ভ্যাট বাড়ানোর সিদ্ধান্তে ক্ষোভ বাড়ছে সর্বত্র
মনে হয় না সাধারণ মানুষের কষ্ট হবে-অর্থ উপদেষ্টা * পোশাকের ওপর ভ্যাট বৃদ্ধি আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত; এতে শিল্প, ভোক্তা ও সরকার সবাই ক্ষতিগ্রস্ত হবে-সাবেক জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি, বিজিএমইএ
সাদ্দাম হোসেন ইমরান
প্রকাশ: ০৩ জানুয়ারি ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) চাপে ৬৫ পণ্য ও সেবার ভ্যাট-সম্পূরক শুল্ক বাড়ানোর সিদ্ধান্তে ক্ষোভ বাড়ছে সব মহলে। এই সিদ্ধান্তের ফলে রাজস্ব আয় বাড়ানোর পরিবর্তে উলটো রাজস্ব আয় কমতে পারে বলে মনে করছেন ব্যবসায়ীরা, একই সঙ্গে অর্থনীতিতে নতুন ঝুঁকি তৈরি করতে পারে। অবশ্য অন্তর্বর্তী সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলছেন, কর বাড়লেও জিনিসপত্রের দামে প্রভাব পড়বে না।
বৃহস্পতিবার সরকারি ক্রয়সংক্রায় মন্ত্রিসভা কমিটির বৈঠক শেষে অর্থ উপদেষ্টা সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমাদের মূল্যস্ফীতির মূল ওয়েটের ইন্ডিকেটরগুলো হলো-চাল, ডাল এগুলো। আমরা যেসব জিনিসের ওপর কর বাড়াচ্ছি, এগুলো মূল্যস্ফীতি বাড়ানোর ক্ষেত্রে খুবই কম গুরুত্বপূর্ণ।’
তিনি আরও বলেন, ‘পৃথিবীর কোনো দেশেই, এমনকি নেপাল, ভুটানেও, বাংলাদেশের মতো এত কম কর (ট্যাক্স) নেই। নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের ক্ষেত্রে আমরা সব সময় বলেছি, সেখানে আমরা প্রায় জিরো করে নিয়ে আসব।’
এই সিদ্ধান্তে সাধারণ মানুষের কষ্ট হবে কিনা-এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘মনে হয় না কষ্ট হবে।’ অবশ্য ব্যবসায়ীরা বলছেন ভিন্ন কথা। ব্যবসায়ীরা বলছেন, এই মুহূর্তে ভ্যাট হার বাড়ানো হবে আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত। এমনিতে মূল্যস্ফীতির ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতার কারণে সাধারণ মানুষের নাভিশ্বাস উঠছে। সেখানে জীবন রক্ষাকারী ওষুধ, এলপি গ্যাস, গুঁড়া দুধ, বিস্কুট, আচার, টমেটো কেচাপ/সস, জুস, টিস্যু পেপার, ফলমূল, সাবান-ডিটারজেন্ট পাউডার, মিষ্টি, চপ্পলের ওপর ভ্যাট হার বৃদ্ধি মানুষকে আরও চাপে ফেলবে। অংশীজনদের সঙ্গে আলোচনা ছাড়া এ ধরনের সিদ্ধান্ত সুফল বয়ে আনবে না।
কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) কেন্দ্রীয় কমিটির ভাইস প্রেসিডেন্ট এসএম নাজের হোসাইন যুগান্তরকে বলেন, এই মুহূর্তে ভ্যাট বাড়ানো কোনোভাবে সমর্থনযোগ্য নয়। কারণ অর্থবছরের শেষ সময় এসে এই ধরনের একটি প্রস্তাব গ্রহণযোগ্য নয়। আমরা জানি এই ভ্যাট বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয় বাজেটের সময়। যে সব পণ্যের ভ্যাট বাড়ানোর কথা হচ্ছে, সেখানে সিগারেট বাদে প্রত্যেকটি পণ্য জীবনমানের সঙ্গে অতি প্রয়োজনীয়।
সেক্ষেত্রে এগুলোর দাম বেড়ে গেলে মানুষের জীবনমানের ব্যয় বেড়ে যাবে। তখন মূল্যস্ফীতি আরও বাড়বে। এনবিআরের কর্মকর্তারা কোনো কিছু হলেই পণ্যের ভ্যাট বাড়ান। কিন্তু যারা বিপুল অঙ্কের ট্যাক্স ফাঁকি দেন, তাদের ধরলেই নতুন করে পণ্যের ভ্যাট বাড়িয়ে আইএমএফের নির্দেশনা মানতে হবে না।
ওষুধ শিল্প সমিতির সভাপতি আব্দুল মুক্তাদির বলেন, সরবরাহ পর্যায়ে ওষুধের ভ্যাট হার বৃদ্ধি এনবিআরের আইনগত ভুল সিদ্ধান্ত। হয়তো না বুঝেই তারা এ সিদ্ধান্ত নিতে যাচ্ছেন। কেননা বাংলাদেশে ভ্যাট হার ১৫ শতাংশ। এর বেশি ভ্যাট আদায়ের তো সুযোগই নেই। এ বক্তব্যের ব্যাখ্যায় তিনি বলেন, ওষুধ উৎপাদনের সময় ১৫ শতাংশ ভ্যাট দেয় কোম্পানিগুলো। ওষুধের দোকান বা কেমিস্ট শপগুলো ওষুধ বিক্রি করে ১৬ শতাংশ মুনাফা করে, যার ওপর ১৫ শতাংশ হারে (২.৪ শতাংশ) ভ্যাট আদায়যোগ্য।
যেহেতু এনবিআরের এত বিপুলসংখ্যক ওষুধের দোকানের কাছ থেকে ভ্যাট আদায়ের সক্ষমতা নেই, সেহেতু সরবরাহ পর্যায়ে ওষুধ কোম্পানিগুলো ভ্যাট আদায় করে তা সরকারের কোষাগারে জমা দিয়ে থাকে। এখন সরবরাহ পর্যায়ে ভ্যাট হার ৩ শতাংশ নির্ধারণ করা হলে প্রকৃত ভ্যাট হার দাঁড়ায় ১৮ শতাংশ এবং ৫ শতাংশ নির্ধারণ করলে প্রকৃত ভ্যাট হার দাঁড়ায় ৩১ শতাংশ। যেহেতু বাংলাদেশের ভ্যাট হার ১৫ শতাংশ, সেহেতু ওষুধ সরবরাহ পর্যায়ে ২.৪ শতাংশের বেশি ভ্যাট আরোপ কোনোভাবেই আইনত সিদ্ধান্ত হতে পারে না। তিনি আরও বলেন, সরবরাহ পর্যায়ে ওষুধের ভ্যাট বাড়ানো হলে ওষুধের দাম বাড়তে পারে।
মোবাইল অপারেটর কোম্পানি রবি আজিয়াটা লিমিটেডের চিফ করপোরেট ও রেগুলেটরি অফিসার সাহেদুল আলম বলেন, মূল্যস্ফীতির ঊর্ধ্বগতির কারণে গত ৪ মাসে ভোক্তাদের মোবাইল ব্যবহারের প্রবণতা কমেছে। যার ফলশ্রুতিতে সব অপারেটরের প্রবৃদ্ধি নেতিবাচক। এই মুহূর্তে রাজস্ব আয় বাড়াতে গিয়ে মোবাইল সেবার ওপর সম্পূরক শুল্ক বাড়ানো হলে তা হিতে বিপরীত হতে পারে। রাজস্ব বাড়ার বদলে উলটো কমে যেতে পারে।
দেশি ব্র্যান্ড টুয়েলভের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও বিজিএমইএর সাবেক জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি আব্দুল্লাহ হিল রাকিব বলেন, পোশাকের ওপর ভ্যাট বৃদ্ধি আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত। এ সিদ্ধান্তের ফলে শিল্প, ভোক্তা ও সরকার সবাই ক্ষতিগ্রস্ত হবে। কারণ ব্র্যান্ডগুলো মাত্র উঠতে শুরু করেছিল। এ খাত থেকে রাজস্ব আদায় বাড়ছিল। এই মুহূর্তে ভোক্তারাই ভ্যাটের ১৫ শতাংশ অর্থ দিতে চাইবেন না। ব্যাপারটা যেই মুরগি ডিম দেয়, সেই মুরগি জবাই করার মতো।
তিনি আরও বলেন, এ সিদ্ধান্তে পোশাক খাতে অনানুষ্ঠানিক অর্থনীতির আকার আরও বড় হবে। যারা ক্যাশ টাকায় বিক্রি করেন, তারা লাভবান হতে পারেন। কিন্তু যারা স্বচ্ছতার সঙ্গে সরকারকে ভ্যাট, ট্যাক্স দিয়ে ব্যবসা করতে চান, তাদের জন্য বুমেরাং হবে। আইএমএফের শর্ত মেনে কর-জিডিপি অনুপাত বাড়াতে অনানুষ্ঠানিক খাত আনুষ্ঠানিক অর্থনীতির মধ্যে আনা যেত, কিন্তু তার কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। তার মানে, যারা ট্যাক্স দিচ্ছেন, রাজস্ব আদায় বাড়াতে তাদের ওপরেই বোঝা চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে।
বাংলাদেশ রেস্তোরাঁ মালিক সমিতির মহাসচিব ইমরান হাসান বলেন, হোটেল-রেস্তোরাঁ শিল্পের ওপর ভ্যাট হার বাড়ানোয় তা শিল্পের ওপর ভয়ংকর প্রভাব ফেলবে। ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র হোটেল-রেস্তোরাঁকে ধ্বংস করে দিয়ে এই শিল্প করপোরেটদের হাতে তুলে দেওয়ার অপতৎপরতার অংশ এটি। অংশীজনদের সঙ্গে কোনো আলাপ-আলোচনা ছাড়া এ সিদ্ধান্ত নেওয়ার তীব্র প্রতিবাদ জানাচ্ছি। ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ সরকার ও অন্তর্বর্তী সরকারের মধ্যে পার্থক্য খুঁজে পাচ্ছি না। উভয়েই সিদ্ধান্ত জোর করে চাপিয়ে দিয়েছে ও দিচ্ছে। এক দল বিদেশ থেকে ঋণ নিয়ে টাকা লুট করেছে। আরেক দল আইএমএফের এজেন্ডা বাস্তবায়নে উঠেপড়ে লেগেছে।
তিনি আরও বলেন, আজ (বৃহস্পতিবার) রাতে রাজধানীর সব রেস্তোরাঁ মালিকদের বৈঠকে বসার কথা রয়েছে। এই বৈঠক থেকে কঠোর সিদ্ধান্ত আসতে পারে, যা পরে কর্মসূচি আকারে ঘোষণা দেওয়া হবে।
