ক্ষমতার অপব্যবহারের শাস্তি
আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় এক ঐতিহাসিক রায়
সম্পাদকীয়
প্রকাশ: ২৯ নভেম্বর ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
ফাইল ছবি
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ তার পরিবারের সদস্য এবং উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে পূর্বাচল নতুন শহর প্রকল্পে প্লট বরাদ্দে জালিয়াতির তিন মামলায় আদালতের দেওয়া সাম্প্রতিক রায়টি কেবল একটি আইনি সিদ্ধান্ত নয়, এটি রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার অপব্যবহারের বিরুদ্ধে আইনের শাসনের এক ঐতিহাসিক প্রত্যয়ন। এই রায় প্রমাণ করে, কেউই আইনের ঊর্ধ্বে নন এবং দুর্নীতির বিরুদ্ধে রাষ্ট্রের অবস্থান অত্যন্ত কঠোর।
এটা স্পষ্ট যে, সাবেক প্রধানমন্ত্রী রাষ্ট্রের নির্বাহী চেয়ারে বসে আইন ও বিধি ভঙ্গ করে জালিয়াতি-প্রতারণার মাধ্যমে নিজের ও পরিবারের সদস্যদের নামে প্লট বরাদ্দ নিয়েছিলেন। রাষ্ট্রীয় সম্পদ, যা জনগণের কল্যাণে ব্যবহারের কথা, তা এভাবে ব্যক্তিগত বা পারিবারিক স্বার্থে ব্যবহার করা কেবল নৈতিক স্খলন নয়, এটি রাষ্ট্রীয় অপরাধ। এই রায়ে শেখ হাসিনার ২১ বছরের কারাদণ্ডের পাশাপাশি তার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয় এবং মেয়ে সায়মা ওয়াজেদ পুতুলকেও পৃথকভাবে ৫ বছর করে সাজা দেওয়া হয়েছে। একইসঙ্গে সাবেক গণপূর্ত প্রতিমন্ত্রী, জাতীয় গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের সাবেক সচিব এবং রাজউকের সাবেক চেয়ারম্যানসহ মোট ১৯ জন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তার বিভিন্ন মেয়াদে সাজা হওয়া ইঙ্গিত দেয় যে, এই দুর্নীতি একটি প্রাতিষ্ঠানিক চক্রের মাধ্যমে সংঘটিত হয়েছিল।
মামলা দায়েরের মাত্র আট মাসের মাথায় এবং বিচার শুরুর চার মাসের মধ্যে রায় ঘোষণা হওয়া বিচারিক প্রক্রিয়াটির দ্রুততা ও দক্ষতা নির্দেশ করে। উচ্চপর্যায়ের মামলাগুলো সাধারণত দীর্ঘসূত্রতার জালে আটকে থাকে; কিন্তু এ মামলার দ্রুত নিষ্পত্তি বিচার বিভাগের সক্ষমতা তুলে ধরে। এটি প্রমাণ করে, যদি সদিচ্ছা ও উপযুক্ত পরিবেশ থাকে, তাহলে দ্রুততম সময়েও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা সম্ভব। দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) অনুসন্ধান শুরু হয়েছিল যুগান্তরে প্রকাশিত একটি অনুসন্ধানী প্রতিবেদনের সূত্র ধরে, যা অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা এবং স্বাধীন গণমাধ্যমের গুরুত্বকে পুনরায় প্রতিষ্ঠিত করেছে। আদালত কর্তৃক গণমাধ্যমকে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করা এই ধারার প্রতি একটি গুরুত্বপূর্ণ স্বীকৃতি।
এই রায়টি বর্তমান ও ভবিষ্যৎ সরকারি কর্মকর্তাদের জন্য একটি কঠোর সতর্কবার্তা বহন করে। আমরা মনে করি, ক্ষমতা মানে দুর্নীতি বা ব্যক্তিস্বার্থ চরিতার্থ করার লাইসেন্স নয়, বরং ক্ষমতার অপব্যবহারের ফল যে সুদূরপ্রসারী ও অনিবার্য, তা এই রায়ের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত হলো। এখন প্রয়োজন হলো এই রায় থেকে শিক্ষা নিয়ে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে আরও শক্তিশালী করা। বিশেষ করে রাজউক বা অন্যান্য ভূমি বরাদ্দকারী সংস্থার কার্যক্রমে শতভাগ স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করতে হবে, যেন প্লট বরাদ্দের মতো জনগুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে কোনো অনিয়মের সুযোগ না থাকে।
গণতন্ত্র ও সুশাসন নিশ্চিত করতে হলে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার প্রতি সাধারণ মানুষের আস্থা ফিরিয়ে আনতে হবে। সাবেক প্রধানমন্ত্রী বা অন্য কোনো প্রভাবশালী ব্যক্তির বিরুদ্ধে আইনের এই কঠোর প্রয়োগ প্রমাণ করে যে, এ সরকারের আমলে রাষ্ট্রীয় কাঠামোতে দুর্নীতিকে প্রশ্রয় না দেওয়ার নীতি কার্যকর রয়েছে। এই ঐতিহাসিক রায়টি যেন আমাদের সমাজ থেকে দুর্নীতির শিকড় উপড়ে ফেলার দীর্ঘমেয়াদি লড়াইয়ে এক নতুন প্রেরণা জোগায়।
