Logo
Logo
×

উপসম্পাদকীয়

সুস্থ মাটিই নিরাপদ ভবিষ্যতের ভিত্তি

Icon

ড. মোহাম্মদ আল-মামুন

প্রকাশ: ০৫ ডিসেম্বর ২০২৫, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

সুস্থ মাটিই নিরাপদ ভবিষ্যতের ভিত্তি

মাটি পৃথিবীর প্রাণ-মানুষের অস্তিত্ব, খাদ্য নিরাপত্তা ও পরিবেশগত ভারসাম্যের মৌলিক ভিত্তি। এ সম্পদ আজ বিশ্বজুড়ে গভীর সংকটের মুখে। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটও ব্যতিক্রম নয়। কৃষিনির্ভর এ দেশে মাটির অবক্ষয় শুধু পরিবেশগত সমস্যা নয়; এটি খাদ্য নিরাপত্তা, জনস্বাস্থ্য এবং জাতীয় অর্থনীতির জন্য এক বড় হুমকি। উর্বর জমি কমে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে উৎপাদনশীলতাও হ্রাস পাচ্ছে। লবণাক্ততা বৃদ্ধি, জৈব পদার্থের ঘাটতি, টপসয়েলের ক্ষয়, শিল্পবর্জ্য দ্বারা দূষণ ভবিষ্যতের খাদ্য উৎপাদন সক্ষমতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে। এর প্রভাব সরাসরি পড়ছে কৃষকের আয়, গ্রামীণ জীবিকা এবং বাজারব্যবস্থার ওপর।

মৃত্তিকা বিজ্ঞানের আন্তর্জাতিক ইউনিয়ন নির্ধারিত ‘বিশ্ব মৃত্তিকা দিবস ২০২৫’-এর প্রতিপাদ্য ‘সুস্থ নগরের জন্য সুস্থ মাটি’, যা দ্রুত নগরায়ণের যুগে অত্যন্ত সময়োপযোগী। কারণ ২০৫০ সালের মধ্যে বিশ্বের প্রায় ৭০ শতাংশ মানুষ শহরে বসবাস করবে। বাংলাদেশেও নগরায়ণের গতি অত্যন্ত দ্রুত; ঢাকাসহ বড় শহরগুলো সম্প্রসারিত হচ্ছে পরিকল্পনাহীনভাবে। নগর পরিকল্পনায় মাটিকে প্রায় অদৃশ্য উপাদান হিসাবে দেখা হয়, অথচ শহরের পানি ধারণক্ষমতা, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, সবুজ এলাকা, তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ ও মানুষের সুস্থতার ভিত্তিই হলো সুস্থ মাটি।

নগরায়ণের চাপে শহরের মৃত্তিকা দ্রুত গুণগত মান হারাচ্ছে। এক্ষেত্রে প্রধান দুটি সমস্যা হলো জৈব পদার্থের ঘাটতি এবং ভারী ধাতুর দূষণ। শহুরে মৃত্তিকায় জৈব কার্বনের পরিমাণ দ্রুত কমছে, যা মাটির কাঠামো ভেঙে দিচ্ছে এবং পানি ও পুষ্টি ধরে রাখার ক্ষমতা হ্রাস করছে। শিল্পাঞ্চলের কাছাকাছি অনেক এলাকার মাটিতে সিসা, ক্যাডমিয়াম, ক্রোমিয়ামসহ ক্ষতিকর ধাতুর মাত্রা নিরাপদ সীমা ছাড়িয়ে গেছে। এসব ধাতু শুধু মাটির ক্ষতি করে না, খাদ্যচক্রে প্রবেশ করে মানুষের জন্য দীর্ঘমেয়াদি স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরি করে-যেমন, কিডনি বিকল, স্নায়ুবিক সমস্যা, ক্যানসার এবং শিশুর মস্তিষ্কের বিকাশে বাধা।

আরেকটি বড় সংকট হলো শহরের কংক্রিটায়ন। অনেক শহরে খোলা মাটি প্রায় বিলুপ্ত। রাস্তা, ভবন, ড্রাইভওয়ে, পার্কিং লট-সবই কংক্রিট ও বিটুমিন দিয়ে ঢেকে যাচ্ছে। এর ফলে বৃষ্টির পানি মাটিতে প্রবেশ করতে না পেরে সরাসরি ড্রেনে চলে যায়, যা স্বল্প বৃষ্টিতেও জলাবদ্ধতা বাড়ায় এবং দীর্ঘমেয়াদে ভূগর্ভস্থ পানি পুনঃভরন কমিয়ে দেয়।

শহরের মাটি দূষিত হলে বায়ুদূষণের সমস্যাও বাড়ে। ঢাকার মতো ঘনবসতিপূর্ণ মহানগরে পিএম-২.৫ এবং পিএম-১০-এর বড় একটি অংশ আসে খোলা মাটির ধূলিকণা থেকে। নির্মাণকাজ, সড়ক খনন, অপরিকল্পিত বর্জ্য ব্যবস্থাপনা এবং যানবাহনের চাপ শহরের বায়ুতে স্থায়ী ধূলিঝড় তৈরি করে, যা প্রতিদিন মানুষ শ্বাসের সঙ্গে গ্রহণ করে। মৃত্তিকার প্রকৃতি ও গুণাগুণ শহরের বায়ুদূষণের ধরনকে সরাসরি প্রভাবিত করে।

গ্রামীণ মৃত্তিকার পরিস্থিতিও আশঙ্কাজনক। বাংলাদেশের কৃষিজমিতে রাসায়নিক সার ব্যবহারের পরিমাণ দুই দশকে ব্যাপকভাবে বেড়েছে। ২০২২-২৩ অর্থবছরে দেশের ৮১ লাখ হেক্টর কৃষিজমিতে ৬৫.৫৩ লাখ টন রাসায়নিক সার প্রয়োগ করা হয়েছে। উচ্চফলনশীল ধান, সবজি ও বাগান ফসলের চাহিদা মেটাতে কৃষক প্রয়োজনের তুলনায় বেশি সার প্রয়োগ করলে মাটিতে অম্লত্ব বৃদ্ধি, অণুজীব ধ্বংস, পুষ্টির ভারসাম্যহীনতা এবং খনিজ ক্ষয়-সবই ঘটে। দীর্ঘমেয়াদে মাটি শক্ত হয়ে যায়, পানি ধারণক্ষমতা কমে যায় এবং ফসলের উপরিভাগ পুষ্টিহীন হয়ে পড়ে। অন্যদিকে জৈবসারের ব্যবহার ক্রমেই কমছে, ফলে মাটির জীবনীশক্তি দ্রুত নিঃশেষ হচ্ছে। গোবর, কম্পোস্ট, সবুজ সার এবং পাতাজাত বর্জ্য ব্যবহার কমে যাওয়ায় জমির গঠন দুর্বল হচ্ছে এবং বৃষ্টির সময় উপরের মাটি ক্ষয় হয়ে যাচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তন এ সংকটকে আরও জটিল করে তুলেছে।

এ বহুমাত্রিক সংকট মোকাবিলায় সময়োপযোগী, বিজ্ঞানভিত্তিক এবং সমন্বিত উদ্যোগ অপরিহার্য। সমন্বিত মৃত্তিকা ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করতে হবে। রাসায়নিক সার, জৈবসার, মাইক্রোবিয়াল সার-সবকিছুই একটি বৈজ্ঞানিক ভারসাম্যের ভিত্তিতে প্রয়োগ করতে হবে। গবেষণা ও প্রযুক্তির প্রয়োগ বাড়াতে হবে। রিমোট সেন্সিং, জিআইএস, মৃত্তিকা সেন্সর, ড্রোনভিত্তিক মূল্যায়ন-এসব প্রযুক্তির সাহায্যে দেশের প্রতিটি অঞ্চলের মাটির স্বাস্থ্যমান নিয়মিত পর্যবেক্ষণ করা সম্ভব।

নগর বর্জ্য ব্যবস্থাপনা উন্নত করতে হবে। শহরের বর্জ্যরে উল্লেখযোগ্য অংশ জৈব; এগুলোকে কম্পোস্টে রূপান্তর করা হলে শহরের মৃত্তিকা জৈব পদার্থের ঘাটতি পূরণ করা সম্ভব। একইসঙ্গে প্লাস্টিক, ট্যানারি বর্জ্য ও শিল্পবর্জ্য নিয়ন্ত্রণে কঠোর নীতিমালা প্রয়োগ করতে হবে। নির্মাণকাজে ধুলা নিয়ন্ত্রণ, রাস্তা পরিষ্কার, ডাস্ট সাপ্রেসেন্ট ব্যবহার এবং শিল্প-কারখানায় উচ্চমানের ফিল্টার স্থাপন বাধ্যতামূলক করা না হলে, শহুরে মৃত্তিকার উন্নয়ন সম্ভব নয়। ছাদকৃষি, নগরবাগান, পার্ক ও খেলার মাঠ রক্ষা, বৃক্ষরোপণ-এসব উদ্যোগে নাগরিক অংশগ্রহণ বাড়াতে হবে।

বাংলাদেশের সামষ্টিক অর্থনীতি, খাদ্য নিরাপত্তা, নগর-গ্রাম বৈষম্য এবং জলবায়ু ঝুঁকি-সবই মাটির সঙ্গে সরাসরি সম্পর্কিত। যে মাটি আমাদের জীবনের ভিত্তি, সেই মাটিই এখন সর্বাধিক বিপন্ন। রাষ্ট্রীয় নীতিমালা, প্রযুক্তি উদ্ভাবন, গবেষণা প্রতিষ্ঠান, স্থানীয় সরকার, নাগরিক সমাজ-সব পক্ষকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে। সঠিক সময়ে কার্যকর সিদ্ধান্ত না নিলে আগামী প্রজন্মের জন্য সুস্থ নগর, নিরাপদ খাদ্য বা টেকসই কৃষি-কোনো কিছুই নিশ্চিত রাখা যাবে না।

মাটি বাঁচলে দেশ বাঁচবে-এটি কোনো স্লোগান নয়, বৈজ্ঞানিক বাস্তবতা। সুস্থ মাটিই টেকসই খাদ্য, টেকসই কৃষি, টেকসই শহর এবং টেকসই ভবিষ্যতের মূলধন। এখনই যদি আমরা মাটির স্বাস্থ্যকে জাতীয় অগ্রাধিকার না দিই, তাহলে খাদ্য নিরাপত্তার পাশাপাশি দেশের পরিবেশগত স্থিতিশীলতা ভবিষ্যতে গভীর সংকটে পড়বে। তাই প্রত্যেক নাগরিকের দায়িত্ব মাটির প্রতি যত্নবান হওয়া। নীতিনির্ধারকদের দায়িত্ব আগামীর কথা ভেবে পরিকল্পনা গ্রহণ করা এবং গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলোর দায়িত্ব বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিকে মানুষের জীবিকার সঙ্গে যুক্ত করা।

সুস্থ মাটিই টেকসই খাদ্যব্যবস্থা, টেকসই কৃষি, টেকসই নগরায়ণ এবং একটি নিরাপদ ভবিষ্যতের ভিত্তি। এখনই যদি মাটির স্বাস্থ্য সুরক্ষার বিষয়টিকে জাতীয় অগ্রাধিকার না দেওয়া হয়, তাহলে খাদ্য নিরাপত্তা থেকে শুরু করে পরিবেশগত স্থিতিশীলতা-সবকিছুই এক কঠিন সংকটে পড়তে পারে। তাই প্রয়োজন সমন্বিত উদ্যোগ। সম্মিলিত প্রচেষ্টার মাধ্যমেই সম্ভব সুস্থ মাটি, সবুজ পরিবেশ এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য একটি বাসযোগ্য, টেকসই বাংলাদেশ গড়ে তোলা।

ড. মোহাম্মদ আল-মামুন : প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, বাংলাদেশ পাট গবেষণা ইনস্টিটিউট

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম