Logo
Logo
×

উপসম্পাদকীয়

ফিলিস্তিনে মার্কিন ঔপনিবেশিকতার নতুন অধ্যায়

Icon

জোসেফ মাসাদ

প্রকাশ: ০১ ডিসেম্বর ২০২৫, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

ফিলিস্তিনে মার্কিন ঔপনিবেশিকতার নতুন অধ্যায়

জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ সম্প্রতি গাজার জন্য মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের তথাকথিত ‘শান্তি পরিকল্পনা’ গ্রহণ করেছে। এ ঘটনাকে অনেকেই দেখছেন গাজা এবং এর জনগণের ওপর যুক্তরাষ্ট্রকে, বিশেষ করে ট্রাম্পকে নতুন ‘ঔপনিবেশিক প্রভু’ হিসাবে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃতি দেওয়ার নামান্তর হিসাবে।

ট্রাম্পের উচ্চাভিলাষ : গত ফেব্রুয়ারিতে ট্রাম্প যখন গাজাকে নিয়ে তার পরিকল্পনার কথা প্রথম জানিয়েছিলেন, তখন তিনি গাজাকে পুরোপুরি যুক্তরাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে একটি ‘বিনিয়োগ প্রকল্প’ হিসাবে গড়ে তোলার প্রস্তাব দিয়েছিলেন। সেই পরিকল্পনায় গাজার সমগ্র ফিলিস্তিনি জনগোষ্ঠীকে উচ্ছেদ করে গাজাকে ‘মধ্যপ্রাচ্যের রিভেরা’ (বিলাসবহুল পর্যটন কেন্দ্র) বানানোর স্বপ্ন দেখানো হয়েছিল। এমনকি ইসরাইলপন্থি সিএনএনও তখন এ পরিকল্পনাকে ‘একবিংশ শতাব্দীর ঔপনিবেশিকতা’ বলে আখ্যায়িত করেছিল।

আন্তর্জাতিক সমালোচনার মুখে মার্কিন কর্মকর্তারা তখন বলেছিলেন যে, সেখানে কোনো মার্কিন সৈন্য থাকবে না বা জনসংখ্যা স্থানান্তর হবে সাময়িক। কিন্তু এখন জাতিসংঘের ম্যান্ডেট নিয়ে ট্রাম্প তার সেই পুরোনো পরিকল্পনাটিই ‘শান্তি পরিকল্পনা’র মোড়কে আবার সামনে এনেছেন। আলজেরিয়া ও ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের (PA) মতো কিছু আরব দেশ ও গোষ্ঠী, যারা যুক্তরাষ্ট্রের অনুগত হিসাবে কাজ করে, তারা এ পরিকল্পনাকে সমর্থন দিচ্ছে। অন্যদিকে, রাশিয়া ও চীন ভোটদানে বিরত থেকে বুঝিয়ে দিয়েছে যে, ফিলিস্তিনিদের ভাগ্য নিয়ে তাদের বিশেষ মাথাব্যথা নেই।

তবে এ ঘটনা মোটেও অভূতপূর্ব নয়। এটি ফিলিস্তিনের মাটিতে যুক্তরাষ্ট্রের দীর্ঘদিনের ঔপনিবেশিক আকাঙ্ক্ষারই ধারাবাহিকতা, যার শুরু হয়েছিল ঊনবিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে, প্রায় ২০০ বছর আগে।

আমেরিকান ক্রুসেড: ১৮২১ সালের দিকেই মার্কিন মিশনারিরা ফিলিস্তিনে এসেছিলেন। পরবর্তী সময়ে ১৮৫০ ও ১৮৬০-এর দশকে আমেরিকান প্রটেস্টান্টরা জাফায় কৃষিভিত্তিক কলোনি বা বসতি স্থাপনের চেষ্টা করে। তারা একে বলত ‘শান্তিপূর্ণ ক্রুসেড’। তাদের উদ্দেশ্য ছিল ইহুদিদের ধর্মান্তরিত করা এবং যিশু খ্রিষ্টের দ্বিতীয় আগমনের (Second Coming) ক্ষেত্র প্রস্তুত করা। অবশ্য পরবর্তী সময়ে অ্যাডামস কলোনিসহ একাধিক মার্কিন বসতি স্থাপনের চেষ্টা তখন স্থানীয় ফিলিস্তিনিদের প্রতিরোধের মুখে এবং নিজেদের অদক্ষতায় ব্যর্থ হয়েছিল।পরিস্থিতি এখন এমন যে, ট্রাম্পের বর্তমান পরিকল্পনাকে সেই ২০০ বছর আগের ব্যর্থ মার্কিন ঔপনিবেশিক প্রচেষ্টারই আধুনিক সংস্করণ হিসাবে দেখাটা ভুল হবে না।

লিওপোল্ডীয় উচ্চাভিলাষ : ট্রাম্প নিজেকে গাজার অন্তর্বর্তীকালীন প্রশাসনের প্রধান বা তথাকথিত ‘বোর্ড অফ পিস’-এর প্রধান হিসাবে ঘোষণা করেছেন। এমনকি টনি ব্লেয়ারের মতো বিতর্কিত নেতাকেও তিনি এ বোর্ডে যুক্ত করেছেন। জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক সাবেক কর্মকর্তা ক্রেইগ মোখিবার তো ট্রাম্পের এ ভূমিকাকে কঙ্গোতে বেলজিয়ামের রাজা দ্বিতীয় লিওপোল্ডের ভূমিকার সঙ্গে তুলনা করেছেন।

ঊনবিংশ শতাব্দীতে রাজা লিওপোল্ড কঙ্গোকে যেভাবে নিজের ব্যক্তিগত সম্পত্তি বা কলোনি হিসাবে দখল করেছিলেন। সেখানে স্থানীয় মানুষকে দিয়ে জোর করে রাবার সংগ্রহের কাজ করানো হতো এবং অবাধ্য হলে বা কোটা পূরণ করতে না পারলে হাত কেটে ফেলার মতো নিষ্ঠুর শাস্তি দেওয়া হতো। প্রায় ১ কোটি মানুষ সেসময় লিওপোল্ডের নিষ্ঠুরতায় প্রাণ হারিয়েছিল।

কাজেই এমন আশঙ্কা অমূলক নয় যে, গত দুবছরে গাজায় ইসরাইলি হামলায় এবং মার্কিন সহায়তায় যে গণহত্যা চলেছে, ট্রাম্পের প্রত্যক্ষ শাসনে তা হয়তো কঙ্গোর সেই ভয়াবহ ইতিহাসেরই পুনরাবৃত্তি ঘটাতে পারে। কঙ্গোতে লিওপোল্ড চেয়েছিলেন রাবার, আর গাজায় ট্রাম্পের চোখ হয়তো সেখানকার তেল ও প্রাকৃতিক গ্যাস সম্পদের ওপর।

ভবিষ্যৎ কী : ট্রাম্পের শাসনে গাজার ফিলিস্তিনিদের ভাগ্যে কী আছে, তা এখনো অস্পষ্ট। তবে ইতোমধ্যেই হাজার হাজার ফিলিস্তিনি তাদের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ হারিয়েছেন। ট্রাম্প ও ইসরাইলের এ বিশাল ‘শান্তি বাণিজ্যের’ বা প্রতারণার মধ্যে একমাত্র যে বিষয়টি তারা হিসাবের মধ্যে আনেনি, তা হলো গাজার মানুষের অবিচলতা ও প্রতিরোধ স্পৃহা। মনে রাখতে হবে, গত দুই বছরেরও বেশি সময় ধরে চলা বর্বরতার পরও গাজার মানুষ কিন্তু তাদের হার না মানা মনোভাব ধরে রেখেছে।

*মিডল ইস্ট আই থেকে ভাবানুবাদ।

জোসেফ মাসাদ : কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের আধুনিক আরব রাজনীতি এবং বুদ্ধিবৃত্তিক ইতিহাসের অধ্যাপক

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম