Logo
Logo
×

উপসম্পাদকীয়

বাঁচাতে হবে শিল্প খাত

Icon

ইয়াসির এম ফয়সাল

প্রকাশ: ০১ ডিসেম্বর ২০২৫, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

বাঁচাতে হবে শিল্প খাত

পোশাকশিল্প বাংলাদেশের অর্থনীতির মূল স্তম্ভ হিসাবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে। বিশ্বে বাংলাদেশ ২য় বৃহত্তম তৈরি পোশাক রপ্তানিকারক দেশ। দেশের মোট রপ্তানির প্রায় ৮৪ ভাগজুড়েই রয়েছে আমাদের এ পোশাকশিল্প বা রেডিমেড গার্মেন্টস। শুধু তাই নয়, এ পোশাকশিল্পে কাজ করে প্রায় ৫০ লাখ মানুষ তাদের জীবিকা নির্বাহ করছে। ১৯৮০ সালে মাত্র ১.৮ মিলিয়ন ডলারের রপ্তানি থেকে বেড়ে সেটি এখন দাঁড়িয়েছে ৪৭ বিলিয়ন ডলারে। কিন্তু দুঃখের বিষয়, আমাদের অর্থনীতির চালিকাশক্তি এ পোশাকশিল্প বিবিধ কারণে একের পর এক বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। গত এক বছরের এক পরিসংখ্যান থেকে দেখা যায়, ২৫৮টি পোশাক কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। যার ফলে বিপুলসংখ্যক পোশাক শ্রমিক বেকার হয়ে পড়েছে। অপর এক পরিসংখ্যানে বলা হয়েছে, বেকার হয়ে পড়া এ পোশাক শ্রমিকের সংখ্যা এক লাখেরও বেশি।

এবারে আসা যাক, একের পর এক কেন বন্ধ হচ্ছে পোশাক কারখানা। একটা কারণ হচ্ছে শ্রমিক অসন্তোষ। কেন এ অসন্তোষ? শ্রমিকরা সময়মতো বেতন পান না। তাছাড়া তাদের মজুরি বৃদ্ধি ও সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধির জন্যও তারা আন্দোলন করে। শ্রমিকদের অধিকার যেটা, সেটার জন্য আন্দোলন করা ঠিক আছে এবং বেশির ভাগ মালিকপক্ষ সেটা মেনেও নেয়। তবে অনেক সময় শ্রমিকরা তাদের রাইট্সের বাইরে অতিরিক্ত চান। এমনসব আবদার করেন, যেটা মালিকপক্ষের পক্ষে পূরণ করা সম্ভব হয় না। শ্রমিকদের অনেক ট্রেড ইউনিয়ন আছে, যারা তাদের এ অতিরিক্ত দাবি নিয়ে লাগাতার আন্দোলন করে যায়। এসব আন্দোলনের একটা পর্যায়ে মালিকপক্ষের ফ্যাক্টরি বন্ধ করা ছাড়া আর কোনো উপায় থাকে না। কেননা এমনও দেখা গেছে, একেকটি ফ্যাক্টরির মধ্যে ৭-৮টি করে ট্রেড ইউনিয়ন রয়েছে। সুতরাং যে ফ্যাক্টরিতে ৭-৮টি ট্রেড ইউনিয়ন রয়েছে, সেখানে আন্দোলনের মাত্রা কী হতে পারে, তা সহজে অনুমেয়।

দ্বিতীয় বিষয়টি হচ্ছে, আন্তর্জাতিক পর্যায়ের ক্রেতারা পণ্যের দাম কমানোর জন্য চাপ সৃষ্টি করে। কিন্তু আমাদের কোনো মার্জিন থাকে না পণ্যের দাম কমানোর জন্য। কারণ গ্যাসের মূল্য, শ্রমিকদের বেতন, এগুলো তো দিন দিন শুধু বাড়ছে। এগুলো আর কমছে না। একদিকে আমাদের উৎপাদন ব্যয় বাড়তে থাকে, ওদিকে বায়াররা পণ্যের দাম কমাতে বলে। সুতরাং বায়ারদের কথা শুনতে গেলে আমাদের প্রোফিট বলতে কিছুই থাকে না। মালিকরা যদি একটু লাভের মুখ দেখে, তাহলে শিল্পে চাঙা ভাব আসবে। রপ্তানির প্রাপ্ত লভ্যাংশ পুনর্বিনিয়োগ হয়ে উৎপাদন বাড়বে। নতুন নতুন আরও কারখানার উদ্ভব হবে। আরও মানুষের কর্মসংস্থান হবে। কিন্তু বর্তমান প্রতিযোগিতামূলক বিশ্বে এমনটি খুব একটা দেখা যাচ্ছে না। লাভ যদি না হয়, তাহলে মালিকরা কেন চালাবে পোশাকশিল্প। ফলে বাধ্য হয়ে বন্ধ করে দেয়।

তৃতীয় বিষয়টি হচ্ছে গ্যাস-বিদ্যুৎ সংকট। আমাদের কল-কারখানাগুলোতে গ্যাস-বিদ্যুতের অপর্যাপ্ততার কারণে উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। ফলে বায়ারদের সময়মতো পণ্য সরবরাহ করা যাচ্ছে না। এ কারণে অনেক শিপমেন্ট বাতিল হয়ে যাচ্ছে। তাই এ বিষয়ে সরকারের পুরোপুরি নজর দেওয়া দরকার। সরকার অস্থির হয়ে গেছে বাইরের ইনভেস্টমেন্ট আনার জন্য। কিন্তু আমাদের যত ইন্ডাস্ট্রি আছে, সেগুলোয় যদি ফুল সাপোর্ট দিতে পারি, নিরবচ্ছিন্নভাবে গ্যাস, বিদ্যুতের সরবরাহ করতে পারি, তাহলে উৎপাদন বাড়বে। রপ্তানির চাকা গতিশীল হবে। আর রপ্তানির চাকা গতিশীল হলে দেশে বৈদেশিক রিজার্ভ বাড়বে। ফলে বিদেশি বিনিয়োগ অটোমেটিক আসতে শুরু করবে। সরকারের উচিত হবে ছোটখাটো এসএমই কারখানা যেগুলো রয়েছে, ওদের আর্থিক সহায়তা দেওয়া। তাহলে এদের থেকেও এক্সপোর্ট সাপোর্ট আসবে।

চতুর্থ বিষয়টি হলো ব্যাংক সুদের হার কমানো। সরকার ব্যাংকের সঙ্গে বসে আলোচনার মাধ্যমে সুদের হার কমাতে পারে। সুদের হার কমলে মানুষ লোন নিয়ে আরও অন্য শিল্প ও কলকারখানা প্রতিষ্ঠায় উদ্যোগী হবে। পঞ্চম বিষয়টি হলো, ব্যবসা শুরু করার কাজটিকে সহজ করে দিতে হবে। কেননা, একটা ব্যবসা শুরু করতে গেলে মিনিমাম ৮-১০টি শুধু লাইসেন্সই লাগে। অন্য কাগজপত্র তো আছেই। এসব লাইসেন্স ও কাগজপত্র জোগাড় করতে করতে ৬-৮ মাস চলে যায়, তাহলে সে আর কী ব্যবসা করবে! ব্যবসা শুরু করতে গিয়ে লাইসেন্সপ্রাপ্তির দীর্ঘসূত্রতার কারণে অনেকে উৎসাহ হারিয়ে ফেলে। সুতরাং একটা কার্যালয়ে গিয়ে অল্প সময়ের মধ্যেই যাতে সব লাইসেন্স একসঙ্গে পাওয়া যায়, এমন ব্যবস্থা করতে হবে। তাহলে উদ্যোক্তারা সহজে ব্যবসা শুরু করতে পারবে। উৎসাহ হারাবে না।

ষষ্ঠ বিষয়টি হলো, আমাদের পোশাক রপ্তানির সবচেয়ে বড় ক্রেতা হলো আমেরিকা। ট্রাম্প ক্ষমতায় এসেই বিশাল ট্যাক্স ধার্য করে দেয়। এতে আমাদের পোশাক রপ্তানিকারকরা বিপাকে পড়ে। কারণ আমেরিকা কর্তৃক ট্যাক্স বাড়ানোর কারণে বায়াররা এ ট্যাক্সের ভার আমাদের কাঁধে ফেলতে চাচ্ছে। ট্যাক্স যদি ১০ শতাংশ বাড়ায়, তাহলে বায়াররা বলছে, ৫ শতাংশ তোমরা দাও আর বাকি ৫ শতাংশ আমি দেব। যার কারণে আমাদের পণ্যের মূল্য অনেকাংশেই বেড়ে যাচ্ছে। ফলে লাভ কম হচ্ছে। আবার কিছু কিছু বায়ার বলছে, ট্যাক্সের পুরোটাই আমাদের দিতে হবে। আমার পরিচিত কয়েকজন মালিকের অর্ডারই পুরোপুরি বাতিল হয়ে গেছে এসব কারণে। তারা বিদেশ থেকে সুতা আনিয়ে, এক্সেসরিজ আনিয়ে, কাপড় বানিয়ে শিপমেন্টের জন্য প্রস্তুত করার পর এসব কারণে যখন শিপমেন্ট বাতিল হয়ে যায়, তখন মালিক কতটা ক্ষতির মুখে পড়ে, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।

সব মিলিয়ে দেশকে রপ্তানিমুখর করতে হলে এবং ব্যবসা-বাণিজ্যে গতি ফেরাতে হলে এলসি মার্জিন এবং ব্যাংকিং ব্যবস্থাটা আরও সহজ করে দিতে হবে। ব্যাংক সুদের হার কমিয়ে দিতে হবে। ট্যাক্সের বিষয়টিকে নেগোসিয়েশনের মাধ্যমে যতটা সম্ভব কমিয়ে আনতে হবে। নিরবচ্ছিন্নভাবে গ্যাস-বিদ্যুতের সরবরাহ বাড়াতে হবে। এর পাশাপাশি আন্তর্জাতিকভাবে বিভিন্ন এক্সপো বা মেলার আয়োজন করতে হবে। আমাদের দেশে যে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যমেলা হয়, সেটা খুবই অপ্রতুল। পোশাকশিল্পের ফোকাস সেখানে অতটা থাকে না। বিদেশে এ রকম মেলা অনেক হয়, কিন্তু বাংলাদেশে খুব কমই দেখা যায়। বিদেশে অনেক আন্তর্জাতিক মেলা হয়, যেখানে পোশাকশিল্পের প্রোডাক্ট থাকে, সেখানে বিদেশি ক্রেতারা আসে, পণ্য দেখে পছন্দ করে অর্ডার দেয়। আমাদের তৈরি পোশাক নিয়ে আলাদাভাবে এবং আন্তর্জাতিকভাবে মেলার আয়োজন করা যেতে পারে। এতে করে বাংলাদেশে বায়াররা আসবে, আমাদের পণ্য দেখবে। এ শিল্পকে ফোকাস করার জন্য বাংলাদেশ সরকার আন্তর্জাতিক মেলার মাধ্যমে বাইরের বায়ারদের দাওয়াত দিতে পারে। এখান থেকে নতুন নতুন বায়ার তৈরি হবে। এতে করে রপ্তানির চাকাতে একটা গতি আসবে। এটা যদি করা যায়, তাহলে ছোটখাটো ফ্যাক্টরি যেগুলো রয়েছে অথবা বড় ফ্যাক্টরি, সবার জন্যই অনেক উপকার হবে। এতে করে আমাদের পণ্য রপ্তানি যেমন বাড়বে, তেমনি আমাদের শিল্প ও কলকারখানাগুলোও বাঁচবে। আমাদের বৈদেশিক রিজার্ভ বাড়বে । দেশের অর্থনীতিতে একটা গতি আসবে।

(অনুলিখন : জাকির হোসেন সরকার)

ইয়াসির এম ফয়সাল : শিল্প উদ্যোক্তা

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম