তারেক রহমানের ভাবনা : বাংলাদেশের তারুণ্য
শিবলী মুহাম্মদ
প্রকাশ: ২৯ নভেম্বর ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
ছবি: সংগৃহীত
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
দীর্ঘ ষোলো বছর নানা বঞ্চনা ও প্রতিকূলতার মধ্যে কেটেছে তারেক রহমানের সময়। তিনি হারিয়েছেন ভাইকে, বঞ্চিত হয়েছেন মাতৃস্নেহ থেকে, প্রিয় স্বদেশের আলো-ছায়া থেকে। অথচ তিনি বলছেন, ‘আমি হারিয়েছি আমার অগণিত নেতাকর্মীকে, যারা রাজনৈতিক অধিকার আদায়ের জন্য রাজপথে জীবন দিয়েছেন। রাষ্ট্রীয় বাহিনীর হাতে গুম-খুনের শিকার হয়েছেন। অসংখ্য নেতাকর্মী তাদের পরিবার ছেড়ে শুধু গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের জন্য জেলখানার চার দেওয়ালে বন্দি অবস্থায় ধুঁকে ধুঁকে মরছে।’
গত মে মাসে লাখো তারুণ্যের সমাবেশে তিনি বলেন, একটি নির্দিষ্ট বয়স থেকে তরুণ প্রজন্মকে নৈতিক ও কারিগরি শিক্ষায় গড়ে তুলতে হবে। একটি সুন্দর জাতি গঠনে এ সময়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো কারিগরি জ্ঞান। এ কথাটি ধ্রুব সত্য। কিন্তু কারিগরি শিক্ষার সঙ্গে নৈতিক শিক্ষার সম্পর্ক কী? সম্পর্ক অবশ্যই আছে। বাস্তবতা হলো, মানুষের যদি নৈতিক শিক্ষা না থাকে, তাহলে তার কোনো শিক্ষাই কাজে আসে না, মুখ থুবড়ে পড়ে, যার জলজ্যান্ত উদাহরণ হলো আবরার ফাহাদের মৃত্যু। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়কে ধরা হয় দেশের সবচেয়ে মানসম্পন্ন একটি উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। অথচ সেই বিশ্ববিদ্যালয়ে আবরার ফাহাদের সহপাঠীরাই তাকে কী নির্মমভাবে পিটিয়ে হত্যা করেছে! ২০২৪ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক মুসলিম হলে তোফাজ্জেল নামের এক মানসিক বিকারগ্রস্ত যুবককে মোবাইল চুরির অভিযোগে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। তাহলে এ উচ্চশিক্ষা, এ স্বনামধন্য বিশ্ববিদ্যালয় আমাদের কী শেখাল? এ শিক্ষার মাঝে মূলত একটি শিক্ষারই অনুপস্থিতি ছিল-সেটা হলো নৈতিক শিক্ষা। তারেক রহমান তারুণ্যের বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যে সেই বিষয়টিকেই গুরুত্ব দিয়েছেন।
তিনি সবার আগে কৃষিভিত্তিক সমাজের কথা বলেছেন। কৃষকের উন্নয়নের কথা বলেছেন। কেননা তিনি খুব ভালো করেই জানেন, বাংলাদেশ কৃষিপ্রধান দেশ। কিন্তু নগরায়ণ, শিল্পকারখানা, ঘর-বাড়ি নির্মাণের মাধ্যমে আমরা দিন দিন আমাদের কৃষিজমি হারিয়ে ফেলছি। তাই দেশের অস্তিত্ব রক্ষায় কৃষিজমি ও কৃষককে সবার ঊর্ধ্বে গুরুত্ব দিতে হবে। তারেক রহমান ঘোষণা দিয়েছেন, তার দল যদি সরকার গঠনের সুযোগ পায়, তাহলে দেশের ফসলি কৃষক কিংবা ভূমিহীন কৃষকদের জন্য ফার্মার্স কার্ডের ব্যবস্থা করবেন, যে কার্ডে কৃষকের জমির দাগ নম্বর, জমির পরিমাণ উল্লেখ থাকবে। তিনি উল্লেখ করেন, আমাদের দেশে প্রায় সাড়ে তিন কোটি বর্গাচাষি ও ভূমিহীন কৃষক আছে, যারা বছরে একাধিক ফসল ফলাতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছেন। ফলে অনেক কৃষিজমিই অনাবাদি থেকে যাচ্ছে। ফার্মার্স কার্ড প্রদানের মাধ্যমে কৃষককে একটি ফলনের সম্পূর্ণ খরচ রাষ্ট্রীয়ভাবে প্রদান করা হবে। সত্যি সত্যিই এ ভাবনার বাস্তবায়ন ঘটলে বদলে যাবে দেশ।
কৃষকের পাশাপাশি তিনি দেশের প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর কথা বলেছেন, যারা সবসময় সুবিধাবঞ্চিত থাকে, কাজের সুযোগ-সুবিধা কম পায়। এরকম প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর মধ্যে পঞ্চাশ লাখ কার্ড বিতরণ করা হবে। এ কার্ডের অংশীদার হবে পরিবারের নারীপ্রধান একজন ব্যক্তি। এ কার্ড প্রদানের মাধ্যমে একটি পরিবার রাষ্ট্রীয়ভাবে বিভিন্ন খাদ্য সহায়তা কিংবা নগদ অর্থ পাবে, যার মাধ্যমে ওই পরিবারের নারীদের কর্মসংস্থান সৃষ্টি তথা নারীর ক্ষমতায়নের প্রসার ঘটবে। সমৃদ্ধশীল একটি দেশ তো তখনই গড়া সম্ভব, যখন দেশের প্রতিটি জনগোষ্ঠীর সমানভাবে দেশ গঠনে অংশীদারত্ব থাকে। এক শ্রেণি এগিয়ে গেল এবং আরেকটি শ্রেণি পিছিয়ে থাকলে সেদেশের সমৃদ্ধিতে বিঘ্ন ঘটবেই। তাই তারেক রহমান দেশ গঠনে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকেও তার ভাবনায় রেখেছেন।
তারেক রহমান তরুণদের নিয়ে যে স্বপ্নের কথা বলেছেন, তা সত্যিই সময়োপযোগী ভাবনা। তিনি বলেছেন, শিক্ষাক্ষেত্রে ভাষাকে গুরুত্ব দেওয়া হবে। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় মাত্র দুটি ভাষায় শিক্ষা প্রচলিত আছে। বাংলা ও ইংরেজি। কিন্তু তারেক রহমান অনুধাবন করছেন, এই একবিংশ শতাব্দীতে ভাষা বৈশ্বিক উন্নয়নের সঙ্গে টেক্কা দেওয়ার ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ। দেশকে এগিয়ে নিতে হলে পৃথিবীর সব দেশের সঙ্গে অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক সম্পর্ক স্থাপন করতে হবে। বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে সব রকমের প্রতিষ্ঠানে নিজেদের জনশক্তিকে নিযুক্ত করতে হবে। সেক্ষেত্রে ভাষা একটি অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায়। কেননা পৃথিবীর অনেক দেশই আছে যেখানে ইংরেজি ভাষার প্রচলন খুব একটা নেই বললেই চলে। যেমন-চীন, জাপান, জার্মানি, ফ্রান্স, মধ্যপ্রাচ্যের অনেক দেশ। এসব জায়গায় কাজ করতে গেলে তাদের ভাষায় পারদর্শী হতে হয়। তাই বিশ্বায়নের এ যুগে যারা যত বেশি ভাষার ওপর দক্ষতা অর্জন করতে পারবে, তারা তত কর্মসংস্থান তৈরি করতে সক্ষম হবে। সে জন্য তারেক রহমান তরুণদের উদ্দেশে বলেছেন, স্বনির্ভর দেশ গড়তে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় বাংলা, ইংরেজি ভাষার পাশাপাশি আরও কিছু ভাষা যুক্ত করা হবে, যাতে অন্যান্য দেশে আমাদের তরুণরা কর্মসংস্থান তৈরি করতে পারে।
তারেক রহমান খেয়াল করেছেন, তরুণ সমাজকে যদি প্রযুক্তিগত প্রশিক্ষণ দেওয়া যায় এবং যদি দক্ষ উদ্যোক্তা হিসাবে গড়ে তোলা যায়, তাহলে এ তরুণরাই আগামীতে আমাজান, আলীবাবার মতো বিশ্বখ্যাত ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে বাণিজ্যের সুযোগ পেতে পারে। তাই তিনি তরুণদের উৎসাহিত করেছেন তাদের স্বপ্নটাকে অত দূরের লক্ষ্যে নিয়ে যাওয়ার জন্য।
স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে অনেক শাসকই এ দেশের শাসনভার গ্রহণ করেছেন। তারা বিভিন্ন সময়ে বিভিন্নভাবে জনকল্যাণমুখী উদ্যোগ গ্রহণ করেছেন। কিন্তু তা শেষ পর্যন্ত সফলতার মুখ দেখেনি। কারণ সেখানে সততা ও সাহসের অনুপস্থিতি ছিল। দেশকে বদলে দিতে সত্যিকার অর্থেই নেতাকে কিংবা মানুষকে সাহসী হতে হয়। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের প্রধান অস্ত্র ছিল সাহস। পাকিস্তানি সাঁজোয়া বাহিনীর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর মতো আমাদের তেমন কোনো অস্ত্র ছিল না। শুধু বাঙালির সাহসের কারণেই সবাই জীবনবাজি রেখে যুদ্ধ করতে সক্ষম হয়েছিল। কিন্তু লাখো শহীদের রক্তে অর্জিত যে স্বাধীন মাতৃভূমি আমরা মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জন করেছি, তা পরবর্তীকালে আমরা এগিয়ে নিতে পারিনি শুধু সততার অভাবে।
তারেক রহমান বিভিন্ন কথা প্রসঙ্গে তার পোষা প্রাণী একটি বিড়ালের কথা বলেছেন। তিনি বোঝাতে চেয়েছেন একটি স্বনির্ভর দেশ গঠনে শুধু মানুষ নয়, পাশাপাশি সেই ভূ-খণ্ডের অন্যান্য প্রাণ-প্রকৃতিরও গুরুত্ব রয়েছে। এখানে বিড়াল কেবল একটি প্রাণী নয়, বিড়াল হলো অন্যান্য প্রাণী জগতের প্রতি ভালোবাসার প্রতীক। এ প্রসঙ্গে তিনি আমাদের পরিবেশ ও বনভূমির কথাও উল্লেখ করেছেন। অর্থাৎ একটি দেশ শুধু মানুষের দ্বারাই পরিচালিত হয় না, সেখানে গাছপালা, নদ-নদী অন্যান্য প্রাণ-প্রকৃতিরও বিশেষ ভূমিকা থাকে। এ সুদূরপ্রসারী চিন্তাই হয়তো হতে পারে নতুন বাংলাদেশকে সারা পৃথিবীর কাছে আরও ইতিবাচকরূপে পরিচিত করানোর প্ল্যাটফর্ম। এখান থেকেই রচিত হতে পারে নতুন কোনো ইতিহাস, যে ইতিহাসের পাতায় পাতায় একদল তরুণ বাংলাদেশের পতাকাকে সারা বিশ্বের কাছে গৌরবের সঙ্গে তুলে ধরবে।
শিবলী মুহাম্মদ : চিকিৎসক
