বন্দর চুক্তি নিয়ে গোপনীয়তা কেন
এম গোলাম মোস্তফা ভুইয়া
প্রকাশ: ২৯ নভেম্বর ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
ছবি: সংগৃহীত
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
দেশের বন্দরগুলো বাংলাদেশের অর্থনীতির লাইফ লাইন হিসাবে পরিচিত। গত কয়েক দশকে অর্থনীতির যে উত্থান ও প্রসার, তার নেপথ্যে বড় ভূমিকা রাখছে চট্টগ্রামসহ বিভিন্ন বন্দর। রাজস্ব আয়, পণ্যের অবাধ চলাচল আর সহনীয় ফি ও মাশুলের কারণে ব্যবসায়ী ও উদ্যোক্তাদের কাছে বন্দরের গুরুত্ব বাড়লেও এখন এমনভাবে তা বিদেশিদের হাতে তুলে দেওয়া হচ্ছে যে, সামনে বন্দরই হতে পারে অর্থনীতির গলার কাঁটা। গোপন চুক্তির মাধ্যমে চট্টগ্রামসহ কয়েকটি বন্দরের সাতটির মধ্যে পাঁচটি টার্মিনালই তুলে দেওয়া হচ্ছে বিদেশিদের হাতে। প্রশ্ন হলো, এ বিষয়ে বিদেশি কোম্পানির সঙ্গে সম্পাদিত চুক্তি নিয়ে গোপনীয়তা করছে কেন সরকার? নিজেদের ঘোষণা অনুযায়ী অন্তর্বর্তী সরকারের আগামী দুই-তিন মাসের বেশি ক্ষমতায় থাকার কথা নয়; তাহলে এ সরকার কী কারণে দীর্ঘমেয়াদি এমন একটি চুক্তি সম্পাদন করল, যেটা পুরো অর্থনীতি ও দেশকে প্রভাবিত করতে পারে এবং যার মধ্যে অনেক ধরনের উদ্বেগের বিষয় থাকতে পারে। সেই চুক্তি স্বাক্ষর কেন গোপনীয়তা ও অস্বচ্ছতার সঙ্গে তাড়াহুড়ো করে করা হলো? এ ধরনের চুক্তি করার এখতিয়ার কি অন্তর্বর্তী সরকারের আছে?
গত ১৭ নভেম্বর চট্টগ্রাম বন্দরের লালদিয়া কনটেইনার টার্মিনালটি ৩০ বছরের জন্য পরিচালনার দায়িত্ব পেয়েছে ডেনমার্কভিত্তিক শিপিং ও লজিস্টিকস প্রতিষ্ঠান এপি মোলার মায়ের্স্ক (এপিএম)। এছাড়া একইদিনে বুড়িগঙ্গার পাড়ে পানগাঁও অভ্যন্তরীণ কনটেইনার টার্মিনাল ২২ বছরের জন্য পরিচালনার ভার সুইজারল্যান্ডভিত্তিক প্রতিষ্ঠান মেডলগকে দিতে চুক্তি স্বাক্ষর করেছে সরকার। নিউমুরিং কনটেইনার টার্মিনাল (এনসিটি) চট্টগ্রাম বন্দরের সবচেয়ে বড় টার্মিনাল। এখানকার ৪৪ শতাংশ কনটেইনার সামলায় এনসিটি। এ টার্মিনালে একসঙ্গে চারটি সমুদ্রগামী কনটেইনার জাহাজ এবং একটি অভ্যন্তরীণ নৌপথের ছোট জাহাজ ভেড়ানো যায়। এনসিটিতে জাহাজ থেকে বার্ষিক ১০ লাখ একক কনটেইনার উঠানো-নামানোর স্বাভাবিক ক্ষমতা রয়েছে। গত বছর এ টার্মিনাল ১২ লাখ ৮১ হাজার কনটেইনার হ্যান্ডেল করেছে।
এনসিটি পরিচালনা করতে বন্দর কর্তৃপক্ষের সঙ্গে বিদেশি কোম্পানির চুক্তি সম্পর্কিত প্রক্রিয়ার বৈধতা নিয়ে শুনানি চলছে। নিষ্পত্তি হলে সরকার টার্মিনালটি সংযুক্ত আরব আমিরাতভিত্তিক ডিপি ওয়ার্ল্ডকে পরিচালনা করতে দেবে। এর আগে পর্যন্ত বিদেশি কোম্পানির সঙ্গে চুক্তি সম্পর্কিত প্রক্রিয়া চালানো যাবে না বলে আদেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট। বন্দর ব্যবস্থাপনায় বিদেশি কোম্পানিগুলোর সঙ্গে চুক্তির বিপক্ষে দেশের স্বার্থরক্ষাসহ কৌশলগত, অর্থনৈতিক এবং প্রক্রিয়াগত নানা উদ্বেগ দেখিয়ে জোর সমালোচনা চলছে নানা পক্ষ থেকে। গত ১৭ নভেম্বর সম্পাদিত চুক্তিতে বন্দর কর্তৃপক্ষ ও কাস্টমস কী পরিমাণ মাশুল, চার্জ, শুল্ক-কর ইত্যাদি পাবে, সেই বিষয়গুলো গোপন রাখা হয়েছে। এ চুক্তি নিয়ে সমালোচনার পরিপ্রেক্ষিতে সরকার বলছে, লালদিয়া ও পানগাঁও বন্দর পরিচালনায় বিদেশি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে হওয়া চুক্তিটি নন-ডিসক্লোজার এগ্রিমেন্ট (গোপন চুক্তি)। তাই এ নিয়ে খুব বেশি তথ্য প্রকাশ করা হচ্ছে না।
চট্টগ্রাম বন্দরের লালদিয়া এবং ঢাকার কেরানীগঞ্জের পানগাঁও কনটেইনার টার্মিনাল নিয়ে চুক্তির বিস্তারিত দেশবাসীর সামনে প্রকাশ করা উচিত। লালদিয়া ও পানগাঁও কনটেইনার টার্মিনালের চুক্তি প্রক্রিয়া ও সিদ্ধান্ত গ্রহণ ত্রুটিপূর্ণ ও অস্বচ্ছভাবে সম্পন্ন হওয়ার অভিযোগও রয়েছে। এ প্রক্রিয়ায় বন্দর ব্যবহারকারীদের যুক্ত করা হয়নি; তারা চুক্তির শর্ত ও বিষয় সম্পর্কে জানেন না। চট্টগ্রাম বন্দরের নিউমুরিং টার্মিনালের ক্ষেত্রেও একই ধরনের তাড়াহুড়ো ও অস্বচ্ছতা পরিলক্ষিত হচ্ছে। গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় প্রকল্পে সময় নিয়ে অংশীজনদের মতামত গ্রহণ না করলে প্রকল্পের ব্যয় ও কার্যকারিতা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। একইভাবে লালদিয়া, পানগাঁও ও নিউমুরিং টার্মিনালের দীর্ঘমেয়াদি চুক্তি জাতীয় স্বার্থের জন্য হুমকির সম্মুখীন হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। বিগত সরকারের সময় এ রকম উদ্যোগে কমিশনভোগীদের যে গোপন সংশ্লিষ্টতা থাকত, তা থেকে বাংলাদেশ মুক্তি চেয়েছিল জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের পর।
দেশবাসী চায় না অতীতের মতো এ রকম গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় সম্পদ নিয়ে গোপনে কোনো চুক্তি হোক। চট্টগ্রাম বন্দরের বিভিন্ন টার্মিনাল নিয়ে সিদ্ধান্ত হতে হবে স্বচ্ছতার সঙ্গে। বন্দরের মতো কৌশলগত সম্পদ নিয়ে চুক্তি করার আগে চুক্তির শর্ত দেশবাসীর কাছে প্রকাশ করতে হবে। তাই ১৭ নভেম্বর সম্পাদিত চুক্তি অবিলম্বে প্রকাশ করতে হবে। মনে রাখতে হবে, বিদেশি বিনিয়োগ মানেই উন্নয়ন, এ ধারণা বিভ্রান্তিকর। দেশের ৯০ শতাংশ আমদানি-রপ্তানি চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে হয়, সেখানে বিদেশি কর্তৃত্ব কৌশলগতভাবে ঝুঁকিপূর্ণ। এর দায় বর্তমান সরকারকেই বহন করতে হবে।
চট্টগ্রাম বন্দর দেশের অর্থনীতির প্রাণকেন্দ্র। আবার দেশের নিরাপত্তা ও স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বের মতো স্পর্শকাতর ইস্যুও চট্টগ্রাম বন্দরের সঙ্গে জড়িত। তাই চট্টগ্রাম বন্দরের বিষয়ে তাড়াহুড়ো করে অস্বচ্ছ ও গোপন কোনো পদক্ষেপ নেওয়ার সুযোগ নেই। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে বর্তমান সরকার তা-ই করতে চাচ্ছে। কোনো দরপত্র ছাড়াই পতিত স্বৈরাচারের আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে সম্পৃক্ত এক বিদেশি কোম্পানির কাছে নিউমুরিং কনটেইনার টার্মিনাল (এনসিটি) তুলে দেওয়ার ষড়যন্ত্র চলমান রয়েছে বলে অভিযোগ। চট্টগ্রাম বন্দর বিদেশিদের হাতে তুলে দেওয়া জাতীয় স্বার্থেরও পরিপন্থি।
বিগত স্বৈরাচারী সরকার দেশের স্বার্থ বিসর্জন দিয়ে দেশকে একটি তাঁবেদার রাষ্ট্রে পরিণত করেছিল। বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের এমন কর্মকাণ্ড অতীতকে স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে। বন্দর উন্নয়নের নামে বিদেশি কোম্পানির সঙ্গে করা গোপন এ চুক্তি আসলে জাতীয় সম্পদ বিক্রির সমতুল্য। বন্দর ইতোমধ্যেই লাভজনক ও বিশ্বমানের। অথচ বিদেশি কোম্পানির লুটপাটের অংশ হিসাবে শুল্ক ৪১ শতাংশ বাড়ানো হয়েছে, যা সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার ব্যয় আরও বাড়াবে। অন্তর্বর্তী সরকার সম্পূর্ণ এখতিয়ারবহির্ভূতভাবে লাভজনক টার্মিনালগুলোর নিয়ন্ত্রণ বিদেশি কোম্পানিকে দিতে চায়, যা দেশের জনগণের স্বার্থের পরিপন্থি।
জনগণ মনে করে, অন্তর্বর্তী সরকার বিদেশি কোম্পানির সঙ্গে দেশের স্বার্থবিরোধী চুক্তি সম্পাদনের মাধ্যমে জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের চেতনার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করছে। বন্দর দেশের অর্থনীতি, সার্বভৌমত্ব এবং ২৪ জুলাইয়ের গণ-অভ্যুত্থানের আদর্শের সঙ্গে সরাসরি জড়িত।
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হলো, একটা দীর্ঘমেয়াদি চুক্তি করার কোনো এখতিয়ার একটি অস্থায়ী সরকারের আছে কিনা? এসবের জন্য নির্বাচিত সরকারের দরকার হয়। নির্বাচিত সরকারও এভাবে চুক্তি করতে পারে না। নির্বাচিত সরকার এ ধরনের চুক্তি করতে চাইলে সেগুলো সংসদে তুলতে হয়, সেখানে তর্ক-বিতর্ক হয়, দেশের মানুষ জানতে পারে, তারপর চুক্তি সম্পাদনের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। আর কয় মাস পর নির্বাচন। এ সময় সরকারের এ ধরনের চুক্তিতে এত আগ্রহ কেন? বন্দর নিয়ে দীর্ঘমেয়াদি চুক্তি যদি দেশের উন্নয়নের জন্যই হয়, তাহলে এত গোপনীয়তা, অস্বচ্ছতা ও তাড়াহুড়ো কেন?
এম গোলাম মোস্তফা ভুইয়া : রাজনীতিক, রাজনৈতিক বিশ্বেষক ও কলাম লেখক
gmbhuiyan@gmail.com
