রাস্তা-রাস্তা করলে হবে না। রাস্তাটা কোথায় দরকার? আমাদের যে ন্যাশনাল হাইওয়ে, এটা ৬ লেনের জন্য করেছি। কিন্তু শীতলক্ষ্যা নদীই তো ১০০-২০০ লেনের হাইওয়ে। আপনি শীতলক্ষ্যা নদী কেন ব্যবহার করেন না? জ্বালানি উপদেষ্টা বলেন, বিদ্যুতের জন্য এখন একক কোনো কোম্পানির ওপর নির্ভর করা হবে না। এ খাতকে প্রতিযোগিতার ভিত্তিতে ছেড়ে দেওয়া হবে। যাতে বিদ্যুতের দাম কমানো সম্ভব হয়। ইতোমধ্যে এর দাম কমতে শুরু করেছে। তিনি আরও বলেন, শিল্পের জন্য গ্যাস ও বিদ্যুতের সরবরাহ নিশ্চিত করা হবে। এ জন্য সরকার নানামুখী পদক্ষেপ নিচ্ছে।
বিডার নির্বাহী চেয়ারম্যান আশিক চৌধুরী বলেন, বর্তমান নীতি কার্যকর করা গেলে দুই-তিন বছরে বিদেশি বিনিয়োগ তিন থেকে চার গুণ বাড়ানো সম্ভব। দেশি-বিদেশি বিনিয়োগকারীদের সহজে ও দ্রুত সময়ে একসঙ্গে সব সেবা নিশ্চিতে কাজ করছে সরকার। এনবিআর চেয়ারম্যান আব্দুর রহমান খান বলেন, বিনিয়োগকারীদের বিনিয়োগ যেন ঝুঁকিতে না পড়ে সে ব্যাপারে এনবিআর সচেষ্ট থাকবে। তিনি বলেন, আপনারা বিদেশি ব্যাংক থেকে ঋণ নেন। এটার খরচ কম এবং সাময়িকভাবে ভালো হবে। কিন্তু সুদ দিতে হবে এটা মনে রাখতে হবে। অর্থাৎ আসলটা তো দিতেই হবে। সুদও দিতে হবে।
